বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫,
১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: নির্বাচনী জোটের আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে : রাশেদ খান      গণতন্ত্র ফেরাতে নির্বাচনের বিকল্প নেই : আমান      সিসিইউতে খালেদা জিয়া      নিজের গড়া ট্রাইব্যুনালে হাসিনার বিচার হচ্ছে : রিজভী      প্লট দুর্নীতির মামলায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফের ১৮ বছর কারাদণ্ড      প্লট দুর্নীতি : জয়-পুতুলের পাঁচ বছর কারাদণ্ড      শেখ হাসিনার ২১ বছরের কারাদণ্ড      
বিবিধ
বাংলার বাউল
খোলা কাগজ
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৫, ১:৪২ পিএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

বাংলার বাউল গান

বাউল গান হলো বাউল সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক সংগীত। বাউলরা মূলত দেহতত্ত্বাশ্রিত ও আধ্যাত্মমুখী একটি লৌকিক ধর্মমত (বাউল ধর্মমত) পোষণ করেন, যার কোনো লিখিত সাহিত্য বা শাস্ত্র নেই। বাউলরা তাদের ধর্মীয় তত্ত্ব ও দর্শন, জীবনবোধ ও আদর্শের কথা গানের ভাষায় প্রকাশ করেন এবং এ মৌখিক ধারার গানকেই বাউলসংগীত বলা হয়। তারা গানকে তাদের ধর্মসাধনার অঙ্গ মনে করেন এবং ধর্মীয় আসর, ওরস উৎসব ও ভিক্ষোপজীবিকার মতো আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক উপলক্ষে গান পরিবেশন করে ধর্মকর্ম পালন করেন। 

ছবি খোলা কাগজ

ছবি খোলা কাগজ


বাউল সাধনার মূল লক্ষ্য হলো দেহতত্ত্বের সাধনা দ্বারা পরমাত্মার (যাকে মনের মানুষ, অচিন পাখি, মনুরায় ইত্যাদি প্রতীক দিয়ে অভিহিত করা হয়) সন্ধান করা। তারা বিশ্বাস করেন, এ পরমাত্মা মানবদেহে বাস করেন । মানবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন সাধনই তাদের দেহসাধনার মূল লক্ষ্য, যা অধ্যাত্মপ্রেম বা ভক্তি দ্বারা সম্ভব। বাউলদের দেহকেন্দ্রিক এই সাধনা গুরু-নির্ভর; দীক্ষা নিয়ে যোগাদি সাধনা ও আচার পালন করতে হয়। বাউল গান মূলত দেহ, আত্মা, পরমাত্মা, গুরু, প্রেম-ভক্তি, সৃষ্টিরহস্য ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। এরই সূত্র ধরে আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, মানুষতত্ত্ব বাউল গানে স্থান পেয়েছে। 

বাউলদের বিশ্বাস :
নিজেকে জানলেই সেই পরম পুরুষকে জানা যায়। লালন শাহের ভাষায়- ‘আপনারে চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা’।

মন রে, তুমি কৃষিকাজ জান না। /এমন মানব জমিন রইল পড়ে,/চাষ করলে ফলত সোনা।
লালন শাহ মানবদেহ ও মানবজীবনকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। তার উক্তি : ‘শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই/দেব-দেবতাগণ করে আরাধন/জন্ম নিতে মানবে’। তিনি জাতিভেদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউলদের এই জাতি, ধর্ম ও বর্ণভেদমুক্ত জীবনবোধকে ‘মানবধর্ম’ বলে উল্লেখ করেছেন। 

বাউল গানের স্রষ্টা হিসেবে লালন শাহকে (১৭৭৪-১৮৯০) অভিহিত করা হয়। তার জন্মস্থান কুষ্টিয়ার ভাড়রা গ্রাম বা যশোরের হরিশপুর গ্রাম । কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় আস্তানা গেড়ে তিনি সাধক জীবন কাটান এবং সেখানে বাউল সম্প্রদায়কে সংগঠিত করেন। লালন আনুমানিক দুই থেকে আড়াই হাজার গান রচনা করেন। দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহ, পাগলা কানাই প্রমুখ তার যোগ্য শিষ্য ছিলেন, যারা লালনকে অনুসরণ করে বাউল গান রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন ও গগন হরকরার গান সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন । পাগলা কানাইয়ের শতাধিক গান সংগৃহীত ও সম্পাদিত হয়েছে।

