বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫,
১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: শেখ হাসিনার ২১ বছরের কারাদণ্ড      শেখ হাসিনা-জয়-পুতুলের মামলার রায় আজ, আদালতে বিজিবি মোতায়েন      এবার একযোগে ১৫৮ ইউএনওকে বদলি      হংকংয়ে আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৪৪, নিখোঁজ ২৭৯      শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ পর্যালোচনা করা হচ্ছে      ৫০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ      হংকংয়ে একাধিক আবাসিক ভবনে ভয়াবহ আগুন, নিহত ৪      
বিবিধ
বাংলার সাধক ও ভাবুক
খোলা কাগজ
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২৫, ৯:০৫ পিএম
ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

বাংলা অঞ্চল সাধক ভাবুকদের পূণ্যভূমি। এসব সাধক যুগে যুগে এ গাঙ্গেয় ভূমির মানুষের জীবন-যাপন ও  চিন্তা চেতনা সমৃদ্ধ করেছে, করেছে শুদ্ধ। যুগে যুগে এসব সাধকের সাহচর্যে গড়ে উঠেছে বাংলার জনজীবনের মানস কাঠামো। সংগীত, প্রেম, কর্ম ও ধ্যানের ভেতর দিয়ে এসব সাধক আমাদের মুক্তির পথ রচনা করেছেন। আজকের বিবিধের সংখ্যাটি সাজানো হয়েছে সেরকমই কিছু ভাবুক, সাধক ও চিন্তকদের দিয়ে। যাদের চিন্তা, দর্শন, কর্ম আজো আমাদের পাথেয় হয়ে রয়েছে। 

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত


লুইপা : বাংলা ভাষার আদি কবি 

চর্যাপদের পদগুলো প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত। রচয়িতাদের মধ্যে চব্বিশজন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। এই সংকলনের প্রথম পদটি রচনা করেন কবি লুইপা, যার কারণে টীকাকার মুনিদত্ত তাকে ‘আদি সিদ্ধাচার্য’ বলেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাকে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম বাঙালি কবি হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলস্বরূপ, লুইপাই আজ বাংলা ভাষার ‘আদি কবি’ বা ‘প্রথম বাঙালি কবি’ হিসেবে স্বীকৃত।

লুইপার জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তার বাঙালি পরিচয় সর্বজনস্বীকৃত। তিব্বতি পুস্তিকা এবং তাঞ্জোরে সংরক্ষিত বিবরণ তাকে ‘বাংলাদেশের মানুষ বা বাঙালি’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। কেউ কেউ তাকে চন্দ্রদ্বীপ (বর্তমান বরিশাল) অথবা মগধের বাসিন্দা মনে করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাকে রাঢ় অঞ্চলের মানুষ বলে উল্লেখ করেন। তার অন্য নাম ছিল ‘লূয়ীপাদ’ বা ‘লূয়ীচরণ’। ঐতিহাসিক লামা তারানাথ তাকে রাজা উদয়নের লেখক বা করণিক বলে উল্লেখ করেছেন, যিনি একসময় ‘সামন্ত শুভ’ নামেও পরিচিত ছিলেন।
লুইপা কেবল চর্যাপদই রচনা করেননি; তিনি ‘শ্রীভগবদ অভিসময়’, ‘বজ্র-সত্ত্ব সাধনা’সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তান্ত্রিক গ্রন্থেরও রচয়িতা।

চর্যাপদের ভাষা গবেষকদের কাছে এক বড় বিস্ময়। ভাষাতত্ত্ববিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এর ভাষা ও ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্যগুলো একান্তই বাংলা ভাষার নিজস্ব। এর শব্দ ও বাকভঙ্গি আজও বাংলায় প্রচলিত। তবে এর ভাষা দুর্বোধ্য হওয়ায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একে ‘সান্ধ্যভাষা’ বা আলো-আঁধারির রহস্যময় ভাষা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একে ‘বঙ্গকামরূপী’ নাম দিয়েছিলেন।

