বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে একসময় ছিল বিশ্বে প্রশংসিত উদাহরণ। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হওয়া প্রবৃদ্ধিনির্ভর দারিদ্র্য বিমোচনের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা দীর্ঘকাল দেশের অর্থনীতির আশাবাদ জুগিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্য উদ্বেগজনক বাস্তবতা তুলে ধরছে- বাংলাদেশ এখন দারিদ্র্য কমার পরিবর্তে বারো বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। সংখ্যায় তা দাঁড়ায় প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। এ বিপর্যয় কোনো হঠাৎ ঘটনা নয়; ২০২২ সাল থেকে দারিদ্র্যের হার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এ বাস্তবতার মূলে রয়েছে একাধিক কাঠামোগত সমস্যা।
সর্বপ্রথম, কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি মারাত্মকভাবে কমে গেছে। ২০২৩-২৪ সালে ২০ লাখ কর্মসংস্থান কমে গেছে, ২০২৫ সালে আরো ৮ লাখ কমার আশঙ্কা রয়েছে। প্রবৃদ্ধির কাঠামো বদলেছে; উৎপাদনশীল খাতে নতুন চাকরির বদলে কৃষি খাতে কম আয়ের কর্মসংস্থানই বেড়েছে। শহরে চাকরির বাজার প্রায় স্থবির। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও তরুণরা- যারা দেশের ভবিষ্যৎ শ্রমবাজারের ভিত্তি। তার ওপর উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘ সময় ধরে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবনকে চাপে ফেলেছে। আয় না বাড়লেও খরচ বেড়েছে; ফলে জনসংখ্যার বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকলেও সামান্য অভিঘাতেই তারা নিচে নেমে যাচ্ছে।
২০২২ সালে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ২০ লাখ- যা দেশের অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার বড় প্রমাণ। আরেকটি গুরুতর সমস্যা হলো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির দুর্বলতা। রাষ্ট্রীয় সহায়তা যে গরিবদের সহায় হওয়ার কথা, সেটাই তুলনামূলক বেশি যাচ্ছে সচ্ছল পরিবারগুলোর কাছে। সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশ পরিবারের মাত্র অর্ধেক এই সহায়তা পেয়েছে; বিপরীতে সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ পরিবারের ৩৫ শতাংশও সুবিধাভোগী।
উপকারভোগী বাছাইয়ের দুর্বলতা এবং ভর্তুকি ব্যবস্থার ত্রুটিই এই বিপর্যয়ের কারণ। ফলে বৈষম্য কমার বদলে আরও জোরদার হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিও উপেক্ষা করার মতো নয়। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে, কৃষি খাতের উৎপাদন কমে যেতে পারে এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। যারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতেÑ গ্রামীণ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী- তারা হবে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত। এ পরিস্থিতি নিছক একটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নয়; এটি একটি নীতিগত ব্যর্থতার প্রতিফলন। বিশেষজ্ঞরা তিনটি সময়কাল উল্লেখ করেছেন- ২০১০-১৬ ছিল পুরোনো গতিময়তার ধারাবাহিকতা; ২০১৬-২২-এ গতি কমে; আর ২০২২-২৫-এ সময়কাল ‘উল্টো ঘুরে যাওয়ার’।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, নীতির অগ্রাধিকারের ভুল নির্বাচন ও অনিয়ম এই মোড়বদলের বর কারণ। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের চারটি সুপারিশ বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক : উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, শোভন কাজের সুযোগ বিস্তার, গ্রামীণ দরিদ্রদের বাজারে প্রবেশাধিকারের উন্নয়ন এবং সমতাভিত্তিক রাজস্বনীতি।
এগুলো বাস্তবায়ন করা ছাড়া দারিদ্র্য হ্রাসের পুরোনো অগ্রযাত্রা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। কর্মসংস্থান তৈরির মতো ভিত্তিগত সংস্কার ছাড়া, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া এবং সামাজিক সুরক্ষার সঠিক বণ্টন নিশ্চিত করা ছাড়া দারিদ্র্যের এই উল্টো যাত্রা থামানো যাবে না। দশকের পর দশক ধরে অর্জিত সাফল্য ধরে রাখতে হলে এখনই শক্ত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য প্রয়োজন অর্থনীতিসহ দেশের সামগ্রিক অবকাঠামোর সংস্কার না হলে দারিদ্র্য বৃদ্ধির এ ধারা আগামী প্রজন্মের জন্য আরো বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
কেকে/এমএ