প্রধান বাদ্যযন্ত্র হলো একতারা। এ ছাড়া কোনো কোনো বাউল কোমরে বাঁয়া বাঁধেন। বাউল গান, নাচ ও বাদ্যের সমন্বয়ে এক স্বতন্ত্র আবেগ ও সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। এটি ভাটিয়ালি অঙ্গের এবং কীর্তনের টানা ও লঘু সুরের মিশ্র আঙ্গিকে রচিত হয়।

বাউল গানের কেন্দ্র-ভূমি বাংলাদেশের কুষ্টিয়া। কালক্রমে তা যশোর, ফরিদপুর, পাবনা, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট পর্যন্ত এবং পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, বর্ধমান ও বীরভূম জেলায় বিস্তার লাভ করেছে।

বাউল গানকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি বড় উপাদান হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাউল গানের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও সংগিত-মাধুর্য বিশ্ববাসীর মন জয় করেছে। সম্প্রতি ইউনেস্কো বাউল গানকে মানবজাতির ঐহিত্যের স্মারক রূপে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে এ গানের চর্চা শুধু বাউল সাধকদের মধ্যে সীমিত নেই, এটি দেশের সব শ্রেণির শিল্পী ও বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে।

আঠারো শতকের বাউল ও আউল আন্দোলন

আঠারো শতকের নবদ্বীপ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক্তিয়ারে। দক্ষিণ দেশ থেকে কট্টর দ্রাবিড় বৈষ্ণব ভক্ত তোতারাম এসেছেন নবদ্বীপে ন্যায়শাস্ত্র পড়তে। নবদ্বীপে চৈতন্যের আমলের ন্যায়চর্চার অক্ষত ধারা না থাকলেও তখনো শ্রুত গৌরব অক্ষত; রমরম করে চলছে ন্যায়চর্চার টোল তোলারাম এ টোলে পড়তে পড়তেই বৈষ্ণবতার ছোঁয়া মাখলেন। গায়ে, আর পর পরই সাধন ভজন করতে ছুটলেন কৃষ্ণের দেশ বৃন্দাবনে।

বৃন্দাবনে বসেই তোতারাম বাবাজি খবর পেলেন বাংলার বৈষ্ণবতায় শাস্ত্রিক আচারে ধস নেমেছে, লোকধর্মের নানা শাখায় গৌড়ীয় বৈষ্ণবতা বিপন্ন। তিনি ছুটে এলেন নবদ্বীপে বৈষ্ণবীয় ভজনে শাস্ত্রিক শুদ্ধাচারের বাণী শোনাতে। পেলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দাক্ষিণ্য। ছয় বিঘা নিষ্কর জমিতে পত্তন করলেন আখড়া। তার আখড়াতেই চর্চিত হতে থাকল নৈষ্টিক বৈষ্ণব ধর্ম। নবদ্বীপ তথা বাংলায় তখন নানা বৈষ্ণব উপ-সম্প্রদায়ের স্রোত, সহজিয়া মত, কায়াবাদী সাধনার রমরমা। জাতপাত, উচ্চনীচ, অধিকারী-অনধিকারী বিচারের গৌড়ীয় বৈষ্ণবতাই হাড়ি, ডোম, বাগদি, বাউরি, ঘোষ, পাল, দাস, রুইদাস, কাঁসারি, শুড়ি, ধোপা, ঘুগী, কলু, কপালী, মাঝি, মালো, রাজবংশী, পোদ, কাহার, চণ্ডাল, বেলদার, কোরা, বাগদী, বাড়ুই, করণ, গাঁড়ল, ভূঁইয়া, চামার, মাল, বেদে, বুনোদের পৃথক এক ধর্মীয় আচারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। যেখানে এলে ধর্মচর্চা, শাস্ত্রচর্চা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার অধিকারী পুরোহিত বা ব্রাহ্মণশ্রেণির উৎপাত বা শোষণ নেই। বৈষ্ণব উপ-সম্প্রদায়ের স্রোতে, সহজিয়া মতে, কায়াবাদী সাধনায় পুরোহিত নেই কোনো, গুরু আছেন। তবে তিনি ব্রাহ্মণ মন্ত্র-দীক্ষাদাতা গুরুও নন, তিনি যেমন শূদ্র, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে নারীও বটে।