সিদ্ধসাধক লুইপার কবিতায় বৌদ্ধ দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার গভীর প্রভাব স্পষ্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্যের অনুসন্ধান ও আত্মার মুক্তিই মানুষের প্রধান লক্ষ্য। পণ্ডিতদের অনুমান, লুইপার পদগুলো তৎকালীন সমাজে খোল-মন্দিরা সহযোগে গানের আকারে গীত হতো। এই কারণে চর্যাপদকে বাংলা কীর্তনের প্রাচীনতম নিদর্শন এবং বাংলা গীতিকাব্যের আদি লক্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়। লুইপার হাত ধরেই বাংলা কাব্য গীতিকাব্যের পথ খুঁজে পায়।

লুইপাকে ভারতীয় চুরাশি সিদ্ধাচার্যের একজন মনে করা হয়। কথিত আছে, তিনি নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গার ধারে চলে যান এবং ১২ বছর মাছের অন্ত্র খেয়ে জীবনধারণ করেন। এই কারণে তিনি ‘মৎস্যান্ত্রাদ’ বা ‘মীননাথ’ নামেও পরিচিত হন। তিব্বতি ভাষায় ‘লুই’ শব্দের অর্থই হলো ‘যে ব্যক্তি মাছের অন্ত্র ভক্ষণ করেন’।

তবে আধুনিক গবেষকরা এই দুইজনকে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। তাদের মতে, মৎস্যেন্দ্রনাথ (যিনি নাথধর্মের প্রতিষ্ঠাতা) সপ্তম শতকের কবি ছিলেন। কিন্তু যেহেতু বাংলা গীতিকাব্যের আদিরূপ হিসেবে চর্যাপদ সর্বজনস্বীকৃত এবং লুইপাই সেই চর্যার প্রথম পদটি লেখেন, তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম কবির মর্যাদা তিনিই লাভ করেন। চর্যাপদ এবং তার প্রথম রচয়িতা লুইপা, বাংলা সাহিত্যের ঊষালগ্নে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো আজও কিরণ ছড়াচ্ছেন।

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত


হজরত শাহজালাল মুজার্রাদ ইয়ামনী (রাহ.)

ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি ও দরবেশ হজরত শেখ শাহজালাল মুজার্রাদ ইয়ামনী (রাহ.)-এর পুরো নাম শেখ শাহ জালাল, এবং কুনিয়াত (উপাধি) ছিল মুজাররাদ। ফার্সি ফলক-লিপি অনুসারে, তিনি ৭০৩ হিজরী মোতাবেক ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে অধুনা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তার সমাধির খাদিমগণের প্রাপ্ত এই ফলক-লিপিটি বর্তমানে ঢাকা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। সিলেট আগমনের মাধ্যমে তার সঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার আগমন ইতিহাস একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যার ফলে সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ইসলামের বহুল প্রচার ঘটে।

হজরত শাহজালাল (রাহ.) ৬৭১ হিজরী (১২৭১ খ্রিষ্টাব্দে) প্রাচীন আরবে আযমের হেজাজ ভূমির তৎকালীন প্রদেশ ইয়েমেন দেশের কুনিয়া নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মক্কার কোরায়েশ বংশের একটি শাখা থেকে এসেছিলেন, যা মক্কা শহর হতে হেজাজ ভূমির দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে ইয়েমেনে বসবাস করত। তার পিতার নাম মুহাম্মদ বা মাহমুদ এবং দাদার নাম ইব্রাহিম। শিশুকালে তিন মাস বয়সেই তিনি মাতৃহারা হন এবং পাঁচ বছর বয়সে পিতাকে হারান।

পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তার মামা আহমদ কবির তাকে দত্তক নেন। আহমদ কবির তাকে আরবি ভাষায় কুরআন-হাদিস শিক্ষা দেওয়াসহ ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক বিষয়ে (নামাজ, রোজা) গুরুত্ব প্রদান করেন। পরবর্তীতে আহমদ কবীর তাকে ইয়েমেন থেকে মক্কায় নিয়ে যান, যেখানে তার একটি আস্তানা (হুজরা) ছিল। সেখানেই আহমদ কবির তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলেন।

