বাংলার ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাই বাংলার আকর্ষণে মুগ্ধ হয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে নানা সময়ের মানুষ ছুটে এসেছেন এই বাংলায়। গাঙ্গেয় সমভূমি বাংলার রূপ দেখতে হাজির হতেন পর্যটশরা। স্বর্ণ-হীরার খনি কিংবা রূপার পাহাড় কিছুই ছিল না; ছিল নদীবিধৌত উর্বর সবুজ ফসলের মাঠ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য নদ নদী, ছিল বাহারি রকমের ধান, মাছ আর মিহি সুতোয় বোনা মসলিন। বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আর ঐশ্বর্যের এই মহাসমারোহের অমোঘ আকর্ষণে ছুটে আসতেন পর্যটকরা। ঠিক কবে থেকে বাংলায় ভিনদেশিরা আসতে শুরু করেছেন সেই সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা মুশকিল। তবে বাংলার ইতিহাস, তথ্যপ্রবাহ ইত্যাদি থেকে আমরা বেশ কয়েকজন ভিনদেশি পর্যটক সম্পর্কে জানতে পারি। বিবিধের আজকের সংখ্যাটি সাজানো হয়েছে বাংলায় আগত পর্যটকদের নিয়ে।
ছবি : সংগৃহীত
মেগাস্থিনিস
মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্বকালে ভারতে এসেছিলেন, সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৩০২ থেকে ২৮৮ সালের মধ্যে। তিনি ছিলেন সেলুকাস নিকেটরের দূত এবং পাটলিপুত্রে (বর্তমান পাটনা) অবস্থান করে প্রায় চার বছর ভারতে ছিলেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইন্ডিকা’ মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রশাসন, সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে, যদিও বইটির আসল সংস্করণ এখন আর পাওয়া যায় না।
মেগাস্থিনিস উপমহাদেশে অবস্থানকালীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে বাস্তব ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ‘ইন্ডিকা’ নামক একখানি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি তৎকালীন সমাজ ও শাসনব্যবস্থা, নগরীর সমৃদ্ধি, পথঘাট, প্রজাদের দৈনন্দিন জীবন, অর্থনৈতিক অবস্থা, ধর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে এই গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। মেগান্থিনিস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজধানী পাটলিপুত্র নগরের গঠন বৈচিত্র্য এবং সুরম্য অট্টালিকাসমূহের শিল্পকর্মের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি ভারতবর্ষে অবস্থানকালে যেসব বিষয় প্রত্যক্ষ করেছেন সেগুলো সম্পর্কে ইন্ডিকা গ্রন্থে নিখুঁত বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি বাংলায় এসেছিলেন কিনা সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো দলিল পাওয়া যায় না। বড় বাংলার কথা বিবেচনায় রাখলে মেগাস্থিনেসের বাংলা ভ্রমণ ঐতিহাসিকভাবে সত্য হয়।
মেগাস্থিনিস তৎকালীন ভারতীয়দের জীবন-যাপন পদ্ধতি এবং রীতিনীতি সম্পর্কে মনোজ্ঞ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন তার বই ইন্ডিকায়। ভারতীয়দের জীবনযাত্রা প্রণালি ছিল সহজ-সরল এবং স্বাচ্ছন্দ্যময়। তখন সমাজে চুরি ডাকাতি কম হতো। মিতব্যয়ী জীবনযাপন করলেও স্ত্রী কন্যাদের অলঙ্কারাদি নির্মাণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করত এ অঞ্চলের মানুষরা। মোটামোটিভাবে জনসাধারণের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল সচ্ছল এবং উন্নত। চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে আইনের শাসন ছিল অত্যন্ত কঠোর। জনগণ শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করত।
