নিম্নমানের কিটক্যাট চকলেট বাজারজাতের দায়ে নেসলে বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দিপাল আবে বিক্রমা ও পাবলিক পলিসি ম্যানেজার রিয়াসাদ জামান এবং ভেজাল ও অনিরাপদ চিনি সরবরাহের অভিযোগে মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। একইসঙ্গে নিম্নমানের গুঁড়া দুধ বিক্রির দায়ে এসএ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মো. শাহাবুদ্দিন আলমের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
বাংলাদেশের নিরাপদ খাদ্য আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট নুসরাত সাহারা বীথি সোমবার (২৪ নভেম্বর) ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক (স্যানিটারি ইন্সপেক্টর) কামরুল হাসানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ পরোয়ানা জারি করেন। দুই মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ১৫ ডিসেম্বর।
মামলাকারী নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক কামরুল হাসান বলেন, ‘মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ রিফাইন সুগার দেখে সন্দেহ হওয়ায় পরীক্ষা করা হয় এবং তা ভেজাল ও অনিরাপদ পাওয়া যায়। বাজার থেকে সংগ্রহ করা কিটক্যাট পরীক্ষায়ও ভেজাল ও নিম্নমান ধরা পড়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এর ভিত্তিতেই আদালত আদেশ দিয়েছেন।’
নেসলে বাংলাদেশের পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) দেবব্রত রায় চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে যা হচ্ছে, সেটা হ্যারেজমেন্ট ছাড়া কিছু নয়। আমরা দুবাই ও ভারত থেকে কিটক্যাট আমদানি করি। কিটক্যাট পরীক্ষার বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড এখনো তৈরি হয়নি, তাই নিরাপদ খাদ্য আইন অনুযায়ী মাত্রা পরিমাপ করে আমদানি করি। মামলার পর আমরা ব্যাখ্যা দিয়েছি, কিন্তু মামলাকারী আদালতকে ভুলভাবে বুঝিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
অন্যদিকে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার (ব্র্যান্ড) কাজী মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘মামলার বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। এগুলো সব ভুয়া।’
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া বলেন, ভেজাল ও মানহীন খাদ্যপণ্য বন্ধে প্রতি মাসে প্রায় ১৫০টি স্যাম্পল সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। কোনো পণ্য ভেজাল পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদকের ঘোষণার সঙ্গে পণ্যের উপাদান মেলে না। এসব ক্ষেত্রে উৎপাদককে সতর্ক করা হয় এবং ৩ থেকে ৬ মাস মানোন্নয়নের সময় দেওয়া হয়। এরপরও উন্নতি না হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, শিশুখাদ্যের বেশির ভাগই নকল বা ভেজালযুক্ত। এসব মুখরোচক খাবারের মধ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ খাদ্যদ্রব্যও বিক্রি হচ্ছে। বিদেশ থেকে এসব খাদ্যপণ্য আমদানি করা হয় ঠিকই। তবে মেয়াদের যে সময় থাকে তা বাড়িয়ে দেওয়া হয় কয়েক গুণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার বিষের মতো। তাই এসব খাদ্য গ্রহণ করলে শিশুদের মারাত্মক রোগের ঝুঁকি কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
শিশুখাদ্যে অতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারেও শিশুরা জটিল রোগাক্রান্তসহ মরণব্যাধি ক্যানসারেও আক্রান্ত হচ্ছে। খাদ্যের মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারের ফলে প্রাপ্তবয়স্কসহ শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে ক্যানসারে।
২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের খাদ্য কর্তৃপক্ষের এক নমুনা পরীক্ষা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৩০ পণ্যের ১৫২ নমুনা পরীক্ষা করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে নমুনা পরীক্ষার ২৬ শতাংশ খাদ্যের অতিমাত্রায় রাসায়নিক কেমিক্যালের উপস্থিতি রয়েছে। কেমিক্যাল পাওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে অধিকাংশ পণ্যই শিশুখাদ্য।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, এসব খাবার গ্রহণ করা শিশুরা নানা জটিল রোগে ভুগছে। দিন দিন এর হার বাড়ছে। তিনি বলেন, অতিমাত্রার কেমিক্যালযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করে আমাদের উল্লেখযোগ্য শিশু গ্যাসট্রিকের সমস্যায় ভুগছে। কেমিক্যালযুক্ত খাদ্য গ্রহণে শিশুদের পাকস্থলী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং এসব শিশুরা গ্যাসট্রিক, শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, কিডনি, লিভার, থাইরয়েড, হরমোনজনিত সমস্যায় ভুগছে। দেশে প্রচুর কিডনি রোগী পাওয়া যাচ্ছে যাদের বয়স অনেক কম এবং এসব খাবার দীর্ঘ সময় গ্রহণ করার ফলে শিশুরা ক্যানসারের মতো রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
