জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার কৃষ্ণকোলা গ্রামের কৃষক আবু বক্কর সিদ্দিক এ বছর ১০ বিঘা জমিতে ডায়মন্ড ও স্টিক জাতের আলু চাষ করেছিলেন। সব মিলিয়ে তার জমিতে ১ হাজার মণ আলু উৎপাদন হয়েছিল। তিনি মৌসুমের শুরুতে তিনি প্রতিমণ আলু ৪৭০ থেকে ৪৮০ টাকায় ৭৫০ মণ আলু বিক্রি করেছিলেন। তখনই তিনি ৯০ হাজার টাকা লোকসান গুনেছিলেন। লোকসান কিছুটা কমাতে তিনি ২৫০ মণ আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করেন। কিন্তু বিধি বাম, হঠাৎ দরপতনে সেখানেও প্রায় ২ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে তার।
একই অবস্থা মৌসুমি ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদেরও। শুরুতে আলু কেনা থেকে হিমাগারে সংরক্ষণ পর্যন্ত প্রতি কেজিতে ২৩ টাকা খরচ হয়েছিল তার। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি ৮ থেকে সাড়ে ৮ টাকায় আলু বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ১৫ টাকা লোকসান তার। এ বছর ১ হাজার বস্তা আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করে ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে তার।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর এক কেজি আলু উৎপাদন করতে কৃষকের ১০ থেকে ১৩ টাকা খরচ হয়েছে। সেখান থেকে বাছাই করে বস্তা কেনা, পরিবহন ও শ্রমিক খরচ ও হিমাগার ভাড়াসহ প্রতি কেজিতে দাম পড়েছে ২৩ টাকা খরচ হয়েছে। সংরক্ষণের পাঁচ মাস পরে এখন বাজারে ৭ থেকে ৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে প্রতি কেজিতে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ১৫ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
উপজেলার আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর এই এলাকায় প্রচুর পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়েছে। দাম বাড়ার আশায় হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করেছিলেন তারা। কিন্তু এখন শুরু মৌসুমের তুলনায় অনেক কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তারা প্রতি কেজিতে পাচ্ছেন ৭ থেকে ৮ টাকা। অথচ বিগত বছরগুলোতে ৪০ টাকা পর্যন্ত দরে আলু বিক্রি করে লাভবান হয়েছিলেন। এ বছর ক্ষেত থেকে শুরু করে হিমাগার পর্যন্ত ব্যাপক লোকসান হয়েছে। সরকারের আলু কেনার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশা আরও বেড়েছে বলে জানান তারা। এভাবে চলতে থাকলে আগামী মৌসুমে আলু চাষে অর্থ সংকটে পড়বেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন চাষিরা।
উপজেলা কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগের বছর এই উপজেলায় প্রায় ৫ হাজার ৯শ’ ২০ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছিল। আর এই বছর আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৬শ’ হেক্টর জমিতে। এবারে মোট উৎপাদিত আলুর পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার টন। যা গত বছরের তুলনায় ৬৮০ হেক্টর জমিতে বেশি আলু চাষ হয়েছে। অতিরিক্ত উৎপাদন বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে দরপতনের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হিমাগারে আটকা ১ লাখ ৫০ হাজার বস্তা আলু:
এই উপজেলায় দীনা কোল্ড স্টোরেজ এবং গোপীনাথপুর হিমাগার নামে দুইটি হিমাগার রয়েছে। বর্তমানে উপজেলার দুইটি হিমাগারে এখনো প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার বস্তা আটকে আছে। যা মোট ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক। প্রতি বস্তার ওজন ৬০ কেজি ধরে সংরক্ষিত মোট আলুর পরিমাণ দাঁড়ায় দুই লাখ ২৫ হাজার মণ। প্রতিমণে ৬০০ টাকা লোকসান ধরলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। হিমাগার থেকে কিছুদিন আগে বেড় হওয়া আলুর হিসাব করলে লোকসান দ্বিগুণ হবে। বাজারে আলুর দরপতনে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে আলু উত্তোলনের খরচও তুলতে পারছেন না। ফলে হিমাগারে মজুতকৃত আলু বেড় করছেন না তারা। এতে বিপাকে পরেছেন হিমাগার কর্তৃপক্ষ। তারা আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে আলু উত্তোলনের জন্য এলাকায় মাইকিং করেছেন। কিন্ত তাতেও কোন কাজ হচ্ছেনা বলে জানান হিমাগার কর্তৃপক্ষ।
