এশিয়ায় চীনের প্রভাব নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারী। বিশাল ভূখণ্ড, ভৌগোলিক সংলগ্নতা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং বিশ্বব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান সক্রিয় ভূমিকা- এসবই আধুনিক চীনের শক্তি-প্রতিপত্তির স্বাভাবিক ভিত্তি রচনা করেছে। বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আজ চীন এক অনিবার্য শক্তি। আশির দশকের শেষভাগে দেং শিয়াওপিংয়ের সংস্কার নীতির পর সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর আবরণে পুঁজিবাদী অর্থনীতির যে উত্থান ঘটল, তা এক প্রবল ঢেউয়ের মতো এশিয়া অতিক্রম করে বিশ্বমঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে।
বিস্ময়কর উন্নয়ন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার এবং শক্তির প্রসারণ- সব মিলিয়ে চীন আজ যেমন সম্ভাবনার উৎস, তেমনি বৈশ্বিক উদ্বেগেরও কেন্দ্রবিন্দু।
অবশ্য আধুনিক চীনের দূরদর্শী নেতা দেং শিয়াওপিং এ দ্বৈত বাস্তবতা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে অনুধাবন করেছিলেন বলেই রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় উচ্চারণ করেছিলেন- ‘ক্ষমতা আড়াল করো, সময়ের অপেক্ষায় থাকো।’ কারণ বড় রাষ্ট্রের নৈকট্যে ছোট ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলো স্বভাবতই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে; তাই বৃহৎ শক্তিকে হতে হয় সংযত, পরিমিত এবং সদ্ভাবাপন্ন। দেং এ সত্য অনুধাবন করেই চীনের পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু সময়ের প্রবাহে, বিশেষত হু চিনতাও-এর শাসনামলের শেষভাগে এসে দেংয়ের সেই প্রজ্ঞা যেন প্রায় বিস্মৃত হয়ে পড়ল। বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে চীন ক্রমেই শক্তির প্রকাশে মনোযোগী হয়ে ওঠে; সামরিক শক্তিও পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পায়। ফলে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসহ বিশ্বব্যবস্থায় চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি, প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে তার উত্থান- এসবই যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর সঙ্গে নতুন দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত দেয় এবং ভবিষ্যৎ-উদ্বেগ আরো ঘনীভূত করে।
২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পশ্চিমা বিশ্বকে দুর্বল করে দিলে চীনের উত্থান আরো ত্বরান্বিত হয়। সে সময় চীনের জিডিপি প্রায় ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার- যা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। ২০০০ থেকে ২০২১- দুই দশকের ব্যবধানে বৈশ্বিক জিডিপিতে চীনের অংশীদারির ঊর্ধ্বগতি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে এক লাফে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়।
চীনের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সাফল্য নিয়ে জার্মান অর্থনীতিবিদ ইসাবেলা ওয়েবার তার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হাউ চায়না এসকেপড শোক থেরাপি : দ্যা মার্কেট রিফর্ম ডিবেট-এ যথার্থই লিখেছেন, ‘চীনের নির্বাচিত মূল্য-উদারীকরণ নীতি তাদের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।’ কারণ পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত-উত্তর দেশগুলোর মতো রাতারাতি অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন তথা ‘শক থেরাপি’ (যা বহু দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পেছনে দায়ী) গ্রহণ না করে চীন বেছে নেয় এক ‘দ্বৈত-ধারা ব্যবস্থা’ বা ডুয়েল ট্র্যাক সিস্টেমের মানে ‘ভারী শিল্পটি ধরো, হালকাটি ছাড়ো।’ অর্থাৎ ইস্পাত, বিদ্যুৎ, পেট্রোকেমিক্যাল, পরিবহন প্রভৃত কৌশলগত খাত পরিকল্পিত অর্থনীতির অধীনেই রেখে রপ্তানিমুখী হালকা শিল্পে ধীরে-সুস্থে উদারীকরণের সুযোগ দেওয়া হয়- যা পুরো অর্থনীতিকে ঝাঁকুনিবিহীনভাবে বাজারব্যবস্থার উপযোগী করে তোলে। বিশ্বায়নের সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চীন যে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করেছে, তা মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথায় পরিণত হয়েছে। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ‘এই দশকের কোনো এক বছরে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করবেই।’
