বিএনপির রাজনীতিতে আবারো আলোচনায় এসেছে সেই পুরোনো সিন্ডিকেট। যাদের বহুল বিতর্কিত ‘হাওয়া ভবন সিন্ডিকেট’ বলছেন কেউ কেউ। দলের অভ্যন্তরীণ সূত্রের অভিযোগÑ একসময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এই গোষ্ঠী ফের সক্রিয় হয়েছে। এবারো তাদের মূল হাতিয়ার- ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম। নানা তদবির, প্রভাব বিস্তার ও ভবিষ্যৎ সরকারে পদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির আড়ালে চলছে অর্থ লেনদেন ও দলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা।২০০১ থেকে ২০০৬- এই সময়ে ‘হাওয়া ভবন’ ছিল বিএনপির অঘোষিত শক্তিকেন্দ্র। দলের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত, প্রশাসনিক বদলি, ব্যবসায়িক চুক্তি- সব কিছুতেই এ ভবনের ছায়া ছিল। এখন সেই একই ধরনের নেটওয়ার্ক আবার নেপথ্যে কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে, এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের নাম ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার করছে। তারা নিজেদের ‘বিশ্বস্ত প্রতিনিধি’, ‘ঘনিষ্ঠ সহযোগী’ বা ‘লন্ডন লিংক’ পরিচয়ে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। একাধিক জেলা ও মহানগর ইউনিটে এমন কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগও উঠেছে।
দলের মধ্যম পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘এরা বলছে, আগামী সরকার গঠনের পর বিভিন্ন দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হবে। অনেক ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন বা পদপ্রাপ্তির আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো- এই সব কার্যক্রমে তারেক রহমানের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে, অথচ তিনি কিছুই জানেন না।’
দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও তৃণমূলের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কয়েক মাস ধরে কিছু প্রাক্তন সংসদ সদস্য, বিতর্কিত নেতা এবং প্রবাসী বিএনপি কর্মী সক্রিয়ভাবে তদবিরবাণিজ্যে যুক্ত রয়েছেন। তারা দাবি করছেন, ‘লন্ডন থেকে সব তালিকা চূড়ান্ত হচ্ছে’- এই কথায় বিশ্বাস করে অনেকেই যোগাযোগ করছেন বা অর্থ লেনদেন করছেন। এক জেলা সভাপতি বলেন, ‘আমাদের ইউনিটে এক ব্যক্তি দাবি করছে সে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলেন। সে এখন স্থানীয় কমিটি গঠনের দায়িত্ব নিয়েছে বলে প্রচার করছে। আমরা এসব কর্মকাণ্ডে বিব্রত।’
তবে এসব বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘দলের নামে বা কোনো নেতার পরিচয় ব্যবহার করে কেউ অনৈতিক কাজ করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিএনপি এমন রাজনীতি মেনে নিতে পারে না।’ দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, সাম্প্রতিক সভায় এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, তারেক রহমান বা কোনো শীর্ষ নেতার নাম ব্যবহার করে কেউ তদবির বা আর্থিক লেনদেন করলে তাকে অবিলম্বে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় দপ্তরে এমন একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। সেগুলোর ভিত্তিতে দলীয় শৃঙ্খলা কমিটি তদন্ত শুরু করেছে।
লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ঘিরে এই সিন্ডিকেটের তৎপরতা দলের অভ্যন্তরে উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিএনপির এক আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক বলেন, ‘তারেক রহমান খুব সচেতন। তিনি জানেন, তার নাম ভাঙিয়ে কেউ যদি অন্যায় সুবিধা নিতে থাকে, সেটা দলীয় ভাবমূর্তির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হবে। তিনি ইতোমধ্যে কয়েকটি ইউনিটের কাছ থেকে সরাসরি রিপোর্ট নিয়েছেন।’ তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ এক নেতা জানান, তিনি এখন প্রতিটি কমিটি অনুমোদনের আগে নিজে যাচাই করছেন। যাদের বিরুদ্ধে ‘নাম ভাঙানো’ বা তদবিরের অভিযোগ রয়েছে, তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে এক সিনিয়র নেতা বলেন, ‘দল এখন একটা টার্নিং পয়েন্টে। যারা পুরোনো ক্ষমতার নেশায় ভর করে হাওয়া ভবনের স্টাইল ফিরিয়ে আনতে চায়, তারা আসলে বিএনপির পুনর্জাগরণের পথে বাধা।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি এখন পুনর্গঠনের এক সংবেদনশীল পর্যায়ে। এই সময়ে তারেক রহমানের নাম ব্যবহার করে পুরোনো গোষ্ঠীগুলো আবার সক্রিয় হলে সেটি দলের ভবিষ্যৎ ঐক্যের জন্য বিপজ্জনক। তারা বলছেন, হাওয়া ভবনের অতীত ভূমিকা নিয়ে জনগণের স্মৃতি এখনো তাজা। সেই একই ধাঁচের কর্মকাণ্ড ফিরলে বিএনপির সংস্কার ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। একই সঙ্গে বিএনপি এখন ক্ষমতায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেক্ষেত্রে তাদের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এখনই সুদৃঢ় করতে হবে। ক্ষমতার আগেই তদবিরবাণিজ্য শুরু হলে জনগণ তাদের প্রতি বিশ্বাস হারাবে।
বিএনপি যখন দল পুনর্গঠন ও নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বকে সামনে আনার চেষ্টা করছে, তখন পুরোনো সিন্ডিকেটের এই উত্থান সেই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তরুণ ও যোগ্য নেতারা বলছেন, যদি আবার ‘হাওয়া ভবনের’ রাজনীতি ফিরে আসে, তাহলে আমরা মাঠে টিকে থাকতে পারব না। আমরা নতুন প্রজন্ম চাই- গণতন্ত্রের রাজনীতি, কোনো সিন্ডিকেট নয়। তারেক রহমানকে ঘিরে যারা বিশ্বাসযোগ্য, তারা নিজেরাই চান দলটা স্বচ্ছভাবে এগিয়ে যাক।
বিএনপির ভেতরে এখন এক ধরনের সতর্কতা চলছে। একদিকে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া, অন্যদিকে পুরনো প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সক্রিয়তা দলকে জটিল অবস্থানে ফেলেছে। দলীয় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে বিএনপির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ প্রতিপক্ষ নয়, বরং নিজেদের ভেতরের মানসিকতা। যদি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এবারো বিষয়টি কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আগামীর রাজনীতিতে বিএনপির জন্য সেটি হতে পারে আত্মঘাতী ভুল।
কেকে/এআর