ছবি খোলা কাগজ

ছবি খোলা কাগজ


জনবিন্যাসের এই বিচিত্রতায় বৃহত্তর লোকায়ত সমাজ তখন বাঙালির শাস্ত্রিক বিধির বাইরে। তারা ইহজীবন, দেহ আর দৃশ্য মানুষের ভজনা করে খালি। জাত, লিঙ্গ, সাম্প্রদায়িক সীমানা, পরলোক, পূর্বজন্ম, পুনর্জন্ম, ব্রত, পুজো, রোজা- এইসব অনুমানে তাদের বিশ্বাসীই নেই। তারা বর্তমানপন্থি, ‘যা আছে দেহভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে’-এই তাদের সিদ্ধান্ত। প্রকৃতির সকল গুপ্ত শক্তির সঙ্গে শরীরের গুপ্ত শক্তির যোগাযোগ নিয়েই তাদের দেহতত্ত্বের সাধনা পুষ্ট। যে সাধনাতে মানুষই হল গিয়ে অন্বিষ্ট। সাধনসঙ্গী-সঙ্গিনী গুরু ইষ্ট, আর দেহ শরীর হল গিয়ে বেদ-কোরান।

বৃহত্তর এই জনগোষ্ঠীর এমন অবৈদিক-বেদবিরোধী বা লিখিত শাস্ত্র অমান্য করার কায়াবাদী-আচরণমূলক ধর্ম দেখে তোতারাম বাবাজি ভীষণ চিন্তিত হয়ে শেষমেশ নিদান হাঁকলেন :

আউল বাউল কর্তাভজা নেতা দরবেশ সাঁই।
সহজিয়া সখী ভাবকী স্মার্ট জাত গোঁসাই॥
অতি বড়ী চূড়াধারী গৌরাঙ্গ নাগরী।
তোতা কহে এই তেরোর সঙ্গ না করি॥

উচ্চবর্ণের সমাজপতি বা ধর্মগুরুর এই নিদানই বলে দিচ্ছে আঠারো শতকে হঠাৎ গজানো বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল শাস্ত্র মান্যতার ধর্মকে কতখানি বেগ দিয়েছিল। উনিশের শেষ পাদে ১৮৮২ নাগাদ দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ ঠাকুর পর্যন্ত চিন্তিত তার ওখানে যাতায়াত করা ভক্ত হরিপদর ধর্ম নিয়ে। কেননা হরিপদ ঘোষপাড়ার কর্তাভজা ধর্মের এক ‘মাগীর’পাল্লায় পড়েছে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে বৌদ্ধিক আসরেও বেগ দিচ্ছে কর্তাভজা ও বাউল ধর্ম। কেননা ঠাকুর বাউল ধর্ম নিয়েও উদ্বিগ্ন; পায়খানার দরজা’ দিয়ে প্রবেশ করা পথ বলে তিনি একেও টিপ্পনী কাটছেন। দাশরথি রায়ও ফুট কাটছেন-

নূতন উঠেছে কর্তাভজা শুন কিঞ্চিৎ তার মজা
সকল হতে শ্রবনে হয় মিষ্ট
বাল বৃদ্ধা যুবা রমণী নিষেধ মানে না যায় অমনি
অন্ধকারে পথ হয় না দৃষ্ট।

আর বাংলা সাহিত্যের প্রধান ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ শতক শেষে ১৮৯৫ সালে রানাঘাটের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কবি নবীনচন্দ্র সেনের কর্তাভজা মেলায় পৌরহিত্য করবার কথা শুনে রীতিমতো আঁতকে উঠে বলে ফেললেনÑ