বিপুল অর্থসম্ভার নিয়ে চীন আজ ইন্দো-প্যাসিফিক থেকে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ, মধ্য এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বহুদেশে বিনিয়োগ বিস্তার করেছে। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায়, বিশেষত ইন্দো-প্যাসিফিকে, যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত কোয়াড; অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিপাক্ষিক সামরিক জোট অকাস; মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রত্যয়ে প্রণীত বার্মা অ্যাক্ট; আর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের পুরোনো মিত্রদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারের উদ্যোগ-সব মিলিয়ে এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলেরই পরিপূর্ণ প্রকাশ, যার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য চীনের অগ্রযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে আনা।
বিপরীতে, চীনও বসে নেই। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)’ ঘোষণার মাধ্যমে প্রাচীন সিল্ক রোডের আদলে এক বিরাট অবকাঠামোগত যোগাযোগ মহাপরিকল্পনা শুরু করেন, যা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপকে সড়ক, রেল ও নৌপথের মাধ্যমে সংযুক্ত করবে। চীনের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে ১৪৬টি দেশ ও ৩২টি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিআরআই-এর সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
পাশাপাশি, উদীয়মান অর্থনীতির দেশ : ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত ব্রিকস এবং তার অধীন নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এসবই আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো মার্কিন ও পশ্চিমা প্রভাবিত আর্থিক কাঠামোর সমান্তরালে এক নতুন বৈশ্বিক আর্থিক বিকল্প নির্মাণে চীনের প্রচেষ্টা। চীনের এ বহুমুখী উদ্যোগ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে নতুন এক মেরুকরণের আবহ সৃষ্টি করেছে, যাকে অনেকেই ‘একবিংশ শতাব্দীর স্নায়ুযুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবী দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল- একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী বিশ্ব, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বলয়। মার্কিন সোভিয়েত এ মতাদর্শিক লড়াই ইতিহাসে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ পরিচিত। তবে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও শীতল যুদ্ধের অবসানের পর যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিল, আর কোনো শক্তিই তার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না এবং সে একক পরাশক্তি হিসেবেই বিশ্বপরিসর নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু ২০০১ সালে চীনের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগদান এবং তাকে ঘিরে অভূতপূর্ব ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উত্থান চীনকে নতুন এক পরাশক্তি রূপে অভিষিক্ত করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রও বাধ্য হয় পশ্চিমের পাশাপাশি পূর্ব, তথা প্রাচ্যেও তার কৌশলগত মনোনিবেশ বাড়াতে।
যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন সাম্রাজ্য নিজেই আজ অবক্ষয়ের মুখে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতির পুনঃপ্রবর্তন করেন এবং চীনের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি শুল্কযুদ্ধে নেমে পড়েন; যদিও পরবর্তী সময়ে দুই দেশের পারস্পরিক নির্ভরতার বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকখানি পিছু হটতে হয়। ফলে চীনকে আটকে দেওয়ার বহুমাত্রিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ওয়াশিংটন এখন পর্যন্ত তেমন সাফল্য পায়নি।