হজরত শাহজালাল (রাহ.)-এর মামা ও শিক্ষাগুরু ছিলেন শায়েখ সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি, যিনি আহমদ কবির নামেই পরিচিত। আহমদ কবিরের পিতা ছিলেন সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারি, যিনি তার পীর ও মুরশীদও ছিলেন। হজরত শাহজালাল (রাহ.)-কে সুফি মতবাদে দীক্ষিত করাই ছিল আহমদ কবিরের মূল উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যে তিনি মক্কা শহরে সোহরাওয়ার্দি তরিকার প্রবর্তক সিহাবুদ্দীনের প্রতিষ্ঠিত খানকায় (মরমী স্কুল) তাকে ইসলামের শরিয়ত ও মারিফত উভয়ধারায় শিক্ষাদান করেন। জন্মগতভাবেই তিনি দরবেশ পরিবারভুক্ত ছিলেন, কারণ তার পিতা ধর্মানুরাগী মোজাহিদ হিসেবে ইয়ামনে ধর্ম যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন এবং মাতার দিক থেকে তিনি প্রখ্যাত দরবেশ সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারির দৌহিত্র ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই মামা আহমদ কবির তাকে দরবেশি তর্জ-তরিকায় জীবন যাপনের প্রণালি শিক্ষা দিয়েছেন।

আরব দেশে মামা ও শিক্ষাগুরুর আস্তানায় থাকা অবস্থায় হজরত শাহজালাল (রাহ.) ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচারের স্বপ্ন দেখেন এবং তা তার মামা ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবিরকে জানান। আহমদ কবির সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে ভারতবর্ষে যাওয়ার পরামর্শ দেন। যাত্রাকালে তিনি হজরত শাহজালাল (রাহ.)-এর হাতে এক মুঠো মাটি তুলে দিয়ে বলেন: যে স্থানে এই মাটির স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের মিল হবে, সেখানেই ধর্ম প্রচারের জন্য আস্তানা গড়তে হবে।

মুর্শিদের দোয়া নিয়ে তিনি আরবের মক্কা শরিফ হতে একা-একাই ধর্মপ্রচার অভিযানে যাত্রা শুরু করেন। মক্কা হতে বিদায়কালে তার প্রথম সঙ্গীদের মধ্যে প্রধান ছিলেন হাজী ইউসুফ, হাজী খলীল, হাজী দরিয়া এবং মৃত্তিকার তহবিলদার চাশনী পীর। হিন্দুস্থানে আসার পূর্ব পর্যন্ত সমরকন্দ, রোম, বাগদাদ, ইরানসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকে তার অনুগামী হন। এরপর পাঞ্জাবের মুলতান, গুজরাট, আজমির শরীফ ও মধ্যপ্রদেশ থেকে অনেকে তার মুরীদ হয়ে তার সঙ্গে যোগ দেন। এভাবে দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছানোর সময় শিষ্যদের সংখ্যা ২৪০ জন বলে ধারণা করা হয়।

দিল্লিতে পৌঁছানোর পর হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ.) অন্য দুই শিষ্যের মাধ্যমে তার কাছে সালাম পাঠান। জবাবে হজরত শাহজালাল (রাহ.) উপঢৌকনস্বরূপ ছোট একটি বাক্সে প্রজ¦লিত অঙ্গারের মধ্যে কিছু তুলা ভরে পাঠান। এই আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে নিজামুদ্দিন আউলিয়া তাকে সাদরে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। বিদায়কালে প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ.) তাকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। মাজার সংলগ্ন এলাকায় যে সুরমা রঙের কবুতর দেখা যায়, যা জালালি কবুতর নামে খ্যাত, তা ঐ কবুতরেরই বংশধর।

এরপর হজরত শাহজালাল (রাহ.) সেই কাক্সিক্ষত স্থানের সন্ধানে সিলেটের দিকে যাত্রা করেন, যেখানে তার মুর্শিদের দেওয়া মাটির সঙ্গে এখানকার মাটির স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের মিল পাওয়া গিয়েছিল।