শুনিয়াছি উহা বড় জঘন্য ব্যাপার।

এইসব নিদান, টিপ্পনী, খোঁচা, উদ্বেগ, ব্যভিচারের তর্জনী নির্দেশই বলে দিচ্ছে আঠারোর শেষ থেকে শুরু হওয়া কর্তাভজা ধর্মসহ আউল, বাউল, সাঁই, দরবেশ, সহজিয়া মত উচ্চবর্ণের সমাজকে বেগ দিচ্ছে। আর নিম্নবর্গীয়রা সংস্কৃত মেশানো মন্ত্র না বানিয়ে একেবারে বাংলায় মন্ত্র পড়ছেন, তত্ত্বকথা বলছেন, মধুস্রারী সংগীত রচনা করছেন এমনই এক ভাষায় যার গ্রহ্যাবয়ণ ভেদ করতে গিয়ে এখনকার গবেষকদেরও মুনিদত্তের পথ ধরতে হয়েছে।

কর্তাভজারা বললেন-
কৃষ্ণচন্দ্র গৌরচন্দ্র আউলচন্দ্র
তিনেই এক একেই তিন।
সাহেবধনীরা বললেন-
সেই ব্রজধামের কর্তা যিনি
রাই ধনী সেই নামটি শুনি
সেই ধনী এই সাহেবধনী।
হাড়িরামী-বলরামীরা বললেন-
হাড়িরাম তত্ত্ব নিগূঢ় অর্থ বেদান্ত ছাড়া।
করে সর্ব ধর্ম পরিত্যাজ্য সেই পেয়েছে ধরা॥
ওই তত্ত্ব জেনে শিব শ্মশানবাসী।
সেই তত্ত্ব জেনে শচীর গোরা নিমাই সন্ন্যাসী॥
বীরভদ্রপন্থীরা বললেন-
বীরচন্দ্ররূপে পুনঃ গৌর অবতার।
যে না দেখেছে গৌর যে দেখুক এবার।
লালনশাহীরা বললেন-
গুরু ছেড়ে গৌর ভজে
তাতে নরকে মজে।
সহজিয়া বৈষ্ণবরা বললেন-
যে রাধাকৃষ্ণের কথা পদে গায়।
সে তো বৃন্দাবনের কৃষ্ণ রাধা নয়॥

লোকধর্মের এইসব বলাবলিই বলে দিচ্ছে যে, আঠারো শতকের বাংলায় যে সব বৈষ্ণবীয় উপ-সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছিল সবেরই মূলে রয়ে গেছেন সেই আচণ্ডালে প্রেম বিতরণকারী চৈতন্য মহাপ্রভু। সামগ্রিক লোকধর্ম সম্পর্কেই আদতে কথাটি খাটে।

দেহের খবর জান গে রে মন

বাংলার লোকসংস্কৃতির সবচেয়ে রহস্যময়, সমৃদ্ধ এবং দার্শনিক শাখা হলো বাউল দর্শন। বাউল শুধু গান বা একধরনের লোকসংগীতের পরিচয় নয়; এটি জীবন-ভাবনা, আধ্যাত্মিক অনুশীলন, আত্ম-বিশ্বাস এবং মানসিক মুক্তির এক অনন্য পথ। নানা ধর্মীয় মত, শাস্ত্রতত্ত্ব ও সামাজিক কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বাউল দেখিয়েছেন-মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় রহস্য ও মুক্তি বাহিরে নয়, ভিতরেই। দেহকে ঘিরেই এই দর্শনের মূল রচনা। তাই বাউলের দৃষ্টি সর্বদাই দেহমুখী, স্থূল কিন্তু গভীর, সাধারণ অথচ আধ্যাত্মিক।