তিনি প্রাচীন ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা, শাসন পদ্ধতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে যে মূল্যবান তথ্য ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন তা মৌর্য বংশের সামগ্রিক ইতিহাসের অত্যন্ত মূল্যবান উপাদান। প্রাচীন ভারতের তথ্যবহুল উপাদানের জন্য এ ভূখণ্ডের মানুষ তার নিকট চিরঋণী।
ছবি : সংগৃহীত
ফা-হিয়েন
আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৩৯৯ অব্দে পায়ে হেঁটে বাংলা ভ্রমণে আসেন চীন দেশের ফা হিয়েন। তিনি মূলত একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিলেন। তিব্বতের পামির মালভূমির দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সঙ্গীদের সাথে তিনি বাংলায় আসেন। ৩৯৯-৪১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেন। তার লেখা ভ্রমণকাহিনিতে প্রাচীন বাংলার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন- সে সময়ে এখানে চণ্ডাল ছাড়া কেউ প্রাণীহত্যা করত না। ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন তখন তার বয়স সম্ভবত ৬৪ বছর।
মধ্য এশিয়া ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে পরিভ্রমণ করে ফা-হিয়েন উত্তর ভারতে উপস্থিত হন। এরপর তিনি একে একে গঙ্গা উপত্যকায় বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিভিন্ন পবিত্র স্থান দর্শন করেন, যেমন বুদ্ধের জন্মভূমি কপিলাবস্ত্ত, বুদ্ধের দিব্যজ্ঞান প্রাপ্তির স্থান বুদ্ধগয়া; বুদ্ধের প্রথম ধর্মোপদেশ প্রদানের স্থান সারনাথ এবং নির্বাণ লাভের স্থান কুশীনগর। তিনি তার ভ্রমণের অধিকাংশ সময়ই মধ্য ভারত বা মগধ পরিভ্রমণ অতিবাহিত করেন। চেংয়ান (তৎকালীন চৈনিক রাজধানী) থেকে মধ্য ভারতে পৌঁছতে ফা-হিয়েনের ছয় বছর সময় লেগেছিল এবং সেখানে তিনি ভ্রমণে ছয় বছর অতিবাহিত করেন এবং প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি তিন বৎসর সময় নিয়ে বর্তমান চীনের পূর্বউপকূলীয় প্রদেশ শানডং-এর চিংচৌ (Qingzho) এ পৌঁছেন।
ফা-হিয়েনের তীর্থযাত্রা চীনের পরবর্তী প্রজন্মের যাজকদের অনুপ্রাণিত করেছিল। চরমসত্য বা ধর্ম অনুসন্ধানে বুদ্ধের পবিত্র ভূমি পরিভ্রমণে জলপথ অথবা স্থলপথের সমস্ত কষ্টই তারা অগ্রাহ্য করেছিলেন।
ভারত ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে তিনি সীমান্ত রাজ্য চম্পার মধ্য দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। তার গন্তব্যস্থল ছিল সে সময়ের বিখ্যাত আন্তর্জাতিক বন্দর তাম্রলিপ্তি (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত তমলুক)। সেখান থেকেই সমুদ্রপথে তিনি অপর বৌদ্ধপ্রধান অঞ্চল শ্রীলঙ্কায় যেতে চেয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কা যাওয়ার পূর্বে ফা-হিয়েন দীর্ঘ দুবছর তাম্রলিপ্তিতে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের অনুলিপি তৈরি ও বৌদ্ধ মূর্তির ছবি অংকন করেন। তার বিবরণী থেকে জানা যায়, এ সময় তাম্রলিপ্তিতে চব্বিশটি বৌদ্ধ বিহার ও সেখানে অনেক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিলেন। অবশ্য তিনি তার বিস্তারিত বিবরণ দেননি।