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত


শ্রী চৈতন্যদেব

বৈষ্ণব আন্দোলন বা ভক্তি আন্দোলন ছিল চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) প্রবর্তিত একটি যুগান্তকারী ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন, যা মূলত তৎকালীন হিন্দু সমাজের কঠোর জাতিভেদ প্রথা এবং অন্যান্য কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নদীয়ায় শুরু হয়েছিল। এই আন্দোলনকে ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম’ নামেও অভিহিত করা হয়। এর দার্শনিক ভিত্তি ছিল সুফি মতবাদের উদার মানবপ্রেম ও সাম্যনীতির আদর্শের সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের জীবাত্মা-পরমাত্মার তত্ত্বের সংমিশ্রণ, যা অচিন্ত্যদ্বৈতাদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত। এই তত্ত্বে বলা হয় যে, প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমেই পরমাত্মা কৃষ্ণের সঙ্গে একাত্ম হওয়া সম্ভব। চৈতন্যদেব নামসঙ্কীর্তনে নতুন মাত্রা যোগ করে পদযাত্রাসহ নগরকীর্তন প্রবর্তন করেন, যা আন্দোলনকে গণমুখী ও গতিশীল করে তোলে। তার আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুটি : একদিকে স্বধর্ম ও সমাজের সংস্কার করা এবং অন্যদিকে ইসলামের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে মানবতাবাদী উপায়ে মোকাবিলা করা।

চৈতন্যদেবের সময়ে বর্ণভেদ, অস্পৃশ্যতা, সতী প্রথা, কৌলীন্য প্রথা ও বাল্যবিয়ের মতো কঠোর সংস্কারের কারণে হিন্দু সমাজ স্থবির হয়ে পড়েছিল। স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন এই অচলায়তনকে আরো কঠিন করে তোলেন। চৈতন্যদেব দৃঢ়ভাবে প্রচার করেন যে, কৃষ্ণভক্তদের মধ্যে কোনো জাতিকুল বিচার নেই, সবাই সমান। তিনি শাস্ত্রের চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্যকে বেশি গুরুত্ব দেন। ব্রাহ্মণ সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তিনি চণ্ডাল, মুচি, যবন (হরিদাস), কায়স্থ, বৈদ্যসহ সব বর্ণের মানুষকে প্রেমমন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে এক ঐক্যের বন্ধনে বাঁধার চেষ্টা করেন। এতে সামাজিক গতিশীলতার লক্ষণ প্রকাশ পায়। বৈষ্ণব আন্দোলনে সুফিদের পীর-খানকাহ্-এর আদলে গুরু ও আখড়া ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যা ছিল সংগঠনের কেন্দ্র। এই আন্দোলনে নারীরাও ধর্মপ্রচারের অধিকার লাভ করেন (যেমন: জাহ্নবীদেবী, হেমলতা ঠাকুরানী)।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে গ্রহণ করে চৈতন্যদেব তার আন্দোলনকে আরো বাস্তবমুখী ও বেগবান করেন। বৈষ্ণব কবিরা বাংলা ভাষায় অসংখ্য পদ রচনা করেন এবং চৈতন্যদেবের জীবন ও কর্ম নিয়ে চৈতন্যভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত-এর মতো বিশালাকার চরিতকাব্য রচিত হয়, যা একাধারে ধর্ম, ইতিহাস ও সমাজের দলিল হিসেবে বিবেচিত। তবে চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর বেনারসের ষড়গোস্বামী বৈষ্ণব ধর্মনীতিকে নানারূপ আনুষ্ঠানিকতা দান করেন। ফলস্বরূপ, তার হূদয়াশ্রিত প্রেমধর্মের গতি ক্রমশ রুদ্ধ হয়। অন্যদিকে, কিছু উদারপন্থী বৈষ্ণব সহজিয়া মতের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং নিত্যানন্দের অনুসারী একদল নেড়ানেড়ির দল পরবর্তীকালে বাউল সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়। উচ্চবর্ণের রক্ষণশীল অংশের বিরোধিতার ফলে এবং সামাজিক মর্যাদা হারাবার ভয়ে উচ্চবর্ণের লোকেরা মুখ ফিরিয়ে নিলে আঠারো শতকে এই বৈষ্ণব আন্দোলন সামাজিক শক্তি হিসেবে দুর্বল হয়ে পড়ে।