কী রয়েছে কিটক্যাট চকলেটের বিরুদ্ধে মামলায় :
নিম্নমানের কিটক্যাট চকলেট বাজারজাতের অভিযোগে আগেই একটি মামলা চলছে। ওই মামলায় কিটক্যাটের আমদানিকারক সুমাইয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. মোজাম্মেল হোসাইনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় তার বিরুদ্ধে আদালত ইতোমধ্যেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
মামলার তদন্তে নেসলে বাংলাদেশের আমদানিকৃত কিটক্যাট চকলেটের নমুনা ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় নিম্নমানের প্রমাণ মেলে। নতুন অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, এবার নেসলে বাংলাদেশের আমদানিকৃত কিটক্যাট চকলেটের নমুনায়ও মানহীনতা পাওয়া গেছে।
ফ্রেশ চিনির বিরুদ্ধে মামলায় কী রয়েছে :
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, স্বপ্ন এসিআই লজিস্টিকস লিমিটেডের মধ্য বাসাবো শাখায় পরিদর্শনের সময় ‘ফ্রেশ রিফাইন সুগার’ ভেজাল ও অনিরাপদ সন্দেহে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরীক্ষায় চিনিটি মানসম্মত না পাওয়ায় নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩-এর ২৩ ও ২৬ ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে নালিশি মামলা করা হয়, যা একই আইনের ৫৮ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
গত ১০ নভেম্বর মধ্য বাসাবো এলাকা থেকে ফ্রেশ চিনির নমুনা সংগ্রহ করেন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর কামরুল হাসান। পরে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের খাদ্য বিশ্লেষক ইলিয়াছ জাহেদী স্বাক্ষরিত সনদে জানানো হয়, ‘ফ্রেশ রিফাইন সুগার’ মানসম্পন্ন নয়।
নিরাপদ খাদ্য আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কার্যক্রম শেষে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে কামরুল হাসান অভিযোগপত্র দাখিল করেন বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতের স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে।
এসএ গ্রুপের গুঁড়া দুধে এক-চতুর্থাংশ প্রোটিন :
নিম্নমানের গুঁড়া দুধ বিক্রির অভিযোগে এসএ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মো. শাহাবুদ্দিন আলমের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। গত সোমবার ‘গোয়ালিনী ডেইলি ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার’-এর মামলার শুনানিতে এ পরোয়ানা জারি করেন ম্যাজিস্ট্রেট নুসরাত সাহারা বীথি।
পণ্যে ‘ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার’ লেখা থাকলেও পরীক্ষায় নির্ধারিত মানের ন্যূনতম চর্বিও পাওয়া যায়নি। প্রোটিন ৩৪ শতাংশ থাকার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে মাত্র ৯.৫ শতাংশ। ল্যাব রিপোর্ট অনুযায়ী, দুগ্ধ চর্বির মান থাকা উচিত ন্যূনতম ৪২ শতাংশ; সেখানে পাওয়া গেছে মাত্র ৭.৫৮ শতাংশ। বিডিএস মান অনুযায়ী প্রোটিন ৩৪ শতাংশ থাকার কথা, পাওয়া গেছে মাত্র ৯.৫০ শতাংশ।
এ কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর কামরুল হাসান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, নমুনা সন্দেহ হলে ৬৫০ টাকা দিয়ে ১ কেজি গোয়ালিনী ডেইলি ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। ২০২৫ সালের ২১ অক্টোবর পাওয়া রিপোর্টে পণ্যটি মানসম্মত নয় বলে সনদ দেওয়া হয়।
মামলাটি গত ৩ নভেম্বর আদালতে আমলে নেওয়া হয়। এজাহারে এসএ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মো. শাহাবুদ্দিন আলমকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। কোম্পানিটি বাংলাদেশে গোয়ালিনী ডেইলি ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার মোড়কজাত ও বাজারজাত করে আসছে।
কেকে/এমএ