সরকারি অর্থায়নে আত্মরক্ষা এবং আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে প্রায় ৯ হাজার তরুণ-তরুণীকে। এই প্রশিক্ষণটি হচ্ছে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার একক উদ্যাগে। বিকেএসপির সাতটি আঞ্চলিক কেন্দ্রে চলতি মাসেই শুরু হবে ১৫ দিনের এই আবাসিক প্রশিক্ষণ। বিষয়টি নিয়ে সচেতন মহলে উঠেছে সমালোচনার ঝড়।
বিশিষ্টজনেরা বলছেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের স্বেচ্ছাচারিতা জাতি অবলোকন করছে। তারই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এই উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। বাস্তবতা হলো—দেশের টাকা খরচ করে নিজস্ব বাহিনী গড়ার চেষ্টা করছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
সরকারি নথিতে এই বিষয়টিকে বলা হয়েছে—‘আত্মরক্ষামূলক মৌলিক প্রশিক্ষণ’, তবে প্রকল্পের কাঠামো, তহবিলের উৎস এবং উপদেষ্টার নিজস্ব বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—সরকারের অর্থে উপদেষ্টা আসিফের নেতৃত্বে একটি নিয়ন্ত্রিত অঘোষিত রিজার্ভ বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এখন জাতির সামনে প্রশ্ন আসছে—দেশে কী এমন নিরাপত্তা সংকট তৈরি হয়েছে যে কারণে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে অঘোষিত রিজার্ভ বাহিনী গড়ে তুলতে হবে? শুধু একটি মন্ত্রণালয় বা একজন উপদেষ্টার চাওয়ায় এমন একটি স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কী?
এ বিষয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ভাষ্য, ‘এটি হচ্ছে গণপ্রতিরক্ষা বাস্তবায়নের জন্য, বাংলাদেশের ভৌগোলিক বাস্তবতায় যা অপরিহার্য। আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা ভবিষ্যতে দেশের রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে কাজ করতে পারবে।’
কিন্তু প্রকল্পটি কোনো জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতিমালার আওতায় নয়, সরাসরি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে অনেক প্রশ্ন। অনেকেই মনে করেন—এটা (প্রশিক্ষণ) কার্যত ব্যক্তিকেন্দ্রিক শক্তি জোগানের উদ্যোগ। সরকারের তহবিল ব্যবহার করে উপদেষ্টার অধীনে ‘বাহিনী’ গঠন করা হচ্ছে। যা অনেকটা একাত্তর-পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবের ‘রক্ষী বাহিনী’ গঠনের একটি নমুনা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে যে প্রশিক্ষণ আছে, সেটার ব্যাপারে একটা ডিটেইল ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি আছে। যেটা কোনো মন্ত্রণালয় করে না। সেটা দেশের পার্লামেন্টে পাস করে একটা নীতিমালা করা হয়। খুবই বিশদভাবে এটা করা হয়। কাজেই সে ধরনের কোনো জাতীয় কৌশল-নীতি আমাদের কাছে নাই। ফলে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে- একটি মন্ত্রণালয়ের ধারণা থেকে এটা আসছে, কাজেই কোনো জাতীয় নীতিমালা আছে বলে আমি মনে করছি না। এ ধরনের কার্যক্রম জাতীয় নীতিমালা ছাড়া করা যায় না। কারণ এর সঙ্গে স্পর্শকাতর জিনিসপত্র জড়িত থাকে, জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত থাকে এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ভালো হতে পারে বা খারাপও হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটা অবনতি লক্ষ্য করা গেছে। আন্দোলনের সময় লুট হওয়া পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বহু অস্ত্র-গুলি এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া অবৈধ অস্ত্রের উপস্থিতি ধরা পড়ছে। এ রকম একটা অবস্থায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ কারা পাবে এবং সেটি কীভাবে তারা কাজে লাগাবে সেই সন্দেহ থেকেই যায়।’
মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘কী ধরনের লোক এখানে প্রশিক্ষণ পাচ্ছে, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড যদি চেক করা না হয়, তাহলে হয়তো ভুল কিছু লোক প্রশিক্ষণ পেয়ে যেতে পারে। যদি ভুল কিছু লোক প্রশিক্ষণ পেয়ে যায়, তারা প্রশিক্ষণ পাওয়ার পরে সেটা যদি অন্য কাজে ব্যবহার করে, তাহলে দেশের জন্য ভালোর চাইতে খারাপ হয়ে যাবে।’
এ ছাড়া সরকারের এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমি মনে করি এটা একটা রেটরিক। আমাদের এখানে অনেকদিন ধরে বাগাড়ম্বরের রাজনীতি চলছে। কিছুদিন আগে জামায়াতে ইসলামী বলছিল যে, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ লাগলে বা কেউ আক্রমণ করলে আমাদের পঞ্চাশ লাখ লোক দাঁড়িয়ে যাবে। তারপরে আমরা শুনলাম যে, আট হাজার প্রশিক্ষণ নেবে। তো পলিটিক্যাল পার্টির লোকেরা এগুলো বলে। আমার কাছে রেটরিকই মনে হয়। এগুলো দিয়ে রাজনীতি করা মানে এক ধরনের জিঙ্গুইজম করা। অর্থাৎ প্রচণ্ড রকমের উন্মাদনা সৃষ্টি করা রাজনীতিতে এবং এটা করে হাততালি পাওয়া।’