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত


শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের জ্ঞান-সাধনা

প্রাচীন বাংলা আর পশ্চিমবঙ্গের সম্মিলিত ভূখণ্ড রাঢ়, বরেন্দ্র, হরিকেল, সমত ও বঙ্গ-এই ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত থাকার সময়েই এক জ্ঞানদীপ্ত মানুষের জন্ম হয়েছিল। তিনি হলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। ৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে সমতটের প্রধান নগরী বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী জনপদে তার জন্ম। বাবা ছিলেন ধর্মপ্রাণ রাজন্য কল্যাণশ্রী এবং মায়ের নাম প্রভাবতী। বাবা-মা তার নাম রেখেছিলেন ‘চন্দ্রগর্ভ’। তার জন্মস্থান বজ্রযোগিনী আজও তার ভিটা হিসেবে স্থানীয়দের স্মৃতিতে টিকে আছে।

চন্দ্রগর্ভ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ব্যতিক্রমী। মাত্র দশ বছর বয়সেই তিনি যে কোনো বই পড়ার মতো শিক্ষিত হয়ে ওঠেন, যা রাজপুত্রদের জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু রাজকার্য তার লক্ষ্য ছিল না; তিনি চেয়েছিলেন পরিপূর্ণ জ্ঞান। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি রাজপ্রাসাদের নিশ্চিন্ত জীবন ত্যাগ করে দেশান্তরে উচ্চশিক্ষার খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। প্রথম জীবনে তিনি তন্ত্রচর্চায় নিয়োজিত থাকলেও, এক রাতে স্বপ্ন দেখেন স্বয়ং ভগবান বুদ্ধদেব তাকে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছেন। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেবেন।

২৯ বছর বয়সে আচার্য ধর্মরক্ষিত তাকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দেন এবং তখন থেকেই তার নাম হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। দীক্ষার পর তিনি বঙ্গ ও মগধের বিখ্যাত আচার্যদের কাছে দুই বছর পড়াশোনা করেন। তিনি ওদন্তপুরী বিহারে আচার্য ধর্মরক্ষিতের কাছে মহাবিভাষা আয়ত্ত করেন এবং মহাসাঙ্ঘাক, সর্বাস্তিবাদী, সম্মিতীয় ও স্থবিরবাদী—এই চার বৌদ্ধ সম্প্রদায়েরই ত্রিপিটক পাঠ করেন। তন্ত্রচর্চা ছেড়ে বিশুদ্ধ বৌদ্ধ ধর্মচর্চাই তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে।

বুদ্ধদেব দেবতা মানতেন না, তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ নিজের চরিত্র শুদ্ধ করে পরমপদে উন্নীত হতে পারে। তার মতে, তৃষ্ণাই দুঃখের মূল কারণ। বুদ্ধের নৈতিক উপদেশ ছিল পাঁচটি মহাব্রত- প্রাণী বধ না করা, চুরি না করা, মিথ্যা না বলা, মদ না খাওয়া এবং ব্যভিচার না করা। বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধ সমাজ ‘হীনযান’ ও ‘মহাযান’ নামে দু’দলে বিভক্ত হয়ে যায়। মহাযানীরা ধর্মের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় পরবর্তীকালে তা থেকে মন্ত্রযান, বজ্রযান, সহজযান ও কালচক্রযানের মতো বিভিন্ন মতের উদ্ভব হয়। এই সহজযানীরাই ছিলেন তান্ত্রিক বৌদ্ধ বা সিদ্ধাচার্য।

এই সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে ছিল শবরপা (ব্যাধ), মীনপা (জেলে), চমরিপা (মুচি) ও যোগিপা (চণ্ডাল)-এর মতো নিম্নবর্গের মানুষেরা। তারা বাংলা ভাষায় গান রচনা ও গেয়ে ধর্ম প্রচার করতেন। তাদের মূল বক্তব্য ছিল- মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই, সব মানুষই সমান। এটি ছিল তৎকালীন সমাজে এক শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনের জন্ম।