ধর্ম-শাস্ত্রে আত্মাকে অনেক সময় দেহের বাইরে বা উচ্চতর কোনো স্তরে কল্পনা করা হয়। আত্মা যেন দেহ থেকে আলাদা, উচ্চতর এক সত্তা। কিন্তু বাউলের যুক্তি হলো-দেহই সেই দরজা যেখান দিয়ে আত্মার আলো প্রকাশ পায়। দেহ তুচ্ছ নয়, দেহ পাপের আধার নয়, দেহকে দমন করার বিষয় তো নয়ই। বরং এই দেহই মহাবিশ্বের প্রতিচ্ছবি। তাই বাউল বলেই দিতে পারে-দেহের ভিতরেই আছে সাত-পাতাল, সাত-দ্বীপ, সাত-সাগর, সপ্তস্বর্গ। এই শব্দগুলো শুধু পৌরাণিক নয়, বরং দেহের বহু-স্তরীয় গঠনের দার্শনিক ব্যাখ্যা। বাউলের এই ধারণা দেহকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করে। দেহকে সে একটি মন্দিরের মতো দেখছেÑ যেখানে রয়েছে শক্তি, রহস্য এবং চিরন্তনতার বীজ।

ছবি খোলা কাগজ

ছবি খোলা কাগজ


দেহকে আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র হিসেবে ভাবার এই দৃষ্টিভঙ্গিই বাউল দর্শনের মূলমন্ত্র। চোখ, নড়ি, রক্ত, নিশ্বাস, বায়ু-এগুলো কেবল শরীরের অঙ্গ বা প্রক্রিয়া নয়; প্রতিটি একটি প্রতীক, একটি পথ, একটি উপায়। দেহে দুই ধারা- ইড়া ও পিঙ্গলার ধারণা, সূর্য-চন্দ্রের প্রতীক, পূর্ণিমা ও অমাবস্যার উপমা- এসবই দেহের ভেতরকার আলো ও অন্ধকার, উচ্ছ্বাস ও নিস্তব্ধতার রূপক। দেহের মধ্যেই তাই ঘটে আধ্যাত্মিক ভ্রমণ। এই যাত্রা কোনো বই পড়ে শেখা যায় না, কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে পাওয়া যায় না। এই যাত্রা শুরু হয় নিজের শ্বাস থেকে, অনুভব থেকে, রক্তের প্রবাহ থেকে।

বাউলগানের বাণী, প্রতীক ও ভাষাও তাই দেহমুখী। তাদের সাধনা দেহ-অস্বীকার নয়; বরং দেহের অভিজ্ঞতাকে বুঝে নেওয়া, দেহের রূপকে চেতনায় রূপান্তরিত করা। প্রেম, কাম, রস- এগুলো বাউলের কাছে নিষিদ্ধ কিছু নয়, বরং বৈধ ও প্রাকৃতিক। মানবদেহের সঙ্গিনী, রজ, রূপ, রস- এসবকে সামাজিক নিষেধের তোয়াক্কা না করে সে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার অংশ হিসেবে গ্রহণ করে। দেহ মানে প্রকৃতি, অস্তিত্ব এবং অনুভব- এই তিনের সঙ্গম। বাউলের দৃষ্টিতে তাই সাধনা মানেই দেহের ভেতরকার নাড়ি, বায়ু, রস ও চেতনার জাগরণ।

এই দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো গুরু। বাউল বিশ্বাস করে- গুরু ছাড়া পথচলা অসম্ভব। গুরু সেই ব্যক্তি যিনি শিষ্যকে দেখিয়ে দেন- সত্য কী, কিভাবে দেখা যায়, অনুভব করা যায়। গুরু শিষ্যকে কেবল আচার বা বিধিনিষেধ শেখান না; তিনি শেখান বায়ুর গতিপথ, নাড়ির চলন, অনুভবের ভাষা। গুরু-শিষ্য সম্পর্কের মাধ্যমে দেহের গূঢতত্ত্ব প্রকাশিত হয়। শিষ্যকেও সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়Ñ বাহ্যিক বা গ্রন্থগত জ্ঞান দিয়ে নয়, ভেতরের অনুভবের দ্বারা।

