ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল চলছে। এরই মধ্যে দেশের ৬৪ জেলায় পুলিশ সুপার (এসপি) পদায়ন করা হয়েছে। লটারি পদ্ধতিতে তাদের নির্বাচন করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের ৩৩ কর্মকর্তাকে উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সারা দেশে একসঙ্গে ৮২৬ বিচারককে বদলি করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়।
এদিকে লটারির মাধ্যমে এসপি পদে পদায়নে পুলিশ প্রশাসনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, এ প্রক্রিয়ায় যোগ্য ও মেধাবীরা বঞ্চিত হয়েছেন। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, মেধাবীদের এ পদায়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কে কোন জেলায় যাবেন সেটি লটারিতে করা হয়েছে।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে জেলাগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করার পর এসপি পদে পদায়নে লটারি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা তিনটি ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করছি; এ-ক্যাটাগরি, বি-ক্যাটাগরি, সি-ক্যাটাগরি। এটা জেলার আয়তনের ভিত্তিতে করা হয়নি, আমরা করেছি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। ওই জেলাগুলো নির্ধারণ করে, তারপর আমরা ঠিক করেছি এসপিদের কারে কারে দেব। আমাদের টোটাল এসপি ছিল মনে হয় ৬৪ জেলায়। ৬৪ জেলা থেকে আমরা ১৮ জনকে উঠিয়ে এনেছি। ১৮ জনের জায়গায় আবার আমরা নতুন কর্মকর্তা দিয়েছি। লটারি করে যারটা যেই জেলায়, যার কপাল আছে ওই জেলায় পড়ছে।’
ওসিদের পদায়নও কি লটারির মাধ্যমে হচ্ছে- জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ইনশাআল্লাহ।
এর আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের জন্য লটারি করে ৬৪ জেলার এসপি চূড়ান্ত করা হয়েছিল। গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় এ লটারি করা হয়। গতকাল নতুন এসপিদের পদায়নের প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, লটারি করার আগে ২৫ ও ২৭তম বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের কর্মকর্তা ও বর্তমানে ৬৪ জেলার কর্মরত এসপিদের নিয়ে তালিকা করা হয়। তাদের মধ্যে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের অনুগত নয়; কর্মজীবনে সততা, সুনাম, দক্ষতা, যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা রয়েছেÑ এমন কর্মকর্তাদের নিয়ে তালিকা করা হয়। পরে তাদের মধ্য থেকে লটারি করে ৬৪ জেলার এসপি চূড়ান্ত করা হয়।
এদিকে সারা দেশে একসঙ্গে ৮২৬ বিচারককে বদলি করে গতকাল বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এ এফ এম গোলজার রহমান স্বাক্ষরিত বদলি ও পদোন্নতির এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনের তথ্য অনুযায়ী, তিনটি পদে মোট পদোন্নতি ও পদায়ন হয়েছেন ৮২৬ জন। এর মধ্যে অতিরিক্ত জেলা জজ থেকে জেলা জজ ২৫০ জন, যুগ্ম জেলা জজ থেকে অতিরিক্ত জেলা জজ ২৯৪ জন ও সিনিয়র সহকারী জজ থেকে যুগ্ম জেলা জজ ২৮২ জন। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বদলিকৃতদের দপ্তরপ্রধান কর্তৃক মনোনীত কর্মকর্তার কাছে আগামী ২৭ নভেম্বর বর্তমান পদের দায়িত্বভার অর্পণ করে আগামী ১ ডিসেম্বরের মধ্যে বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ, মাতৃত্বকালীন ছুটি, বহিঃবাংলাদেশ ছুটিতে থাকা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও ছুটি শেষে কর্মস্থলে যোগদান করে কার্যভার হস্তান্তর করে অবিলম্বে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মস্থলে যোগদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।
১৬৬ উপজেলায় নতুন ইউএনও : উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদেও রদবদল এনেছে সরকার। গতকাল প্রথম ধাপে ১৬৬ উপজেলায় সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নতুন ইউএনও নিয়োগ দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আটটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ ইউএনওদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে ন্যস্ত করা কর্মকর্তাদের তাদের নিজ অধিক্ষেত্রে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ‘দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ এর সেকশন-১৪৪ এর ক্ষমতা অর্পণ করা হলো।
নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বদলি করা কর্মস্থলে যোগদান করবেন, অন্যথায় আগামী ৩০ নভেম্বর বিকালে বর্তমান কর্মস্থল (প্রশিক্ষণ/কর্মস্থল) থেকে তাৎক্ষণিক অবমুক্ত (স্ট্যান্ড রিলিজ) বলে গণ্য হবেন।
এর আগে কয়েক ধাপে দেশের একাধিক জেলায় নতুন জেলাপ্রশাসক নিয়োগ দেয় সরকার।
ডিআইজি হলেন ৩৩ পুলিশ কর্মকর্তা :
পুলিশের ৩৩ কর্মকর্তাকে উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। গতকাল এ সংক্রান্ত দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। একটি প্রজ্ঞাপনে ৩১ জনকে এবং আরেকটিতে দুজনকে পদোন্নতি দেওয়ার তথ্য জানানো হয়।
এদিকে লটারিতে এসপি করা নিয়ে পুলিশে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অনেকে বলছেন, লটারিতে ক্যাটাগরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা রক্ষা করা হয়নি। কারণ যারা ‘এ’ ক্যাটাগরির জেলায় আছেন, তারা সেই জেলা থেকে ‘এ’ ক্যাটাগরিরই অন্য জেলায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে জেলায় পোস্টিং পাওয়ার জন্য আগ্রহী ছিলেন এমন অনেক বঞ্চিত কর্মকর্তাকেই লটারির তালিকায় রাখা হয়নি। আবার এ লটারিতে বিগত সরকারের সহযোগী ছিলেন এমন অনেক সুযোগসন্ধানীর পুনর্বাসনের সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘লটারির মাধ্যমে দক্ষ কর্মকর্তাদের বেছে নেওয়া কঠিন। সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ জেলায় অভিজ্ঞ, দক্ষ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মকর্তাদের পোস্টিং দেওয়া হয়। কিন্তু লটারিতে অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাও গুরুত্বপূর্ণ জেলার এসপি পদ পেতে পারেন। যে কারণে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে লটারিতে কোনো ধরনের কর্মকর্তাদের সিলেক্ট করা হয়েছে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘লটারির মাধ্যমে পদায়ন ভালো কোনো উদাহরণ তৈরি করবে না। এমনকি লটারি করে পদায়নের ফলও ভালো আসে না। নিজেরা যোগ্য লোককে বাছাই করতে না পারার অক্ষমতা লটারির মাধ্যমে দূর করা সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘লটারিতেও অনিয়ম করা সম্ভব। এসপি হোক আর ডিসি হোক, লটারির ওপর নির্ভর করা ভালো কোনো প্রক্রিয়া নয়। এর ফলে পছন্দের লোককে লটারির মাধ্যমে পদায়নের ঘটনা ঘটবে। এতে যোগ্য কর্মকর্তার পদায়ন ঘটবে না।’
কেকে/এমএ