ছবি : সংগৃহীত
হিউয়েন সাং
হিউয়েন সাং একাধারে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, পর্যটক এবং অনুবাদক ছিলেন। ৬৩৮ সালের দিকে বাংলায় আসেন হিউয়েন সাং।
হিউয়েন সাং জন্মগ্রহণ করেন ৬০৩ সালে চীনের হেনান প্রদেশে। শৈশব থেকেই তিনি ধর্মগ্রন্থ, বিশেষ করে চৈনিক ধ্রুপদি গ্রন্থ ও প্রাচীন জ্ঞানী লোকদের লেখা পাঠে আগ্রহী হন। লুওইয়াং নগরে অবস্থানকালে হিউয়েন সাং মাত্র ১৩ বছর বয়সে বৌদ্ধভিক্ষু সম্প্রদায়ে প্রবেশ করেন।
সুই রাজবংশের পতনের পর রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে তিনি সিচুয়ানের জিংদুতে চলে যান। সেখানে থাকা অবস্থায় ২০ বছর বয়সে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। এর পর থেকে তিনি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের সন্ধানে পুরো চীন ভ্রমণ করেন। অবশেষে তিনি তাং সম্রাট তাইজং শাসনাধীন চ্যাংগানে পৌঁছান। এখানে এসেই হিউয়েন সাংয়ের ভারত ভ্রমণের ইচ্ছা জাগে মনে।
৬২৯ সালে চীন থেকে যাত্রা শুরু করে হিউয়েন সাং উত্তরের বাণিজ্য পথ ধরে মধ্য এশিয়ার কুশ হয়ে উত্তর ভারতে পৌঁছান। কনৌজনগরে (এটি এখনকার ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কনৌজ জেলার একটি মহানগর) পৌঁছে তিনি ভারতীয় সম্রাট হর্ষবর্ধনের আতিথ্য লাভ করেন। তিনি মগধের (এই রাজ্য বর্তমানের বিহারের পাটনা, গয়া আর বাংলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল) বিভিন্ন বৌদ্ধ তীর্থস্থান পরিদর্শন করেন। তৎকালীন বিখ্যাত বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র নালন্দা মহাবিহারে বেশ কিছুদিন অবস্থান করে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এরপর তিনি বাংলার বিভিন্ন অংশ (পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশ) এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারত ভ্রমণ করে আবার মধ্য এশিয়া হয়ে চীনে প্রত্যাবর্তন করেন। তবে ফেরার পথে তিনি খোটান হয়ে দক্ষিণ পথ ধরেন। হিউয়েন সাং তার ভ্রমণকৃত সব দেশের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ৬৪৫ সালে হিউয়েন সাং চীনে প্রত্যাবর্তন করলে তাকে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তখনো সিংহাসনে আসীন ছিলেন সম্রাট তাইজং। হিউয়েন সাংকে বিভিন্ন উচ্চ পদে যোগদানের প্রস্তাব দেন তিনি। কিন্তু সব প্রস্তাবই ফিরিয়ে দেন তিনি। ৬৬৪ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বৌদ্ধ রচনার অনুবাদে জীবনের বাকি সময় ব্যয় করেন হিউয়েন সাং।
ছবি : সংগৃহীত
ইবনে বতুতা
ইবনে বতুতা আনুমানিক ৭৫ হাজার বর্গমাইল এবং কিলোমিটারের চিন্তায় এক লাখ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটারজুড়ে ৪০টিরও বেশি এলাকা ভ্রমণ করেছিলেন, যা খ্যাতনামা ইতালিয়ান অভিযাত্রী মার্কো পোলোকে ছাড়িয়ে গেছেন। উল্লেখিত এই ৪০টি অঞ্চলই দার আল ইসলামের অধীনে ছিলও। দার আল ইসলাম অর্থাৎ সে সময় যতগুলো রাজ্য মুসলিম শাসকরা শাসন করতো তাদেরকে একত্রে বলা হতো দার আল ইসলাম। যেটা শুরু হয়েছিল পশ্চিমের মরক্কো, স্পেন থেকে শুরু করে পূর্ব বাংলা ও আরাকান ছাড়িয়ে বর্তমান ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত, আর বর্তমান রাশিয়ার কাজান শহর থেকে দক্ষিণে আফ্রিকার মাদাগাস্কার শহর অব্দি। মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম অভিযাত্রী বলে অভিহিত করা হয়ে তাকে।