বাউল দর্শন এ কারণে ধর্ম, জাত, উপাচার, মন্দির, মসজিদ- সবকিছুর সীমা অতিক্রম করে। বাউল বিশ্বাস করে, ঈশ্বর বা সত্য বা স্রষ্টা কোনো বাহ্যিক শক্তি নয়; তিনি মানুষের ভেতরেই আছেন। তাই মূর্তি বা আচার কোনওটারই প্রতি তাদের আসক্তি নেই। “মানুষ হয়ে মানুষ হওয়া”- এই বাক্যটি শুধু নৈতিকতা বা কাব্যের কথা নয়; এটি বাউল দর্শনের শীর্ষবিন্দু। মানুষের দেহকে, দেহের অনুভূতিকে, সম্পর্কের আলোকে চেনা- এই জ্ঞানই মানুষকে সত্যিকার মানুষ করে তোলে।

বাউল দর্শনের সৌন্দর্য এখানেই- এটি যে মানুষকে মুক্ত করে। ধর্মীয় অন্ধতা বা সামাজিক বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে এই দর্শন দাঁড় করায় এক অত্যন্ত মানবিক, সহজ এবং স্বাধীন পথ। বাউল গান তাই বিনোদনের বিষয় নয়। এটি এক ধরনের সাধনা। গান শোনা মানে কেবল সুরের সৌন্দর্যে ভাষা নয়; বরং তার ভেতরকার বাণীকে অনুভব করা। বাউল গান আমাদের শেখায়- শরীরকে হেয় জেনে নয়, বরং মর্যাদা দিয়েই সত্যকে স্পর্শ করা যায়। বাউল আখড়া তাই কেবল সংগীতের আসর নয়, এটি আত্ম-অন্বেষণের এক আখড়া।

আজকের সমাজে যখন মানুষ ক্রমশ দেহকে অস্বীকার করছে- কখনো তা নৈতিকতার অজুহাতে, কখনো আধুনিকতার নামে- তখন বাউল দর্শন আমাদের এক ভিন্ন সত্য স্মরণ করিয়ে দেয়। দেহই হলো প্রথম সত্য। এই দেহের ভেতরেই জন্ম, প্রেম, অনুভব, অভিজ্ঞতা এবং দ্বন্দ্ব- সবকিছু। তাই দেহকে অবমূল্যায়ন নয়; বরং তার ভাষা শেখা দরকার। ধর্ম বা দর্শনের জটিলতার বাইরে এই সহজ সত্যটি আজো প্রাসঙ্গিক।

শেষ পর্যন্ত বাউল আমাদের শেখায়: তুমি যে সত্য খুঁজছ, তা কোথাও বাইরে নেই। কোনো গ্রন্থে, কোনো আচার-অনুষ্ঠানে, কোনো উপদেশে নয়। সত্য ঠিক তোমার দেহেই। দেহের ভেতরেই আকাশ। আর মানুষ হওয়াটাই- সবচেয়ে বড় সাধনা।

আপন সাধন কথা না কহিও যথাতথা

বাংলার লোকধর্ম মূলত উচ্চবর্ণের ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও সামাজিক নিষ্পেষণের ফল। ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ যখন অন্ত্যজ ও ব্রাত্যদের পৃথকীকরণের দিকে ঠেলে দিত, তখন এ জনগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে ‘লোকনায়ক’ বা ‘গুরু’ খুঁজে নিত। এদের প্রদর্শিত ‘কায়াবাদী আচার সর্বস্বতা’ এবং শাস্ত্রের বিপরীত ধর্মীয় নির্দেশনাই সাধারণ মানুষকে সামাজিক মোকাবিলার পথ দেখিয়েছে।

লোকধর্মের সামাজিক প্রতিরোধের ভিত্তি বহু প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব দেড় হাজার বছর আগের বরেন্দ্র কৈবর্ত্যনায়ক দিব্যোকের বিদ্রোহ- যেখানে একাদশ শতকে রাজা দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করে কৈবর্ত্যাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়- এরই একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। পাল রাজসভার সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দী ‘রামচরিত’-এ দিব্যোককে ‘দস্যু’ আখ্যা দিয়ে বিদ্রোহের প্রকৃত স্বরূপ চাপা দিতে চেয়েছিলেন এবং একে ‘ধর্মবিপ্লব’ হিসেবে হেয় করেছিলেন।

