ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতনের পর নানাভাবে দেশের রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু গণহত্যার দায় মাথায় নিয়ে কোনোভাবেই ফিরতে পারছে না তারা। বরং দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দলটির নিবন্ধনও স্থগিত। এ ছাড়া দলটির সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছিল পুনর্গঠিত হয়ে আওয়ামী লীগ ফেরার চেষ্টা করতে পারে। বিশেষ করে যাদের বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ নেই সেরকম নেতকার্মীদের সামনে রেখে রাজনীতিতে মাথাচাড়া দিতে পারে দলটি। এর মধ্যে নানা উদ্যোগও দৃশ্যমান হচ্ছিল। তবে সম্প্রতি শেখ হাসিনার এক সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে নতুন তথ্য। আওয়ামী লীগ সংগঠিত হচ্ছে, রিফর্মড বা পুনর্গঠিত হয়ে রাজনীতিতে ফেরার আশা করছে তারা।
কয়েকদিন আগে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে একটি লিখিত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন হাসিনা। সাক্ষাৎকারে তিনি তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ‘প্রত্যাখ্যান’ করেছেন এবং চলমান বিচার প্রক্রিয়াকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। এ সময় তিনি তার পরিবারের নেতৃত্ব ছাড়া দেশের ভবিষ্যৎ ভূমিকা পালনে রিফর্ম (পুনর্গঠিত) আওয়ামী লীগের ফিরে আসার ইঙ্গিতও দেন। তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে ধারণা করা হচ্ছে যে, শেখ হাসিনার পরিবারের নেতৃত্ব ছাড়াই আওয়ামী লীগ নতুন করে পুনর্গঠিত হতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে একটি বার্তাও পাওয়া যাচ্ছে যে, এখন থেকে দলটির নেতৃত্বে আসতে পারবেন দলের ভেতরের নেতাদের যে কেউ। আর যদি তাই হয়, তাহলে নবগঠিত রিফর্ম আওয়ামী লীগই আসতে চাচ্ছে বলে ধারণা করা যায়।
গত বুধবার আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ দেশের ভবিষ্যৎ ভূমিকা পালনে ফিরে আসবে, সেটা সরকারে হোক আর বিরোধী দলে হোক এবং তার পরিবারের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
এর আগে হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় গত বছর রয়টার্সকে বলেছিলেন যে, দল চাইলে তিনি নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে আমার বা আমার পরিবারের ব্যাপার না। বাংলাদেশের জন্য আমরা সবাই যা চাই, সেখানে সাংবিধানিক শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা পরিবার আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে না’।
ভারতের নয়াদিল্লিতে নির্বাসনে থাকা শেখ হাসিনার দেওয়া সাক্ষাৎকার গত বুধবার আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স, এএফপি ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে প্রকাশিত হয়। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই প্রথম তিন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হলো। যা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ সকল কর্মী-সমর্থককে রাজনীতির মাঠে ফিরে আসার ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারেন।
এর আগেও রিফাইন্ড বা পরিশুদ্ধ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসার আলোচনা সামনে আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলে। কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর বাসায় আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন নিয়ে বৈঠক হয় বলে গণমাধ্যমে উঠে আসে।
তা ছাড়াও সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক সফরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। অধিবেশনের ফাঁকে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম জিটিও’র মেহদি হাসানকে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তো নিষিদ্ধ নয়। তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ, যা যে কোনো সময় উঠে যেতে পারে।’ প্রধান উপদেষ্টার ওই বক্তব্য থেকেও আওয়ামী লীগের ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখছেন দলটির নেতাকর্মীসহ সমর্থকরা।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি পুরোনো দল। তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায়ও ছিল। যদিও গণঅভ্যুত্থানের পর তাদের জনসমর্থনে ভাটা পড়েছে। তাদের বিরুদ্ধে জনতার ক্ষোভ রয়েছে। দলটি ও তার শীর্ষনেতারা বিচারের মুখোমুখি। তবু তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরতে মরিয়া।
আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, শেখ হাসিনাসহ দলের অনেকে ভারতে আছেন। সেখান থেকে দল পুনর্গঠনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে তাতে শেখ হাসিনার ইচ্ছা ও মতামত বেশি গুরুত্ব পাবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
রয়টার্সকে দেওয়া ইমেইল সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা আরো বলেন, আওয়ামী লীগকে আগামী বছরের নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া হলে দলটির লাখ লাখ সমর্থক এই নির্বাচন বয়কট করবে। হাসিনা জানান, তার দলকে বাদ দিয়ে হওয়া নির্বাচনের মাধ্যমে যেই সরকারই হোক তাদের সময়ে তিনি দেশে ফিরবেন না এবং তিনি ভারতেই অবস্থান করবেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই প্রথম তিনি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা রয়টার্সকে বলেন, পরবর্তী সরকারের নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধতা থাকা আবশ্যক। দেশের লাখ লাখ মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা ভোট দেবে না। সমর্থকদের অন্য দলেও ভোট দিতে বলেননি শেখ হাসিনা। তার আশা, নির্বাচনের আগে তার দল কার্যক্রম চালাতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘লম্বা সময় ধরে আত্মোপলব্ধির সময়-সুযোগ পাওয়ার পরও শেখ হাসিনার কোনো সাক্ষাৎকারে তার অতীতের কোনো কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুশোচনার লেশমাত্র নেই। ভবিষ্যতে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সমাজে তাদের (আওয়ামী লীগের) অংশগ্রহণ ঝুঁকির মধ্যে আছে।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তারা (আওয়ামী লীগ) জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ফ্যসিবাদী শাসনের পতনের পর সেসময় অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে এবং সাধারণ সমর্থকরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন দলে যুক্ত হয়ে গেছে।’
কেকে/এমএ