তিনি দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক এবং মুসলিম পণ্ডিতদের প্রতি তার উদারতার কথা শুনে তিনি দিল্লি সফরের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, দিল্লির অনুসন্ধানে তিনি এশিয়া মাইনরের উদ্দেশে রওনা দেন। এ সময়ের যাত্রার বিস্তারিত বর্ণিত আছে তার লেখা বইতে, যা ইতিহাস বইগুলোতে সেলজুক সাম্রাজ্যের পতন এবং অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের নির্ভরযোগ্য সূত্র। তিনি যখন দিল্লি সফরে আসেন তখন দিল্লির সুলতান ছিলেন মুহাম্মদ বিন তুঘলক। তিনি দিল্লির সুলতানের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে আসেন ৩০টা ঘোড়া, কয়েকটি উটসহ বেশ-কয়েকজন দাসদাসী। এর প্রতিদানে সুলতানও তাকে ২০০ মুদ্রা উপহার দেন এবং সালতানাতের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করেন।
১৩৪৬ সালে তিনি বাংলায় আসেন আর ওই সময় সিলেটে শাহজালাল (র.) নামডাক থাকায় তিনি তার সঙ্গে দেখা করতে যান। যখন তিনি বাংলায় আসেন তখন বাংলা শাসন করছিলেন ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ। যিনি মূলত দিল্লি শাসকের বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলা শাসন করছিলেন। ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ নিজেকে দিল্লির গভর্নর হিসাবে নিজে দাবি করায় তার সাথে দেখা করতে যাননি ইবনে বতুতা। তিনি বাংলায় অবস্থান করেন পৌনে দুমাসের মতো (জুলাই এবং আগস্ট মাস।) তিনি শাহজালালের কাছে তিনদিন আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। এরপর তিনি হবিগঞ্জ ও সোনারগাঁও শহরে যান ১৩৪৬ সালের ১৪ আগস্ট, এই যাত্রায় তার সময় লেগেছিল ১৫ দিন। তার বাংলা ভ্রমণের সিংহভাগ নদীপথ হলেও তারপরও তিনি তার লেখায় শহুরে জীবনযাপনের বিষয় ফুটিয়ে তুলেছেন। বিবৃতি করেছেন বাজার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সামাজিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক আধিপত্যর বিবর্তন।
ইবনে বতুতার লেখায় বাংলার চারটি অঞ্চলে ও তিনটি নদীর নাম পাওয়া যায়। অঞ্চল চারটি হলো সুদকাও, কামরু, হবংক, সনরকাও। সুদকাঁও শব্দটি মূলত চাটগাওয়ান শব্দের সাথে মিলিত এবং এ সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন এটি একটি বিশাল বন্দর ও সমুদ্রের নিকটবর্তী। এই বর্ণনা শুনে বোঝা যায়, এটা বর্তমান চট্টগ্রামকে বুঝিয়েছেন। কামরু বা কামরূপ রাজ্য যা ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি অঞ্চল বা সিলেটের সীমান্ত অঞ্চলকে বলা হয়। এরপর যে শব্দটি আসে সেটা হলো হবংক, এটি মূলত বর্তমান হবিগঞ্জের ১০ মাইল দূরে হবংক টিলা নামে অভিহিত এবং সোনারগাঁও তৎকালীন মেঘনা নদীর তীরে বিখ্যাত রাজধানী।