ছবি খোলা কাগজ

ছবি খোলা কাগজ


কিন্তু পরবর্তী গবেষক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমাণ করেছেন যে বাঙালির কৃষ্টি ও সভ্যতার মূল ছিল চাষি, জেলে, জোলা, তিলি, মুচি, চণ্ডাল প্রমুখ লোকায়ত সমাজের ইতিহাসে। এ পরিশ্রমজীবী জনতাই জাতিভেদ ও শাস্ত্রকে অগ্রাহ্য করে গুরুকেন্দ্রিক করণধর্মে ঝুঁকেছিল।

দেহতত্ত্ব ও সন্ধ্যা ভাষা : বস্তুবাদী দর্শন

লোকধর্মের সাধনার ভিত্তি ছিল শাস্ত্রীয় জটিলতামুক্ত, ইহকেন্দ্রিক দেহতত্ত্ব। ঢাকার গবেষক যতীন সরকার এ দুটি সমাজের দর্শনকে শ্রেণিবিন্যাস করেছেন : ‘পরিশ্রমজীবী’ (বস্তুবাদী) ও ‘পরশ্রমজীবী’ (ভাববাদ-আশ্রয়ী)। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় কথিত ‘লোকায়ত দর্শন’ মূলত বস্তুবাদী। এখানে দেহ হলো অন্বিষ্ট; ‘যা আছে দেহভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে’-এটাই তাদের মূল সিদ্ধান্ত।

কায়াবাদী সাধনা : রজ বা বর্জ্য পদার্থের ব্যবহার, কাম থেকে প্রেমে উত্তরণের পথ। শ্বাস নিয়ন্ত্রণ ও বিন্দু নিয়ন্ত্রণ বা বীর্যধারণ-এর ভরকেন্দ্র। চুরাশি সিদ্ধদের লেখাতেও এই দেহনির্ভর সাধনার বিবরণ রয়েছে।

সন্ধ্যা ভাষা : লোকধর্মের সাধনা ছিল গুরু-আধারিত, দেহজ্ঞান বা অভিজ্ঞ সত্যের ভাষা। উচ্চকোটির সমাজে এটি প্রচারিত হতো না। তাই এটি ‘সন্ধ্যা ভাষা’ হিসেবে পরিচিত, যা গুপ্ত বা সংগুপ্ত সাধনার ইঙ্গিত বহন করে।

মুনিদত্তের মতো সংস্কৃত পণ্ডিতেরা চর্যাগানের ওপর টীকা-ভাষ্য রচনা করে সহজ সাধনাকে মহাযান বৌদ্ধসাধনার জটিল পরিক্রমা বা দেহতত্ত্বের বৌদ্ধ শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ঠিক যেমন সন্ধ্যাকর নন্দী কৈবর্ত বিদ্রোহকে চাপা দিতে চেয়েছিলেন, তেমনি মুনিদত্তও লোকধর্মকে শাস্ত্রীয় দার্শনিক জ্ঞানের আওতায় আনার চেষ্টা করেছিলেন।

জলের জানলায় জলের খেলা

‘ওই জলের কল ঘর্ষণেতে, হর-ব্রহ্মা-বিষ্ণু হলেও মরে।’ এটি শুনে অবাক লাগতে পারে, কারণ আমরা দেবতাদের অমর মনে করি। কিন্তু বাউলের দৃষ্টিতে, দেবতা হলেও যদি তারা ‘বীর্য’ বা শক্তি ধরে রাখতে না পারেন, তাতে তাদেরও প্রয়াস ব্যর্থ হয়। শিবত্ব বা আধ্যাত্মিক সিদ্ধি হলো এই শক্তির সঠিক নিয়ন্ত্রণ। তাই, যদি কেউ নিজের শক্তিকে ভুলভাবে ব্যবহার করে, বা বিন্দুধারণে ব্যর্থ হয়, সে ‘মরে’ অর্থাৎ ধ্রুপদি সিদ্ধি লাভ করতে পারে না। ‘জল চিনিলে ছাড়বে যমের জ্বালা’ কথার অর্থও এই। এখানে যম হলো যোগের আটটি অঙ্গ- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান এবং সমাধি। এই অঙ্গগুলো অনুশীলন করতে হবে নিজের আত্মা ও স্বরূপ বুঝতে। যমের মধ্যে রয়েছে অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ। যখন হিংসা, লোভ বা কামনা চলে যায়, তখনই সত্যিকারের ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহের সাধন সম্ভব হয়।