বাণিজ্য উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি:
সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন গত ৫ সেপ্টেম্বর আকস্মিক সফরে আক্কেলপুরে আসেন। সেখানে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, এ বছর আগের তুলনায় প্রচুর পরিমাণ আলু উৎপাদিত হয়েছে। আগামী এক মাসে আলুর দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে। আমরা আলু রপ্তানিতে প্রণোদনা ও সহযোগিতা করছি। চাহিদা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া টিসিবির মাধ্যমে বাজার থেকেও আলু ক্রয় করা হবে। আলু রপ্তানির লক্ষ্য অর্জনে সরকার কাজ করছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে চাষি ও ক্রেতা উভয়ের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা হবে। হিমাগার গেটে আলুর কেজিপ্রতি সর্বনিম্ন মূল্য ২২ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার।
কিন্তু কৃষক ও ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, এই প্রতিশ্রুতি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
কৃষকদের লোকসান, উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের কৃষক আবু হাসান এই সংকটের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। তিনি ২২ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে ২ হাজার ২ শত ৪০ মণ আলু উৎপাদন করেছেন। মোট খরচ হয়েছে ২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। সরকারের আলু কেনার ঘোষণার পর দাম বাড়ার অপেক্ষায় আলু বিক্রি বন্ধ রাখেন। কিন্তু সরকারিভাবে আলু না কেনায় বাজারে আলুর ধস নামে। এখনো তার দেড় হাজার বস্তা আলু এখনো হিমাগারে রয়েছে।
তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছিল সরকারিভাবে আলু কেনা হবে। কিন্তু একটি আলুও কেনা হয়নি। মনে করেছিলাম সরকার কিনলে কিছুটা লোকসান পুষিয়ে নেওয়া যাবে। তাই হিমাগার থেকে আলু উত্তোলন করিনি। এখন লোকসান পাহাড়সম হয়েছে। এমন পরিস্থিতে আগামী মৌসুমে আলু চাষে আগ্রহ হারাবেন কৃষকরা।
উপজেলার মোহনপুর বাজারের আলু ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ বলেন, প্রতি কেজি আলু কেনা থেকে হিমাগারে সংরক্ষণ পর্যন্ত ২৩ টাকা খরচ হয়েছিল। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি ৮ থেকে সাড়ে ৮ টাকায় আলু বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ১৫ টাকা লোকসান হয়েছে। এ বছর ১ হাজার বস্তা আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করে ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। আমরা এখন কী করবো? এমন পরিস্থিতে পথে বসার উপক্রম।
উপজেলার তিলকপুর দীনা কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক লিটন কুমার নাথ বলেন, বাজারে আলুর দরপতনের প্রভাব আমাদের হিমাগারেও পরেছে। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ব্যাপক লোকসান হয়েছে। এ কারণে তারা আলু উত্তোলন করছেন না। এদিকে আমাদের সংরক্ষণের সময় ফুরিয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত ৪৫ শতাংশ আলু বের হয়েছে। আমরা এলাকায় মাইকিং ও বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আলু উত্তোলন করার জন্য তাগাদা দিচ্ছি। এখনো বিপুল পরিমাণ আলু হিমাগারে রয়েছে।
জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, ‘এ বছর উৎপাদন বেড়েছে, তাই বাজারে সরবরাহও বেশি। সরকারিভাবে ২২ টাকা কেজি দরে কেনার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্ত হলেও এখনও কোনো নির্দেশনা আসেনি। এ কারণে আলু কেনা সম্ভব হয়নি। আমরা রপ্তানি ও বিকল্প বাজার সৃষ্টি নিয়ে কাজ করছি।’ শিক্ষক আমজাদ হোসেনের দাবি, প্রয়োজনীয় কিছু কাজ করা হয়েছে ওই টাকা দিয়ে। আত্মসাতের অভিযোগ মিথ্যা।’
কেকে/ এমএ