আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন ধরেই দেশে-বিদেশে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন’ নিয়ে নানা আলোচনা চলছিল। দেশি-বিদেশি রাজনীতিক, কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষকদের মতামতেও এ বিষয়টি উঠে এসেছে বারবার। বিশেষ করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য হবে- সেই প্রশ্নও ওঠে আন্তর্জাতিক মহলে। বিশেষ করে ভারতের গণমাধ্যমগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থনমুখী অবস্থান দেখা যায়। তাদের ভাষ্য ছিল- আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন হলে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
তবে সাম্প্রতিক অবস্থান বেশ বদলে গেছে। এখন ভারতও বলছে- বাংলাদেশে যে সরকারই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসুক, তারা সেই সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই কাম্য। একইসঙ্গে তিনি বলেন- বাংলাদেশ সরকার যে সময়সীমা ঘোষণা করেছে, তাতে ভারত উৎসাহিত; দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলেই তারা আশাবাদী।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রথমদিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের যে চাপ দেখা গিয়েছিল, এখন সেটি অনেকটা কমে এসেছে। তারা এখন সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়টি নয়, বরং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ছাড়া কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে বিদেশিরা এখন নীরব।
এদিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে কোনো বিদেশি চাপ নেই- এমন মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনও। গতকাল বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চাপ নেই। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে শেষ হবে বলেই আমরা মনে করি।’
সম্প্রতি ঢাকায় সফর করেন কমনওয়েলথ মহাসচিব শার্লি আয়োরকর বচওয়ে। তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা বললেও, উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানান- নির্বাচন কীভাবে হবে সে বিষয়ে প্রফেসর ইউনূস ইতোমধ্যেই ধারণা দিয়েছেন, বাকিটুকু নির্বাচন কমিশনের বিষয়। কমনওয়েলথ মূলত পর্যবেক্ষক পাঠানোর জন্যই এসেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, নির্বাচন খুবই সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলকভাবে শেষ হবে।’
মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি বিবেচনায় সেখানে পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রয়োজন নেই। নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অন্যদিকে ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডিগার লোটজও আশা প্রকাশ করেছেন যে বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচন হবে- ‘সুষ্ঠু, অবাধ, বিশ্বাসযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক।’
ডিক্যাব আয়োজিত ‘ডিক্যাব টক’ আলোচনায় তিনি বলেন, ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানে হলো- জনগণের ভোট দেওয়ার পূর্ণ সুযোগ নিশ্চিত করা এবং কাউকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত না করা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব ভোটারের অংশগ্রহণ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করাই মূল শর্ত।’
তিনি আরো বলেন, নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতা পরিহার করে প্রচারণা চালাতে হবে। ভোটাররা যেন ভয়মুক্ত পরিবেশে মতপ্রকাশ করতে পারেন এবং বিদেশে থাকা ভোটাররাও অংশ নিতে পারেন- এগুলোই সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত।
রাষ্ট্রদূত লোটজ উচ্চ ভোটদানের হারকে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। তার মতে, বিশ্বে সাধারণত ৫০-৮০ শতাংশ ভোটার উপস্থিত থাকেন। বাংলাদেশের নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে আরো ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্কের পরিবেশও তৈরি হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য কমনওয়েলথের পূর্ণ সহযোগিতা কামনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ২৪ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মহাসচিব শার্লি আয়োরকর বচওয়ের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, ‘আমাদের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন সফলভাবে আয়োজনের জন্য আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
জবাবে কমনওয়েলথ মহাসচিব আশ্বস্ত করে বলেন, ‘কমনওয়েলথ নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী উত্তরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে পূর্ণ সহায়তা প্রদান করবে।’
তিনি জানান, কমনওয়েলথের ৫৬টি দেশের মধ্যে জি-৭ ও জি-২০ সদস্যও রয়েছে, যা পারস্পরিক সহযোগিতার বড় সুযোগ তৈরি করে। তার সফরে তিনি প্রধান বিচারপতি, আইন উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
কেকে/এমএ