বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নানা দিক থেকে দ্রুত সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তবে এ সম্প্রসারণের পেছনে রয়েছে একগুচ্ছ দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক চ্যালেঞ্জ, পরিকল্পনার ঘাটতি, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এবং সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার দুর্বলতা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চাহিদা কমে যাওয়া সত্ত্বেও, উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এবং স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং একটি নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার এ অস্থির পরিস্থিতি অর্থনীতি, শিল্প, কৃষি, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও জাতীয় উন্নয়নের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের আর্থিক সংকট :
পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের অধীনস্থ নিজস্ব ও আইপিপিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর গড় উৎপাদন খরচ বর্তমানে ১২.২১ টাকা প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টা। কিন্তু পিডিবি যে দামে বিভিন্ন ইউটিলিটির কাছে বাল্ক বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে তা মাত্র ৬.৬৫ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি বিদ্যুৎ ইউনিটেই ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এর ফলে পিডিবির বার্ষিক বিল প্রদানের পরিমাণ হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, যেখানে বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে অর্জিত আয় মাত্র ৬৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যই তৈরি করছে ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট ঘাটতি। এ ঘাটতি পূরণে সরকারি ভর্তুকির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, কিন্তু দেশের আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় পিডিবি
সবসময়ই প্রয়োজনীয় ভর্তুকি পাচ্ছে না। বাজেট ঘাটতির সমপরিমাণ অর্থ সরকার থেকে ভর্তুকির মাধ্যমে না পাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোকে সময়মতো বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারছে না। ফলস্বরূপ, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানির অভাবে বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
বলাবাহুল্য, গত বছরের তুলনায় দেশে গড়ে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন স্থানে লোডশেডিং লক্ষণীয়। পরিকল্পনার এতই অভাব ছিল যে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ১২ বার বিদ্যুতের মূল্য ১১৩ শতাংশ বৃদ্ধি করেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে সৃষ্ট বাজেট ঘাটতি নিরসনে সফল হয়নি। এ বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে, যা দেশের বর্তমান আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে প্রদান করা দুরূহ। অথবা বিকল্প হিসাবে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে তার বাল্ক বিদ্যুৎ বিক্রয় মূল্য গড়ে ৫ টাকা বৃদ্ধি করে এ ঘাটতি সমন্বয় করতে হবে। যদি এ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বাস্তবায়িত হয়, তবে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
অস্থিতিশীলতার মূল কারণগুলো :
এ সংকটের পেছনে রয়েছে বহু বছরের নীতিনির্ধারণের ব্যর্থতা এবং অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। প্রথমত অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। দেশে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, বরং ফুয়েল মিক্স পরিকল্পনায় লিকুইড ফুয়েল এবং আমদানিনির্ভর এলএনজিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত জ্বালানির প্রায় ৬৫ শতাংশই আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে।
দেশে বর্তমানে স্থাপিত মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৮ হাজার ৩৫৯ মেগাওয়াট। কিন্তু ৩০ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল মাত্র ১৭ হাজার মেগাওয়াট এবং সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। অর্থাৎ প্রায় ১১ হাজার ৮৮২ মেগাওয়াট অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। শীতকালে গড় চাহিদা কমে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট, তখন অব্যবহৃত ক্ষমতা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ২১ হাজার ৪৫৯ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রেও পরিকল্পনাহীনতা লক্ষ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, খুলনায় গ্যাসের অভাব থাকা সত্ত্বেও রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেঘনা ঘাটে গ্যাসের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও রিলায়েন্স এবং অন্যান্য কম্বাইন্ড সাইকেলকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। আবার দেশে লিকুইড ফুয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর অনুপাত অত্যধিক, যার সংখ্যা প্রায় ২৩ শতাংশ বা ৬ হাজার ৪০৯ মেগাওয়াট। উচ্চ উৎপাদন ব্যয়ের এসব কেন্দ্র অনুমোদনের ফলে গড় খরচ বেড়েছে। বিশেষ করে এগ্রেকো এবং ম্যাক্স পাওয়ারের মতো একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অতি-উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ এ খাতকে আরো ব্যয়বহুল করে তুলেছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ অনশোর গ্যাস উত্তোলনের পদক্ষেপ এবং অফশোর গ্যাস প্রাপ্যতার সম্ভাব্যতা যাচাই না করার কারণে দেশে গ্যাস উত্তোলন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য পরবর্তিতে বেশ কিছু গ্যাস/এলএনজিভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি প্রদান করে। ফলে আমদানিভিত্তিক এলএনজির ওপরে দেশের নির্ভরতা বেড়ে যায়। গ্যাস উৎপাদন, গ্যাস সঞ্চালন লাইন ও এফএসআরইউর সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে এলএনজি আমদানি করেও বিদ্যুৎ খাতের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস/এলএনজি সরবারহ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অপ্রতুল গ্যাস/এলএনজি সরবরাহের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে সক্ষম হয়নি।
উল্লেখ্য, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত জ্বালানির প্রায় ৬৫ শতাংশ আমদানিনির্ভর। আমাদের দেশের মোট স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় ২৩ শতাংশ (৬ হাজার ৪০৯ মেগাওয়াট) লিকুইড ফুয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার একটি বড় অংশ অপরিকল্পিতভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থাপন করা হয়। যার ফলস্বরূপ গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
২০১৭ সালে ১ হাজার মেগাওয়াট ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, যার উৎপাদন খরচ অত্যন্ত বেশি এবং প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর ২ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে ছিল। এগুলোও গড় ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলেও, সেই কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রেখে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন এবং সমন্বিত সাব-স্টেশন নির্মাণ করা হয়নি। যার ফলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে বণ্টন সম্ভব হয়নি।
সঞ্চালন ব্যবস্থার দুর্বলতা :
বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সঞ্চালন এবং সাব-স্টেশন নির্মাণ করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট উৎপাদন থাকা সত্ত্বেও সঞ্চালন ক্ষমতার অভাবে বিদ্যুৎ বিতরণ করা সম্ভব হয় না। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, মেঘনা ঘাটে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট এবং আমিনবাজারে ২০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ বিতরণ করা যাচ্ছে না শুধু গ্রিড সাব-স্টেশনের সীমাবদ্ধতার কারণে।
এ ছাড়া গ্যাস অনুসন্ধান বা উত্তোলনে পর্যাপ্ত উদ্যোগ না নেওয়ায় দেশে প্রতি বছর গ্যাস উৎপাদন কমছে ১০০ এমএমসিএফডি হারে। পেট্রোবাংলা ২০২৮ সালের মধ্যে ৬৯টি নতুন কূপ খনন এবং ৩১টি পুরোনো কূপ ওয়ার্কওভার করার পরিকল্পনা করলেও তা বিদ্যমান ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট নয়।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা :
উন্নত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হলে চাহিদাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ গ্যাস উত্তোলন বৃদ্ধি, দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি চুক্তি, নিরবচ্ছিন্ন সঞ্চালন ব্যবস্থা এবং ব্যয়বহুল কেন্দ্রগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ করার মতো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে এলএনজি আমদানিতে বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৫৮০ বিলিয়ন টাকা, বিপরীতে গ্যাস অনুসন্ধান ও কূপ খননে বরাদ্দ মাত্র ১১.২৯ বিলিয়ন টাকা, যা আমদানিনির্ভরতার ঝুঁকি আরো বাড়াচ্ছে। ২০২৮ থেকে ২০৩৬ সালের মধ্যে লিকুইড ফুয়েলভিত্তিক ৪ হাজার ৩৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। তখন পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু কেন্দ্র বন্ধ করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন ফুয়েল-ইফিসিয়েন্ট কেন্দ্র স্থাপন করার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে।
উপরে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত পিডিবির বাজেট ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তাই বিশেষ তহবিল, সরকারি ভর্তুকি বা আন্তর্জাতিক আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে অস্থায়ীভাবে ঘাটতি পূরণ করতে হবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, জ্বালানি নীতির সংস্কার এবং উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার সমন্বিত উন্নয়ন। বিদ্যুৎ খাতের অবস্থা আজ যে পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাই সময়ের দাবি।
কেকে/এমএমএ