বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ট্রেড ফাইন্যান্স ও অন্যান্য সেবার ডিজিটালাইজেশনে অগ্রগতি দেখা গেলেও পূর্ণাঙ্গ রূপান্তর এখনো অনেক দূরে। প্রযুক্তি ব্যয়, সাইবার ঝুঁকি, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, দক্ষ জনবল ও আইনি স্বীকৃতির ঘাটতি- এই পাঁচটি প্রধান চ্যালেঞ্জ ব্যাংকগুলোর ডিজিটাল পদক্ষেপকে সীমিত করছে। দেশের ৮৪ শতাংশ ব্যাংকের নিজস্ব ডিজিটালাইজেশন রোডম্যাপ আছে। তবে বাজেট সংকট, সময়সীমা নির্ধারণে অনিশ্চয়তা এবং বাস্তবায়ন কাঠামোর দুর্বলতার কারণে এসব রোডম্যাপ কার্যকরভাবে এগোচ্ছে না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। সোমাবার (২৪ নভেম্বর) বিএআইবিএম আয়োজিত ‘ট্রেড ফাইন্যান্সের ডিজিটাইজেশন : বর্তমান পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক কর্মশালায় এ তথ্য জানানো হয়।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ৯৫ শতাংশ ব্যাংক নিজেদের ট্রেড ফাইন্যান্স কার্যক্রমকে ‘আংশিক ডিজিটাল’ বলে উল্লেখ করেছে। মাত্র ৫ শতাংশ ব্যাংক এখনো পুরোপুরি ম্যানুয়াল এবং কোনো ব্যাংকই পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশনের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ফলে ডিজিটাল ব্যবস্থা থাকলেও তা এখনো পুরোনো ম্যানুয়াল কাঠামোর ওপরই নির্ভরশীল।
ব্যাংকগুলো জানায়, এলসি ইস্যু, বিল প্রসেসিং, পেমেন্ট ও রিপোর্টিংসহ বিভিন্ন কাজের সময় কমেছে, ভুলের হার কমেছে এবং গ্রাহক সেবা দ্রুত হয়েছে। মোবাইল অ্যাপ, অনলাইন নোটিফিকেশন, আরপিএ, এসডব্লিউআইএফটি ইন্টিগ্রেশনসহ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কথাও জানিয়েছে কিছু ব্যাংক। তবে ডকুমেন্ট প্রসেসিং ও রেগুলেটরি রিপোর্টিং এখনো সীমিত মাত্রায় ডিজিটাল, যা পুরো ডিজিটাল কর্মপ্রবাহে বড় বাধা হিসেবে রয়ে গেছে।
শুধু ৩৫ শতাংশ ব্যাংক বলছে তাদের ট্রেড ফাইন্যান্স ডিজিটালাইজেশন পরিকল্পনা ব্যাংকের সামগ্রিক ডিজিটাল রূপান্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদিকে বড় একটি অংশ- মধ্যম বা সামান্য সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মত দিয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতিরই ইঙ্গিত বহন করে।
গত তিন বছরে ৭০ শতাংশ ব্যাংক ম্যানুয়াল কাগজপত্র ব্যবহারে মাঝারি হ্রাস পেয়েছে বলে জানিয়েছে। কিন্তু ‘সম্পূর্ণ বাদ’ দেওয়ার অগ্রগতি এখনো নেই- যা ডিজিটাল ডকুমেন্ট, ই-স্বাক্ষর এবং স্ট্যান্ডার্ডাইজড প্রসেসিংয়ের অভাবকে নির্দেশ করে।
ডিজিটালি প্রক্রিয়াকৃত ট্রান্সঅ্যাকশনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ব্যাংক ২৬-৫০ শতাংশ (৪৫ শতাংশ) সীমায় আছে। কোনো ব্যাংকই ৭৬ শতাংশের ওপরে যেতে পারেনি। এটি গ্রাহক গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি, অসম্পূর্ণ অটোমেশন ও ব্যাক-এন্ড ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ার কারণে ঘটছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্যাংকগুলোর ৯০ শতাংশই জানিয়েছে, প্রযুক্তি স্থাপনের উচ্চ ব্যয় তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ৭৫ শতাংশ ব্যাংক। সমন্বিত প্রযুক্তি ব্যবস্থার ঘাটতি বা সিস্টেম ইন্টিগ্রেশনের অভাবকে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে ৬০ শতাংশ। আরো রয়েছে দক্ষ জনবলের সীমাবদ্ধতা- ৪৫ শতাংশ ব্যাংকের মতে প্রশিক্ষিত স্টাফের অভাব ডিজিটাল অগ্রগতিকে মন্থর করছে। একই ধরনের অনুপাত (৪৫ শতাংশ) উল্লেখ করেছে ইলেকট্রনিক ট্রান্সফারেবল রেকর্ডস (ইটিআর)ব্যবহারে আইনি কাঠামোর ঘাটতিকে।
ডিজিটাল রূপান্তরকে গতিশীল করতে ব্যাংকগুলো আরো কিছু অগ্রাধিকার উল্লেখ করেছে- যার মধ্যে রয়েছে সমন্বিত জাতীয় প্ল্যাটফর্ম গঠন ৮০ শতাংশ, আইটি খাতে বাড়তি বিনিয়োগে প্রয়োজনীয় সহায়তা ৭০ শতাংশ, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ৬০ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরও স্পষ্ট নীতিগত দিকনির্দেশনা ৬০ শতাংশ। সার্বিকভাবে, তারা মনে করে যে অবকাঠামো, আইন, নিরাপত্তা ও জনবল- সবকিছুতে সমন্বিত উদ্যোগই ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে কাক্সিক্ষত রূপান্তর আনতে পারে।
আইন, অবকাঠামো, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন এবং দক্ষ জনবলের ঘাটতি দূর করতে না পারলে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ট্রেড ইকোসিস্টেম গড়ে উঠবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার বলেন, ট্রেড ফাইন্যান্সের ডিজিটালাইজেশন এখন বিলাসিতা নয় বরং একটি অপরিহার্যতা। ম্যানুয়াল ও কাগজভিত্তিক সিস্টেম ধীর, ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। ডিজিটাল সিস্টেম কার্যকারিতা, বিশ্বাস ও কমপ্লায়েন্স বাড়ায় এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সহায়ক।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী ব্লকচেইনভিত্তিক ট্রেড ডকুমেন্টেশন, ই-বিল অব লেডিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ফ্রড শনাক্তকরণ, ইলেকট্রনিক কেওয়াইসি এবং ইন্টিগ্রেটেড ডিজিটাল সাপ্লাই চেইন প্ল্যাটফর্ম দ্রুত রূপান্তর ঘটাচ্ছে।
ডেপুটি গভর্নর বলেন, ডিজিটালাইজেশন শুধুমাত্র প্রযুক্তি নয়, এটি আমাদের অর্থনীতির ভবিষ্যত গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাংলাদেশের স্মার্ট, প্রতিযোগিতামূলক ও রপ্তানি-ভিত্তিক জাতিতে রূপান্তর অনেকটাই নির্ভর করছে আমরা কিভাবে ট্রেড ফাইন্যান্স আধুনিক করি তার ওপর। যদি আমরা দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতা নিয়ে এগুতে পারি, নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ খুলতে পারি, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারি, লেনদেন খরচ কমাতে পারি এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারি।
কেকে/এআর