৪৩ বছর বয়সে চারদিকে মহা অশান্তি দেখে অতীশ দীপঙ্কর নিজ দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তিব্বতের রাজার অনুরোধে, অনেক বাধা পেরিয়ে, ৬০ বছর বয়সে (১০৪২ খ্রিষ্টাব্দে) তিনি তিব্বতে পৌঁছান। তিব্বতে তার প্রথম ঘাঁটি ছিল থোলিং বিহার। সেখানে তিনি টানা ১০ বছর কঠোর সাধনা করেন এবং নিজের ঘরের তিনটি দরজায় পার্থিব, ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং তুচ্ছ চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার জন্য চরম প্রতিজ্ঞা লিখে রাখেন। অদম্য জ্ঞান ও সাধনার কারণে তিনি সেখানে ‘জোবো জে’ অর্থাৎ মহাগুরু উপাধি লাভ করেন।

তিব্বতে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ‘বোধি-পথ-প্রদীপ’ বইটি লেখা। এই বইয়ে তিনি মানুষকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেন: ১. অধম : যে শুধু নিজের স্বার্থ ও সংসার-সুখের জন্য কাজ করে। ২. মধ্যম : যে সংসার-সুখের প্রতি উদাসীন, পাপকাজ করে না, কিন্তু শুধুই নিজের ভালোর কথা চিন্তা করে। ৩. উত্তম : যাকে বলা হয় সেই জন, যে নিজেকে কষ্ট দিয়ে সর্বদা অন্যের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করে।

ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মের নামে তিব্বতে তিনি নতুন সভ্যতা, জ্ঞান ও জীবনচর্চার প্রাণ ফিরিয়ে আনতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে শরীরে অসুখ করে এবং তিনি ১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

তিব্বতে তাকে আজও ‘অদ্বিতীয় গুরুরূপে’ স্মরণ করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার চিতাভস্ম তিব্বত থেকে ফিরিয়ে আনে। বর্তমানে ঢাকার কমলাপুর বৌদ্ধবিহারে তার চিতাভস্ম রাখা আছে। হাজার বছর আগে এই মহামানব বলেছিলেন, ‘কখনো নিজের জন্য কিছু করবে না, এমনকি নিজের জন্য বাড়িয়ে যাবে না পুণ্যেরও সঞ্চয়!’ কোনো দেশভেদ ছিল না তার কাছে; তিনি সব দেশকে নিজেরই দেশ বলে বিশ্বাস করতেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানবতার পূজারি হিসেবে পরিভ্রমণ করেছেন।

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত


খাজা খানজাহান আলী

যরত খান জাহান আলী (র.), যার পুরো নাম উলুঘ খানুল আজম খান জাহান, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অসামান্য চরিত্র- একাধারে তিনি ছিলেন বিচক্ষণ যোদ্ধা, ধর্মপ্রাণ সাধক, ইসলাম প্রচারক এবং সফল আঞ্চলিক শাসক। ইসলামের সেবায় তার জীবনের একটা বিশাল অংশ ব্যয় হয়েছে, যার ফলস্বরূপ দক্ষিণবঙ্গে তিনি আজও এক অতি পরিচিত নাম। অর্ধ সহস্র বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তার কীর্তি, বিশেষ করে বাগেরহাটের বিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদ (ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান), আজও অমøান। তার নামের ‘খান উল আজম’ ও ‘উলুঘ’ ছিল সম্মানসূচক উপাধি, যা দ্বারা দলপতি বা আঞ্চলিক শাসনকর্তা বোঝানো হতো।

শিলালিপি থেকে জানা যায়, তিনি তুরস্কের খাওয়ারিজমে (বর্তমান খিবা) জন্মগ্রহণ করেন এবং ঐতিহাসিকদের মতে, তার বাল্যনাম ছিল কেশর খান। চৌদ্দ শতকের শেষের দিকে তিনি পিতা-মাতার সঙ্গে গৌড়ে আগমন করেন। তার বিদ্বান পিতা আজর খান তাকে গৌড়ের প্রখ্যাত ওলী হজরত নূর কুতুবুল আলমের মাদ্রাসায় সুশিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে পাঠান। পিতার মৃত্যুর পর মা আঙিনা বিবির তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হওয়ার সময় তিনি বাদশাহ হোসেন শাহের সুদৃষ্টিতে পড়েন এবং রাজদরবারে স্থান পান। তবে বাদশাহর মৃত্যুর পর দরবারের লোকেরা তার প্রতি বিরূপ হলে, নিরুপায় খান জাহান মায়ের শাহী বেতন-ভাতা নিয়ে তার ওস্তাদ নূর কুতুবুল আলমের কাছে পরামর্শ চান। ওস্তাদ তাকে জৌনপুরের প্রতাপশালী সুলতান ইব্রাহীম শর্কির কাছে প্রেরণ করেন। সুলতান, কুতুবুল আলমকে শ্রদ্ধা করতেন বলে তাকে সাধারণ সৈনিকের চাকরি দেন। নিজের প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তার জোরে খান জাহান দ্রুতই সাধারণ সৈনিক থেকে প্রধান সেনাপতির পদে উন্নীত হন।

