বাংলাদেশ আবারো এক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিতর্কিত সুপারিশমালা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন ক্ষমতার টানাপোড়েন। যদিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘সংকট’ শব্দটি নতুন নয়। কিন্তু এবার পার্থক্য হলো- এই সংকট সমাধানের কোনো নেতা নেই, কোনো নিশ্চিত দিকনির্দেশনা নেই। সরকার নিজের অবস্থান রক্ষায় ব্যস্ত, বিরোধীরা দ্বিধায়, ছোট দলগুলো বিভক্ত, আর জনগণ উদাসীন। এমন পরিস্থিতিতে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সোজাসাপটা বলেন, ‘দেশ এক বিরাট সংকটে পড়েছে, আর এই সরকার সেই সংকট উদ্ধার করার ক্ষমতা রাখে না।’এবারের সংকটের উৎস জুলাই জাতীয় সনদ ও তার বাস্তবায়ন নিয়ে। এই সনদ অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা ও রাজনৈতিক রূপরেখার কেন্দ্রবিন্দু। এই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত মঙ্গলবার তাদের সুপারিশমালা জমা দেয় অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে। কিন্তু কমিশনের সুপারিশই এখন নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। বিএনপি সরাসরি বলেছে, এটি অগ্রহণযোগ্য। কারণ, আলোচনায় যেসব বিষয়ে মতবিরোধ ছিল বা আলোচনায় আসেনি, সেগুলোও সুপারিশে ঢোকানো হয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা যে বিষয়গুলো নিয়ে দ্বিমত জানিয়েছি, সেগুলো বাদ দিয়ে এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেগুলো আলোচনা হয়নি। এটা ঐকমত্য নয়, একতরফা প্রস্তাব।’
সুপারিশে বলা হয়েছে, একটি সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করা হবে এবং গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অনুমোদন নেওয়া হবে। গণভোটের সময় হবে- ‘নির্বাচনের আগে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা নির্বাচনের দিন’- এই অস্পষ্ট বাক্যই বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু।
এদিকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি চায় নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট। তাদের দাবি, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যতদিন দেরি করবে, ততদিন বৈধতা হারাবে।’ গত বৃহস্পতিবার তারা নির্বাচন কমিশনের সামনে বিক্ষোভ করে গণভোটের তারিখ নির্ধারণের দাবিতে স্মারকলিপি দেয়। অপরদিকে বিএনপি গণভোটের আগে নির্বাচনকালীন পরিবেশ ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে চায়। তাদের মতে, এই সরকারের হাতে গণভোট মানে একতরফা জনমত সংগ্রহ। এই বিরোধ থেকেই এখন যে গভীর সংকট বাস্তব রূপ নিচ্ছে।
বল এখন বিএনপির কোটে উল্লেখ করে গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে জেএসডির ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সভায় মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বর্তমান বাস্তবতায় আমি মনে করি, দেশ এক বিরাট সংকটে পড়েছে। এখন নির্ভর করছে মির্জা ফখরুল ভাইয়েরা কী করেন তার ওপর। এই সরকারের কোনো ক্ষমতা নেই এই সংকট থেকে উত্তরণের।’ তিনি বলেন, ‘আমি বিএনপি করি না, বিএনপি সবচেয়ে ভালো দলও বলি না। কিন্তু এখন রিলে রেসের কাঠি বিএনপির হাতে। তারা যদি দায়িত্ব না নেয়, দেশ আরো নিচে নামবে।’
এ সময় তিনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকে ‘নির্বুদ্ধিতা, বোকামি ও মূর্খতা’ বলে আখ্যা দেন। বলেন, বুঝলে ওরা বিএনপির সঙ্গে বা আমাদের সঙ্গে কথা বলত। কারো সঙ্গে কথা না বলে নিজেদের মতো করে ফেলেছে। এখন সেটা হজম করতে হবে।’
জেএসডির সহ-সভাপতি তানিয়া রব বলেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়েছিলাম, কিন্তু প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছি। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার পরে এখন ভাবছি- আমরা ঠিক করেছিলাম কি না।’ তিনি এনসিপিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোমরা দেশের ভালোটা বোঝার চেষ্টা করো। এখন তোমরা এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছো, যেগুলো রাষ্ট্রকে অজানা আতঙ্কের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’ এই মন্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে- অন্তর্বর্তী সরকারের জোটভিত্তিক সমর্থন এখন ভেতর থেকে ফাটল ধরছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, বর্তমান পরিস্থিতি কেবল রাজনৈতিক বিরোধ নয়; এটা কাঠামোগত এক অচলাবস্থা। তারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার সাংবিধানিকভাবে কতটা বৈধ, তা নিয়েই অনিশ্চয়তা। কমিশনের প্রস্তাবগুলোতে যে গণভোটের কথা বলা হয়েছে, সেটি আইনি কাঠামোতে কীভাবে হবে, তা অস্পষ্ট। আইন না বদলে গণভোট হলে সেটা সংবিধানবহির্ভূত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা যেতে পারে।
সরকার এবং বিএনপির মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে তারা বলেন, বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক কখনোই তৈরি হয়নি। এর মধ্যে ছোট দলগুলোর হতাশা, জামায়াতের একক কর্মসূচি, আর কমিশনের ‘অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস’- সব মিলে এখন কারো ওপর কারো আস্থা নেই।
অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষকরা বলেন, ‘রাজনৈতিক সংকট মানেই বিনিয়োগ ঝুঁকি। বিদেশি উন্নয়ন অংশীদাররা এখন অপেক্ষায় আছে- এই সরকার টিকবে কি না, নির্বাচন হবে কি না। এই অনিশ্চয়তা যতদিন থাকবে, অর্থনীতি ততদিন স্থবির থাকবে।
সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া এখনো আসেনি। তবে নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ এখনো চূড়ান্ত নয়। আলোচনার সুযোগ আছে। তবে বিএনপি ও অন্য দলগুলো এই ব্যাখ্যায় আশ্বস্ত নয়। একজন প্রাক্তন সচিবের ভাষায়, ‘সমস্যা হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল শক্তি ছিল নৈতিক বৈধতা। এখন সেটাই প্রশ্নের মুখে।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, নভেম্বরের মধ্যে যদি গণভোটের রূপরেখা নির্ধারিত না হয়, তাহলে বিরোধী দলগুলো আবারো রাস্তায় নামবে। জামায়াত ইতোমধ্যে কর্মসূচির প্রস্তুতি নিচ্ছে, এনসিপি ‘দেশব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি’ ঘোষণা করেছে। এই অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো নাজুক হতে পারে। তারা বলছেন, বাংলাদেশ এখন এমন এক অবস্থায় আছে, যেখানে রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত মানে প্রশাসনিক বিপর্যয়। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে আবার আলোচনায় ফিরতে হবে।
যদি দ্রুত আস্থা ও আলোচনার পরিবেশ তৈরি না হয়, তাহলে এই সংকট কেবল রাজনৈতিক অস্থিরতা নয়- একটি দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় অচলাবস্থায় রূপ নিতে পারে। এখন সামনে প্রশ্ন একটাই- বিএনপি কি সত্যিই রিলে রেসের কাঠি ধরবে, নাকি সবাই মিলে দেশের রাজনীতিকে আরো এক অনিশ্চিত পথে ঠেলে দেবে?
কেকে/এআর