অন্যদিকে, চীনও ধরে নিয়েছে- মার্ক্স যে পশ্চিমের পতনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তার বাস্তবায়ন যেন এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র; বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের অন্তঃক্ষয় তাদের কাছে অনিবার্য বলেই মনে হয়। এ অতিরিক্ত আত্মপ্রত্যয় চীনকে এমন এক ভূরাজনৈতিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে, যেখানে তার শক্তি অস্বীকার্য হলেও সমগ্র এশিয়া এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার ছায়ায় আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। যেমন ২০১০ সালে হ্যানয়ে আসিয়ান সম্মেলনে চীনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং জিয়েছি এক অবাক করা ঔদ্ধত্যে বলেছিলেন- চীন তো বড় দেশ, আর বাকি দেশগুলো ছোট- এটাই সত্য। কথাটা ছুড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ চীন সাগর ঘিরে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি বেইজিংয়ের আধিপত্যশীল মনোভাব স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনা সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট চিন্তক ঝেং বিঝিয়ান মার্কিন জার্নাল ফরেইন অ্যাফেয়ার্সে প্রকাশ করেন এক ঐতিহাসিক নিবন্ধ ‘চায়না’স পিসফুল রাইজ টু গ্রেট-পাওয়ার স্টাটাস’ এরপর থেকেই চীনা পররাষ্ট্রনীতিতে ‘শান্তিপূর্ণ উত্থান’ শব্দযুগল পরিণত হয় মূল সুরে। যদিও পরবর্তী সময়ে ‘উত্থান’ শব্দটি কিছুটা উদ্ধত শোনায় বলে সরকার তা বদলে দিয়ে ‘উন্নয়ন’ শব্দটিকে প্রতিষ্ঠা করে। কারণ বেইজিং বুঝতে পেরেছিল- যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রশক্তির সঙ্গে বৈরিতা বাড়লে চীনের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। কিন্তু ২০১২ সালে শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর ‘শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন’-এর ভাষা ধীরে ধীরে কূটনৈতিক অভিধান থেকে মিলিয়ে যায়; তার জায়গায় আবির্ভূত হয় নতুন স্লোগান-‘পূর্ব উঠছে, পশ্চিম নামছে।’ এ আত্মবিশ্বাসই চীনকে আরো দৃপ্ত, আরো আগ্রাসী করে তোলে। দক্ষিণ চীন সাগর ছাড়াও হংকং, পূর্ব চীন সাগর, তাইওয়ান প্রণালি, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নীতিনির্ধারণ, এমনকি হিমালয়ের বুকেও সেই একই কঠোরতা দৃশ্যমান হয়। ফলে এশিয়াজুড়ে বাড়তে থাকে চীন উদ্বেগের রেখা।
বিশেষত, দক্ষিণ-চীন সাগরের প্রায় ৯০ শতাংশ মালিকানা নিজেদের বলে দাবি করে চীন। আর এ সাগরজুড়ে রয়েছে রয়েছে বিপুল খনিজ তেল ও গ্যাসের ভান্ডার। ধারণা করা হয়- দক্ষিণ চীন সাগরে তেলের মজুত প্রায় ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ব্যারেল, আর গ্যাসের রিজার্ভ প্রায় ১৯০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। শুধু তাই নয়, এ অগভীর নীল জলরাশিতে লুকিয়ে আছে অসীম সামুদ্রিক প্রাণিজ সম্পদ। পৃথিবীর মোট প্রাণবৈচিত্র্যের এক-তৃতীয়াংশই এখানে অবস্থান করছে। বিশ্বের মোট মাছের উৎপাদনেরও প্রায় ছয় ভাগ আসে এ সাগর থেকে। এ ছাড়া দক্ষিণ-চীন সাগরের গুরুত্ব বেড়েছে তার অনন্য ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও। এটি বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম সমুদ্রপথ; বৈশ্বিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই এই পথ ধরে সম্পন্ন হয়। চীন, জাপান, কোরিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ামুখী বাণিজ্যের জন্য এ পথ এক কথায় জীবনরেখা।