সেই সময় গৌড়ের শাসক রাজা গণেশের অত্যাচারে মুসলিম সম্প্রদায় যখন চরম দুর্দশার সম্মুখীন, তখন কুতুবুল আলমের আহ্বানে সুলতান ইব্রাহীম শর্কি তার বিশ্বস্ত সেনাপতি খান জাহান আলীর নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক সৈন্য প্রেরণ করেন। যুদ্ধে রাজা গণেশ পরাজিত হন। যুদ্ধ শেষে সুলতানের অনুমতি নিয়ে খান জাহান তার ওস্তাদের কাছে ফিরে যান। এরপর সুলতানের বারবার আহ্বান সত্ত্বেও তিনি আর ফিরে না গিয়ে চাকরিতে ইস্তফা দেন, যার মাধ্যমে তার সৈনিক জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ওস্তাদ নূর কুতুবুল আলম তাকে কামিলিয়াৎ ও বেলায়তি সম্পর্কে শিক্ষা দেন এবং তার সঙ্গে নিজ কন্যার বিয়ে দেন। কিন্তু সমাজে ইসলাম ও মুসলিমদের দুরবস্থা দেখে তিনি সংসার জীবন ত্যাগ করে সমাজসেবা ও ইসলাম প্রচারে ব্রতী হন।

খান জাহান আলী গৌড় থেকে যাত্রা শুরু করে পদ্মা ও ভৈরব নদী ধরে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ হয়ে যশোরের বারোবাজারে পৌঁছান, যা ছিল দক্ষিণবঙ্গ জয়ের সূচনা। তিনি ১১ জন আউলিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বারোবাজারে কিছুকাল অবস্থান করেন। এরপর তিনি মুরলী ও পায়গ্রাম কসবায় স্বল্প সময় কাটিয়ে ভৈরবের তীর ধরে সুন্দরঘোনায় এসে এক নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম দেন খলিফাতাবাদ (বর্তমানে বাগেরহাট)। এটিই ছিল তার প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু।

খান জাহান আলীর আগমনকালে দক্ষিণবঙ্গের বেশিরভাগ এলাকা ছিল দুর্গম বনাঞ্চল। তিনি ও তার অনুসারীরা বন-জঙ্গল সাফ করে এলাকাটিকে বসবাসের উপযোগী করে তোলেন। কোনো সামরিক বাধা ছাড়াই তিনি এই বিশাল এলাকা শাসন করেন এবং জনগণের সমর্থন লাভ করেন। তবে তিনি স্বাধীন বাদশাহদের মতো জীবনযাপন করতেন না, এমনকি নিজের নামে কোনো মুদ্রাও চালু করেননি। তিনি গৌড়ের সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের সনদ নিয়ে শাসন করতেন। প্রায় ৪০ বছরের শাসনামলে তিনি খলিফাতাবাদকে কেন্দ্র করে থানা, কাচারি, বিচারালয়, সেনানিবাস নির্মাণ করেন এবং পুরো দক্ষিণবঙ্গকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। খলিফাতাবাদে ইসলাম প্রচারের সময় স্থানীয় প্রভাবশালী হিন্দুদের বাধার মুখেও তিনি রণবিজয়পুরসহ বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করে নিজের শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। তার সুশাসন ও বিনয়ী স্বভাবে মুগ্ধ হয়ে মানুষ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি দরগায় আল্লাহর ধ্যানে কাটান এবং ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ অক্টোবর (৮৬৩ হিজরীর ২৬ জিলহজ) মৃত্যুবরণ করেন।