ছবি খোলা কাগজ

ছবি খোলা কাগজ


বাউলরা বলেন, এই যমের জ্বালা বা প্রথম কঠিন ধাপ ছাড়া সিদ্ধি আসে না। এই প্রক্রিয়ায় গুরুর সাহায্য অপরিহার্য। গুরুর তত্ত্ব ও নির্দেশনা অনুসরণ করলে সাধক একটি বিন্দুতে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ধারণ করতে পারে। এই ‘জলের বিন্দুতে ব্রহ্মাণ্ড’ হল আধ্যাত্মিক সিদ্ধির প্রতীক। সাধক যখন এই স্তরে পৌঁছান, তখন তার দেহ ও যুগল মিলনে শক্তি প্রবাহিত হয়। বাউল গানে বলেছেন, ‘জলের ফুলে ভৃঙ্গরূপে, শ্যাম চরান হংস জলের সরোবরে।’ এখানে ভৃঙ্গ বা ভ্রমর শক্তির গুনগুনানি, শ্যাম বা প্রেম হলো কামকে রূপান্তরিত করা, আর সরোবর হলো শরীরের মাধ্যম। অর্থাৎ সাধক যৌন শক্তিকে প্রেম এবং আধ্যাত্মিক শক্তিতে রূপান্তর করছেন।

এই প্রক্রিয়ায় ত্রিবিধ নাড়ি- ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না- মিলিত হয় এবং শরীরের আজ্ঞাচক্রে ত্রিকূট বা ত্রিবেণী গঠিত হয়। বাউলরা বলেন, এই মিলনের স্বীকৃতি শুধুমাত্র গুরুর নির্দেশে সম্ভব, অজ্ঞ বা মোহাবিষ্ট জন তা বুঝতে পারবে না। ‘মূঢ় কামিনী’ দ্বারা বোঝানো হয়েছে সেই অজ্ঞানতা বা ভুল পরিচয়, যা ধ্যান, যোগ ও গুরুর প্রদর্শনী দ্বারা চিহ্নিত করে ঠিক করা যায়। শারীরিক শক্তি বা বীর্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে কেউই সিদ্ধি লাভ করতে পারবে না। যোগের অষ্টাঙ্গ অনুশীলন, গুরুর অনুগত অনুসরণ ও কাম শক্তির রূপান্তর হল আধ্যাত্মিক অর্জনের মূল পথ।

কেকে/এমএ
আরও সংবাদ   বিষয়:  বাংলার বাউল  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

ইটনায় জমি বিরোধকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, নিহত ১
নির্বাচনী জোটের আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে : রাশেদ খান
ফরিদপুরে পাটবীজ বিক্রয় তরান্বিতকরণ বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত
তিন ভাইয়ের মিশ্র বাগা‌নে কমলার বাম্পার ফলন
গণতন্ত্র ফেরাতে নির্বাচনের বিকল্প নেই : আমান

সর্বাধিক পঠিত

খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় বান্দরবানে কুরআন খতম ও মাহফিল
কক্সবাজারে ৭ উপজেলায় ইউএনও রদবদল
কাপাসিয়ায় অবৈধ কয়লা চুল্লি পুনরায় চালু, পরিবেশ বিপর্যস্ত
শেখ হাসিনা-জয়-পুতুলের মামলার রায় আজ, আদালতে বিজিবি মোতায়েন
শেখ হাসিনার ২১ বছরের কারাদণ্ড
সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close