গত তিন দশকে, বিশেষত ভিয়েতনাম যুদ্ধপরবর্তী সময়কালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যথাযথ মনোযোগ না পাওয়ায় এ অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিঃশব্দে ঘটে গেছে। মূলত এ সময়ের মাঝেই চীনের উত্থান হয়েছে। আর সেই উত্থানকে কেন্দ্র করেই বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি দিনদিন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সিঙ্গাপুর বরাবরই দৃঢ় ভাষায় জানিয়ে এসেছে যে এশিয়ায় আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অনিবার্য। সেই বিবেচনায় ১৯৯০ সালে দেশটি মার্কিন সামরিক বাহিনীকে তাদের কিছু সামরিক স্থাপনা ব্যবহারের অনুমতি দেয় এবং এ সম্পর্কে একটি সমঝোতা স্মারকেও সই করে। তবে আসিয়ানের দেশগুলো এ চুক্তিকে স্বাগত জানাতে পারেনি; বরং তারা এর প্রতি স্পষ্টতই বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। কারণ এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো নানা উপায়ে চীনের ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল, পাশাপাশি চীনের সঙ্গে তাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কও অত্যন্ত গভীর।
২০২৪ সালে আসিয়ানের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৯৮২ বিলিয়ন ডলার। ফলে চীনের সঙ্গে নানা মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আসিয়ানের রাষ্ট্রগুলো এ অঞ্চলে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো উত্তেজনা প্রত্যাশা করে না। কেননা, বিংশ শতাব্দীতে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা এ দেশগুলোর ওপর যে গভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছে তা এখনো ভুলার মতো নয়।
অবশ্যই অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক রাজনীতির জটিলতার কারণে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কতটা ঘনিষ্ঠ হবে, কিংবা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কত দূর এগোবে- তা তারা প্রায়ই স্বীকার করতে অনিচ্ছুক। তবু পর্দার আড়ালে সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ, মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজের বন্দর–সংযোগ, ঘাঁটি ভাগাভাগি- যেমন ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুরে থাকা মার্কিন সামরিক স্থাপনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের মধ্য দিয়ে বহু দেশ নীরবে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিস্তৃত করে চলেছে। পাশাপাশি, আসিয়ান-যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সম্পর্কও সুদৃঢ়। ২০২৪ সালে আসিয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ছিল ৪৭৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সঙ্গে আসিয়ানের বাণিজ্য যোগ করলে পশ্চিমা ব্লকের সঙ্গে মোট বাণিজ্যের অঙ্ক ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এর অর্থ দাঁড়ায়- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক ঝোঁক মোটেই চীনের দিকে একমুখী নয়। বিশেষত ভিয়েতনাম-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বরফগলা এবং ইন্দোনেশিয়ার নিরপেক্ষতার নীতি থেকে বহুমুখী সম্পর্কে অভিযোজনÑএসবই আঞ্চলিক শক্তিসাম্যের স্বাভাবিক পরিণতি।
এদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরেকটি দেশ ইন্দোনেশিয়া এক দৃঢ় জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রÑসোভিয়েত ইউনিয়ন, মাওবাদি চীন, শীতল যুদ্ধের যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপ- কেউই তাদের পথ বাঁকাতে পারেনি। ভিয়েতনামও সমভাবে জাতীয়তাবাদী। ফলে এ দুই রাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা চীনের জন্য প্রায় অসম্ভব। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তি ভারতও চীনের মতোই প্রাচীন ও জনবহুল; সে কোনোদিনই ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেবে না। এমনকি পাকিস্তান, লাওস ও কম্বোডিয়ার মতো দেশ- যাদের ওপর চীনের প্রভাব প্রকট। সেখানকার সাধারণ মানুষের মনোভাব প্রায়শই সরকারের অবস্থান থেকে পৃথক।
উপরন্তু, সাম্প্রতিক ব্রিক্সও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত; ভারত চীনকে সন্দেহের চোখে দেখে, মিশর পশ্চিমের ওপর নির্ভরশীল- রাশিয়া ও ইরান ছাড়া চীনের পশ্চিমবিরোধী মনোভাব সত্যিকার অর্থে কেউই ভাগ করে না। এ বৃহত্তর প্রেক্ষাপটেই বোঝা যায়Ñচীনের উচ্চাভিলাষী আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের স্বপ্ন এখনো বাস্তবায়নের পথে বহু বাধা-বিপত্তিতে ঘেরা।
কেকে/এমএ