এ বিষয়ে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভবিষ্যতে এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নাগরিকরা দেশের রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। দেশের ক্রান্তিকালে প্রয়োজনে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে। নভেম্বর মাস থেকেই এই প্রশিক্ষণ শুরু হতে যাচ্ছে, এখন চলছে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম।’
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আরো বলছেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করতে তরুণদের প্রশিক্ষিত করার জন্য এটি পাইলট প্রকল্প। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আইডিয়াটা হচ্ছে গণপ্রতিরক্ষা বাস্তবায়ন করা। আমাদের সামরিক এবং ভৌগোলিক বাস্তবতায় এটা আমাদের জন্য অপরিহার্য। সবসময় যে যুদ্ধ করতে হবে এমন নয়; কিন্তু তারপরেও একটা মোরাল থাকা যে, রিজার্ভ ফোর্সের সংখ্যাটা বাড়ছে।’
আসিফ মাহমুদ বলছেন, ‘যে ভৌগোলিক সামরিক অবস্থান বাংলাদেশের আছে, সেখানে গণপ্রতিরক্ষা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো উপায় নাই। তিনি বলেন, কারো যদি মৌলিক প্রশিক্ষণ থাকে, সে এটলিস্ট জানবে কীভাবে একটা অস্ত্র চালাতে হয়। তার হাতে অস্ত্র তুলে দিতে পারলে দেশকে সার্ভ করতে পারবে। তরুণ-তরুণীদের জুডো কারাতে তায়কোয়ান্দো এবং শুটিংয়ের মৌলিক প্রশিক্ষণ কেবল আত্মরক্ষাই নয়, এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যতে রিজার্ভ ফোর্সের বৃদ্ধির কৌশল বলছেন ক্রীড়া উপদেষ্টা।’
তিনি আরো জানান, ‘এই প্রশিক্ষণে সরাসরি বুলেট ফায়ারিং শেখানোর ইচ্ছা থাকলেও গুলির অনুমোদন, বাজেট ও অবকাঠামো জটিলতার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি।’
তরুণরা অস্ত্র হাতে কী ধরনের প্রশিক্ষণ পাবে—এ প্রশ্নে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘গুলি ছোড়া বাদে অস্ত্র চালানোর সবকিছুই শেখানো হবে। ফায়ারিংয়ের থিওরিটিকাল দিকটা শেখানো হবে—একইসঙ্গে প্রাকটিক্যাল দিকটাও শেখানো হবে।’
তিনি বলেন, ‘এইম করা, তারপর পজিশনিং করা, ফলো থ্রু করা, তারপর ট্রিগার করা। তবে সরাসরি ফায়ারিং করাটার অনুমতি সংক্রান্ত অনেকগুলো বিষয় আছে, আমাদের অ্যামুনেশন লাগবে। সবকিছু মিলিয়ে ওইটাতে আমরা এখনই যেতে পারছি না। তবে ভবিষ্যতে আমার মনে হয় যে, আরো বড় পরিসরে করার সুযোগ এবং প্রয়োজনীয়তা রয়েছে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে।’
এই প্রশিক্ষণ কেন প্রয়োজন এ প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, ‘গণপ্রতিরক্ষার আইডিয়া থেকেই তার মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগ নিয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণকে প্রতিরক্ষার দিক থেকে সচেতন করা এবং ন্যূনতম প্রশিক্ষণ দেওয়াটাই উদ্দেশ্য। যদি কখনো সে রকম পরিস্থিতি আসে বাংলাদেশে- সংকটময় মুহূর্ত আসে তবে মানুষ যাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।’
উপদেষ্টা আসিফ বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে যে, দেশে যদি কখনো সিকিউরিটি ক্রাইসিস হয় এবং আমাদের যে ভৌগোলিক বাস্তবতা সেটা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। পৃথিবীতে আমরা ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজায় যুদ্ধ দেখেছি। কথায় কথায় যুদ্ধ বেঁধে যাচ্ছে। প্রস্তুতি থাকতে তো সমস্যা নাই।’
ভবিষ্যতে অবকাঠামো এবং বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে প্রতি বছর কমপক্ষে বিশ হাজার যুবকদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে বলে জানান যুব ও ক্রীড় উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে সরাসরি গুলি চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে তরুণদের প্রশিক্ষিত করা দরকার।’
‘লাইভ রাউন্ড ফায়ারিং পর্যন্ত যদি শেখানো যায়, তাহলে আমার মনে হয়, এটা গণপ্রতিরক্ষার জন্য, জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি হবে। ইয়ারলি বিশ হাজারজনকে প্রশিক্ষণ দিতে পারি তাহলে এটাও আমাদের জন্য বড় অর্জন হবে। দশ বছরে ট্রেইন্ড ফোর্স বেড়ে যাচ্ছে দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার। যেটা হিউজ এবং এটা রিজার্ভ ফোর্সে অন্তর্ভুক্ত হবে’ বলেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
উল্লেখ্য, বিকেএসপির সাতটি আঞ্চলিক কেন্দ্রে নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে ১৫ দিনের আবাসিক প্রশিক্ষণ। এতে অংশ নিচ্ছেন ৮২৫০ তরুণ ও ৬০০ তরুণী। প্রশিক্ষণার্থীরা ৪২০০ টাকা ভাতা, পোশাক, থাকা-খাওয়ার সবকিছুই পাবেন সরকারি টাকায়। প্রশিক্ষণে শেখানো হবে জুডো, কারাতে, তায়কোয়ান্দো ও শুটিংয়ের মৌলিক কৌশল। আর এতে আবেদন করতে পারবেন ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নাগরিকরা।
কেকে/এজে