তিনি যখন বাংলায় আসেন তখন বাংলায় সুফিবাদের ব্যাপক প্রভাব। সুলতান থেকে জনসাধারণ সবাই সুফিদের সম্মান করতেন। সুফিদের কথা বলতে গিয়ে তিনি তুলে ধরেন বাংলার দরবেশদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী শাহজালাল উদ্দিনের কথা। যার মাজার বর্তমানে সিলেটে অবস্থিত। তার প্রসঙ্গে তিনি এক অলৌকিক গল্পের কথা বলেন। শাহজালাল উদ্দিন গুহায় থাকতেন। পশমের পোশাক জড়িয়ে লম্বা পাতলা গড়নের দৃঢ় মানুষ ছিলেন তিনি। ইবনে বতুতার আগমনের কথা তার জানার কথা না, অথচ তিনি তাকে অভ্যর্থনা দেওয়ার জন্য চারজন শিষ্য পাঠান। আর এই ঘটনাটি বিস্মিত করেছে তাকে। এখানেই শেষ নয়, তিনি জালাল উদ্দিনের পোশাক দেখে মুগ্ধ হন এবং মনে মনে এরকম একটা পোশাকের আশা করেন কিন্তু সংকোচে বলেননি। বিদায়কালে দরবেশ তাকে এই পোশাক উপহার দিয়ে তাকে অবাক করেন। শাহজালাল উদ্দিন কিছু ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, যা চীনে গেলে সত্য হয়।
ছবি : সংগৃহীত
ই সিং
সপ্তম শতকে বাংলায় আসেন আরেক চীনা নাগরিক ‘ই-সিং’। তিনি হরিকেল ও চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চল ঘুরে দেখেছিলেন। তার বর্ণনামতে তখনকার সময়ে শালি ধানের ভাত বেশ জনপ্রিয় ছিল। মাষকলাই, তিল, মুগ ও যবের চাষ হতো প্রচুর পরিমাণে। নানারকম পিঠা পায়েস ও মিষ্টির চল ছিল। কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছ আর পাটশাক ছিল চরম উপাদেয়। তৎকালীন লোকেরা গবাদিপশু রক্ষায় এবং নানা ধরনের বিপদে-আপদে মন্ত্রের সাহায্য নিত। নবম শতকে, মতান্তরে ১১৫১ সালে, বাংলা ভ্রমণে এসেছিলেন আরব দেশের পর্যটক সোলায়মান। তার লেখা ভ্রমণ কাহিনির নাম ‘সিল সিলাত আল তাওয়ারিখ’। এই বইটি পরে লন্ডন থেকে প্রকাশ করা হয়। তিনি বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও এই অঞ্চলের মানুষের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন।
ছবি : সংগৃহীত
মা হুয়ান
মা হুয়ান চৈনিক পরিব্রাজক। জেং হি (চেং হো)-র ভারত মহাসাগরে (চীনাদের কাছে পশ্চিম সাগর নামে পরিচিত) অভিযাত্রায় সফরসঙ্গী চার প্রধান কর্মকর্তার মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জেং হি ভারত মহাসাগরে মোট সাতবার অভিযাত্রায় বের হন। তার দুজন সহযাত্রী তাদের ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখে গেছেন। ইংরেজিতে অনূদিত বৃত্তান্ত দুটি হল, ফেই জিন (ফেই সিন)-এর The Overall Survey of the Star Raft (১৪৩৬ খ্রি) এবং গং জেন (কুং চেন)-এর Records of Foreign Countries in the Western Ocean (১৪৩৪ খ্রি)। শেষোক্ত গ্রন্থটি মা হুয়ানের বিবরণের প্রায় অনুরূপ। চতুর্থ সহকারী গুয়ো চংলী মা হুয়ানের সাথে একত্রে The Overall Survey of the OceanÕs Shores wKsev The Captivating Views of the OceanÕs Shores (১৪৩৩ খ্রি) শিরোনামে তাদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখে যান।
মা হুয়ান তার নিজের বয়সের কোনো ধারণা দেননি। তবে ধারণা করা হয় তিনি ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে তার গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। তার লেখার প্রকাশভঙ্গিতে ধ্রুপদী চৈনিক সাহিত্যের প্রভাব এবং বৌদ্ধগ্রন্থের সাথে একাত্ম প্রমাণ করে যে, তিনি উপযুক্ত শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি কবিতাও লিখতে পারতেন, তবে তা হতো খুব সাধারণ শৈলীর। যুবক বয়সে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষায় শিক্ষালাভ করেন। সম্ভবত একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের অধীনে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন, ফলে তিনি একজন দক্ষ দোভাষীতে পরিণত হন।
