অনিয়ম, দুর্নীতি ও আত্মসাৎ পিছু ছাড়ছে না ময়মনসিংহের নেত্রকোনা জেলা খাদ্য বিভাগের। পরিস্থিতি যেন ‘মঘের মুল্লুক’। দুর্নীতিবাজদের লাগাম টানতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে বেড়েই চলেছে আর্থিক অপরাধের ঘটনা। কেন্দুয়া উপজেলার ৯৩৯৯ কর্মহীন ও দরিদ্র মানুষের দুই মাসের ৫৬৪ টন চাল আত্মসাৎ করার ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। অর্থনৈতিক মূল্য অনুযায়ী আত্মসাৎ করা চালের দাম প্রায় তিন কোটি ২৭ লাখ টাকার বেশি।
গতকাল বুধবার রাতে এ খবর লেখার সময় পর্যন্ত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা চালানো হয়। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অদক্ষতার কারণে নেত্রকোনায় অপরাধের মাত্রা বেড়েছে বলে সূত্র দাবি করেছে।
সূত্রমতে, চাল আত্মসাতের সঙ্গে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কাওসার আহমেদ ও সাবেক ওসিএলএসডি মো. মোতাকাব্বির খান প্রবাস জড়িত। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও আওয়ামী পরিবারের এ দুই সদস্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তারা এর আগেও অনিয়ম ও দুর্নীতি করে অদৃশ্য খুঁটির জোড়ে পার পেয়ে যান।
সূত্র জানায়, খাদ্যবান্ধব কর্র্মসূচির ৫৬৪ টন চাল আত্মসাতের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করলেও কোনো অগ্রগতি নেই। সীমাবদ্ধতার কারণে কমিটি শেষ পর্যন্ত তদন্ত কাজ এগিয়ে নিতে পারবে না বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এই কমিটির প্রধান হিসেবে আছেন মোহনগঞ্জের উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. লুৎফর রহমান। সদস্য রয়েছেন- নেত্রকোনা সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক খন্দকার মুনতাসির মামুন ও তার অফিসের খাদ্য পরিদর্শক মো. কামরুল হাসান।
সূত্র মতে, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক চতুরতার আশ্রয় নিয়ে ব্যাক ডেটে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্যরা সোমবার কেন্দুয়ায় গিয়ে প্রয়োজনীয় নথি না পেয়ে ফিরে আসেন। তিন কর্মদিবস চলে গেলেও গতকাল বুধবার পর্যন্ত তারা আর অগ্রসর হননি। ভুক্তভোগীরা উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির দাবি জানিয়েছেন। নিরপেক্ষ ও সঠিক তদন্ত ছাড়া ঘটনার বিচার পাওয়া যাবে না বলেও তারা জানান।
অন্যদিকে ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর থেকেই উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইমদাদুল হক তালুকদার ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে সাক্ষ্য নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এর আগে উপকারভোগীরা তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।
জানা যায়, কেন্দুয়ার উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কাওসার আহমেদ ও বদলি হয়ে যাওয়া ওসিএলএসডি মো. মোতাকাব্বির খান প্রবাস অন্যদের যোগসাজশে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৫৬৪ টন চাল আত্মসাৎ করেন। উপজেলার ১৩ ইউনিয়নের ৯৩৯৯ কর্মহীন ও দরিদ্র মানুষের নামে ১৫ টাকা কেজির চালগুলো বরাদ্দ করা হয়েছিল। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে তাদের ৩০ কেজি করে ৬০ কেজি চাল পাওয়ায় কথা। একযোগে ২৬ জন ডিলারের চালগুলো বিতরণ করার কথা ছিলো। ডিওর মাধ্যমে গুদামের স্টক থেকে ৫৬৪ টন চাল বিতরণ দেখানো হলেও বাস্তবে কাউকেই চাল দেওয়া হয়নি। জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজে ডেলিভারি দেখিয়ে চাল আত্মসাৎ করা হয়।
সূত্র মতে, এর আগে কখনো আগস্ট মাসে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। বছরে পাঁচ মাসের স্থলে এবার ছয় মাস অর্থাৎ আগস্ট মাসের বরাদ্দ বাড়ানো হয়। এর সুযোগ নেন ‘ধুরন্ধর’ কাওসার ও প্রবাস। তাদের ধারণা ছিল আগস্ট মাসের চাল মেরে দিলে উপকারভোগীরা টের পাবেন না। এ পরিকল্পনায় অতিমাত্রায় লোভে পড়ে তারা আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের ৫৬৪ টন চালের পুরোটাই আত্মসাৎ করে ফেঁসে যান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ডিলার দৈনিক খোলা কাগজকে জানান, চাল আত্মসাতের ঘটনায় আমরা হতবাক হয়েছি। আমাদের নামে ব্যাংক চালান দিয়ে চাল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। আমরা ডিলার বেশিকিছু বলতে গেলে নানান অসুবিধায় পড়ব। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ডিলারশিপ নবায়নের কথা বলেও আমাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩০ হাজার করে টাকা নিয়েছেন। অন্যদিকে অর্ধেকের বেশি কার্ডধারীর কাছ থেকেও তিনি এক হাজার করে টাকা আদায় করেন। আমাদের না জানিয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ডিও ইস্যু এবং চাল ডেলিভারি দেখিয়ে ৫৬৪ টন চালের পুরোটাই আত্মসাৎ করা হয়।
এ বিষয়ে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কাওসার আহমেদ বলেন, আগস্ট মাসের চাল বিক্রির ক্ষেত্রে কিছুটা অনিয়ম হয়েছে। সুবিধাভোগীরা নিয়ম অনুযায়ী চাল পাননি। সূত্র মতে, আত্মসাৎ করা ৫৬৪ টন চালের অর্থনৈতিক মূল্য তিন কোটি ২৭ লাখের বেশি। ‘ধুরন্ধর’ কাওসার ও প্রবাস তাদের লোক দিয়ে ডিলারদের নামে ৭৩ লাখ ৩২ হাজার টাকার চালান জমা দেন।
সূত্র জানায়, কেন্দুয়ার সাবেক ওসি এলএসডি মো. মোতাকাব্বির খান প্রবাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। তার ছোট ভাই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক। প্রবাস ছাত্রলীগের দোহাই দিয়ে নেত্রকোনা খাদ্য বিভাগে আধিপত্য বিস্তার করেন। এর আগে মোহনগঞ্জ গুদামের দায়িত্বে থাকার সময় চাল নয়ছয় করার ঘটনায় জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে বিরোধে জড়ান। ওই যাত্রায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যান।
কেন্দুয়ায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল আত্মসাতের অভিযোগ সম্পর্কে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আশরাফুল আলম বুধবার রাতে দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তদন্ত কাজ চালাচ্ছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেকে/এমএ