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত


লালন ফকির

লালন শাহ (১৭৭২-১৮৯০) ছিলেন বাউল সাধনার প্রধান গুরু এবং বাউল গানের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা ও গায়ক। তার জন্ম ১১৭৯ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দ)। তার জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, কেউ কেউ ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামকে উল্লেখ করেন, আবার অন্যমতে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর ভাঁড়রা গ্রামে এক কায়স্থ পরিবারে তার জন্ম। যৌবনে তীর্থভ্রমণে গিয়ে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করে। তখন সিরাজ সাঁই নামে এক মুসলমান ফকির তাকে সেবা-শুশ্রƒষা করে সুস্থ করে তোলেন। পরবর্তীকালে লালন তার কাছে বাউলধর্মে দীক্ষিত হন এবং ছেউড়িয়াতে একটি আখড়া নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। তার কোনো সন্তান না থাকলেও বহু শিষ্য ছিল।

তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, কিন্তু নিজের সাধনার মাধ্যমে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের শাস্ত্র সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি আধ্যাত্মিক ভাবধারায় প্রায় দুই হাজার গান রচনা করেন, যা মরমি ব্যঞ্জনা ও শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। তার সহজ-সরল ভাষার গান গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ও মর্মস্পর্শী, যেখানে মানব জীবনের আদর্শ, মানবতাবাদ এবং অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। লালন জাতিভেদ মানতেন না; তিনি গেয়েছিলেন: ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/লালন কয় জাতির কি রূপ দেখলাম না এ নজরে।’ এই সর্বজনীন ভাবরসের কারণে তার গান বাংলার উভয় সম্প্রদায়ের কাছে সমান জনপ্রিয়। তার ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘বাড়ির কাছে আরশী নগর’ এবং ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে’ ইত্যাদি গান বাউল তত্ত্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

বহু তীর্থভ্রমণ ও সাধু-সন্ন্যাসীদের সাহচর্য লাভের পর তিনি ছেউড়িয়ার আখড়ায় আজীবন সাধনা ও সঙ্গীতচর্চা করেন। তার লেখা গানের কোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি; সম্ভবত তার শিষ্যরাই পরবর্তীতে সেগুলো সংগ্রহ ও সংকলন করেন। কুষ্টিয়ার কাঙাল হরিনাথ এবং মীর মশাররফ হোসেন তার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে থাকাকালীন লালন শাহের ২৯৮টি গান সংগ্রহ করেন এবং সেগুলোর মধ্যে ২০টি প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেন। তিনি তার মানবধর্ম সম্পর্কিত প্রবন্ধ ও বক্তৃতায়ও লালনের গানের উল্লেখ করেন। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৭ অক্টোবর, ১৮৯০) ছেউড়িয়ায় লালন পরলোক গমন করেন। প্রতিবছর দোল পূর্ণিমা ও মৃত্যু বার্ষিকীতে তার ভক্তরা তার মাজারে সমবেত হয়ে সাধুসেবা ও সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

কেকে/এমএ
আরও সংবাদ   বিষয়:  বাংলার সাধক   ভাবুক  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

একান্নবর্তী ভাঙছে, কৃষি জমি কমছে
কাপাসিয়ায় অবৈধ কয়লা চুল্লি পুনরায় চালু, পরিবেশ বিপর্যস্ত
শেখ হাসিনার ২১ বছরের কারাদণ্ড
গোয়ালন্দে ফেরি থেকে জুয়ারি চক্র আটক
দারিদ্র্য বৃদ্ধির আশঙ্কা, নীতি সংস্কারে জোর দিন

সর্বাধিক পঠিত

বাঞ্ছারামপুরে বিএনপির মহাসমাবেশে লাখো মানুষের ঢল
চট্টগ্রামে কবির হোসেন সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ১৮ কোটি টাকার ঋণখেলাপির মামলা
বিএনপি'র প্রার্থী পরিবর্তনের দাবীতে ফটিকছড়িতে মশাল মিছিল
বেনাপোলে বিএনপির উঠান বৈঠক, উন্নয়ন ভাবনা তুলে ধরলেন তৃপ্তি
বেনাপোলে বিজিবি'র অভিযান, চোরাচালান পণ্যসহ আটক ২
সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close