মা হুয়ান ছিলেন খুব সাধারণ মনের মানুষ। তিনি যে কোনো ধরনের সহিংসতাকে ঘৃণা করতেন। তাই জাভার বিচারব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ডের প্রকোপ দেখে তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তার বিবরণে একজন ভ্রমণ বৃত্তান্ত লেখকের মাঝে একজন নব-জিজ্ঞাসা লালনকারী মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়। তাই কোনো ভিনদেশের দূরত্ব, ভ্রমণ পথ,পণ্য-দ্রব্য, রাজনৈতিক অবস্থা প্রভৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ছাড়াও সে দেশের লোককাহিনি ও লোকগাথা যেমন: কালিকটে প্রচলিত মোজেস ও স্বর্ণ গো-বৎসের কাহিনিসহ চৈনিকদের কাছে বিরল বস্তুসমূহ যেমন: কাঁঠাল, গন্ডার, জেব্রা, জিরাফ ইত্যাদির বর্ণনা করেছেন। মা হুয়ানের লেখা পড়ে মনে হয় তার বিবরণ বস্তুনিষ্ঠ ও পক্ষপাতহীন।
আব্দুর রাজ্জাক, নিকিতিন এবং আরো কয়েকজন লেখক ব্যতীত চৌদ্দ শতকের প্রথম থেকে পনেরো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় দেড়শ বছর সময়ে ছয়জন পর্যটক গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ রেখে গেছেন। তারা হলেন ইবনে বতুতা (১৩২৬-৪৯ খ্রি), ওয়াং দাইউয়ান (আনু. ১৩৩০-৫০ খ্রি), ফেই সিন (১৪০৯-৩৩ খ্রি), মা হুয়ান, গং জেন (১৪১৩-৩৩ খ্রি) এবং নিকোলো ডি কন্টি (১৪২০-৪৪ খ্রি)। এই ছয়জনের মধ্যে চারজন ছিলেন চৈনিক পর্যটক; আর তথ্য প্রদানে চৈনিক পর্যটকদের মধ্যে মা হুয়ান ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। মা হুয়ান বর্ণিত ২০টি দেশের মধ্যে ইবনে বতুতা বর্ণনা দিয়েছেন মাত্র ১০টির। ফেই জিন যদিও ১৮টি দেশের বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু তার বর্ণনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। আর বিজয়নগর ব্যতীত কন্টির বর্ণনা অত্যন্ত দুর্বল। তবে মা হুয়ান বিজয়নগর ভ্রমণ করেননি। শ্রীলংকা, কুইলোন (কোলাম) ও মালদ্বীপ ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলের ওপর মা হুয়ানের বর্ণনা ইবনে বতুতা অপেক্ষা উন্নতমানের। চম্পা ও কুইলোন সম্পর্কে ফেই জিনের এবং কুইলোন সম্পর্কিত কন্টির বর্ণনা ব্যতীত অপরাপর ক্ষেত্রে মা হুয়ানের বিবরণ প্রকৃতই সমৃদ্ধ।
ছবি : সংগৃহীত
নিকালো মানুচ্চি
আনুমানিক ১৬৫৫ সালে ইতালির নিকোলা মানুচ্চি বাংলায় এসেছিলেন। তিনি মুঘল রাজদরবারে দারাশিকোর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তখন ঢাকার সুবেদার ছিলেন মীর জুমলা। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ঢাকা আসতে তার সময় লেগেছিল ৪০ দিন। Storia do mogor’ তার লেখা ভ্রমণের বই।
এ ছাড়া প্রাচীন বাংলায় আগত পর্যটকদের মাঝে ভূগোলবিদ টলেমি ও ডাইওনিসাস, পর্তুগালের দুয়ার্তে বারবোসা, ফ্রান্সের জহুরি টার্ভানিয়ার, ইংল্যান্ডের রালফ ফিচ, ইতালির সিজার ফ্রেডারিখের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। তারা এসেছেন এই সমৃদ্ধ বাংলায়।