বাসার কনিষ্ঠতম সদস্য নাকি আদরে বাঁদর, মারাত্মক আত্মকেন্দ্রিক ও ননীর পুতুল হয়। গত ২৫ বছর ধরে এই উপাধিগুলো শুনে আসছি। দ্বিমতের অবকাশ নাই। মায়াবতী আমাদের জীবনে আসার পর এই বিশেষণগুলো তাদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে মায়াবতীকে বেছে নিল। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। তাই ওর প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা।
মায়াবতী আমাদের জীবনে আসার পর থেকে আমাদের জীবন বদলে গেছে। ওকে নিয়ে লিখলে বিরাট মহাকাব্য ও সরি ম্যাওকাব্য হয়ে যাবে। তবে আজকে শুধু বলব মায়াবতী কীভাবে নন ভেজ থেকে ভেজ হয়ে উঠলো তা নিয়ে। ছোটবেলায় আমি নাকি মাছ মাংস ডিম দুধ খেতাম শুধু। সবজির মধ্যে এক আলু ছাড়া কিছুই মুখে রুচতো না। আমার যোগ্য শিষ্য মায়াবতীও মাছ মাংস দুধ ডিম ছাড়া কিছুই মুখে তুলতো না, তবে স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ায় খেত মিষ্টি কুমড়া সিদ্ধ আর সামান্য ভাত। তবে মাছ দিতে হতো কাঁটা বেছে, মাংস থেকে হাড় ছাড়িয়ে, ডিম সিদ্ধ করে, দুধ খুব ঘন করে জ্বাল দিয়ে। বরিশালে এভাবেই চলছিল আমাদের জীবন- আমার ওর সেবা করে আর ওর আমার সেবা গ্রহণ করে আমাকে বাধিত করে। বাসায় আসার পর ওর প্রথম বিপত্তি বাঁধলো শুঁটকি খেতে গিয়ে। বরিশালে শুঁটকির প্রচলন নাই বললেই চলে। যেহেতু টাটকা মাছই প্রচুর পাওয়া যায়। এদিকে বাসায় শুঁটকির জয়জয়কার। মা শুঁটকি দিয়ে নানাবিধ রান্না করে- পেঁয়াজ দিয়ে ভুনা ভুনা, ঝাল ঝাল ভর্তা, কুচি কুচি করে আলুর সঙ্গে ভাজি, সবজি দিয়ে ঝোল ঝোল ইত্যাদি। মায়াবতী শুঁটকি দেখে ও তার গন্ধ শুঁকে চোখ-নাক-মুখ কুঁচকে শুঁটকি থেকে একশো গজ দূরে অবস্থান করল। অনেক সাধ্যসাধনা করে তাকে বাসার অন্যান্য রেগুলার খাবার খাওয়ানো হলো। এরপর আমি ফিরে গেলাম বরিশাল আর ও বাসায় খুব দ্রুতই নিজের অবস্থান শক্তপোক্ত করে ফেললো।
মাস দুয়েক পর বাসায় ফিরে দেখলাম বাবা হয়ে গেছে তার বেস্ট ফ্রেন্ড, আপু তার প্রিয় বান্দা আর মায়ের সাথে তার একটা বিশেষ দ্বিপাক্ষিক অবজ্ঞার সম্পর্ক কেননা- এক বনে কখনো দুই বাঘ থাকতে পারে না। সে নিয়মিত খাবার দাবার খায় (বলাবাহুল্য সবই আমিষ)। শুঁটকি তার প্রিয় খাবার হয়ে গেছে এতোদিনে। অতি ভদ্র তার আচরণ। আমি আসার পর তার স্বভাবে একটুখানি বাঁদরামির প্রকাশ দেখা গেল। এর কারণ নাকি আমি! কেননা- ব্যাধিই সংক্রামক। কে কার পাল্লায় পড়ে বাঁদর হচ্ছে সে বিতর্ক তোলা থাকুক। ফিরে আসি মায়াবতীর কথায়। তার বাঁদরামির নমুনা বলি একটা- ভোরে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে বাবা ও মা। মায়াবতী তখন বাবাকে ভুলায়ে ভালায়ে একবার ব্রেকফাস্ট করে পেট পুরে। এরপর উঠে আপু। আপুকেও সে ভুলায়ে ভালায়ে সেকেন্ড ব্রেকফাস্ট করে। যেহেতু তার প্রথম কাণ্ডটার কথা আপু জানে না। এরপর আমি যখন চোখ খুলি ঘুম থেকে তখনই সে দৌড়ায়ে আসে আমার কাছে। বহুদিন ধরে অভুক্ত প্রাণীর মতো বিশাল আকুতি মিনতি অসহায়তা প্রকাশ করে আর আমার থেকে তৃতীয়বারের মতো ব্রেকফাস্ট আদায় করে। ওকে খেতে দিয়ে এরপর আমি দাঁত ব্রাশ বাথরুম ইত্যাদি কাজ সম্পাদন করতে পারি। খেতে না দিয়ে এসব করার পারমিশন নাই। প্রায় এক মাস পর আমাদের সৌভাগ্য ও তার দুর্ভাগ্যবশত সেদিন সকালে খুব বৃষ্টি থাকায় সবাই কাজকর্ম বাদ দিয়ে বসে ছিল একসাথে। তৃতীয় দফার খাবার খাওয়ার সময় বাকি দুজনের সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তার এ ছলনা প্রকাশ পেয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় সকালের খাবারে তার একচেটিয়া অধিকার। কে জানে তার দুঃখেই কি না আমাদের আমিষভোজী মায়াবতী নিরামিষভোজী হওয়ার পথে ধাবিত হয়।
এর আগে একটুখানি পেছনের কাহিনি বলে নেওয়া দরকার। কিছুদিন আগেই মায়াবতীকে এলাকার বিশিষ্ট প্রেমিক পুরুষ সালমান খানের সাথে ঘুরতে দেখা যায়। এর কিছুদিন পরই আমরা তর্ক করতে থাকি কয়টা নতুন বাবু আসতে চলেছে- আমার মতে দুইটা, মায়ের মতে তিনটা। প্রেগন্যান্সি নাকি খাবার দাবারের রুচি বদলায়ে দেয় (এটাও কারণ হতে পারে নিরামিষভোজী হওয়ার)। আমরা খেয়াল করি মায়াবতী একটু একটু করে আলু, পেঁপে খেয়ে নিচ্ছে। একদিন এক টুকরা বেগুনও খেয়ে ফেললো। আরেকদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে খেলো মুলাশাক। ডাঁটা জাতীয় খাবার আমার অপছন্দ, তাই একদিন ওর সামনে দিলাম। উদ্দেশ্যে হচ্ছে - ওকে দিছি কিন্তু খায় নাই এই অজুহাতে ফেলে দেওয়া যাবে। কিন্তু সে হাসিমুখে খেয়ে নিল। ও যে কতটা স্বাস্থ্যসচেতন তার প্রমাণ পেলাম যেদিন ও লালশাক দিয়ে মাখা ভাত খেল খুব আগ্রহ নিয়ে। তবে সবচেয়ে বড় চমকটা ছিল যেদিন বাসায় কচুশাক রান্না হলো। বাসার আর কারো তেমন পছন্দ না হলেও কচুশাক আমার অতীব প্রিয় খাবার। আর মা মাছের মাথা দিয়ে, কচুশাক ভাপ দিয়ে তার পানিটা ফেলে দিয়ে, বেশি কাঁচামরিচ আর দুয়েকটা লেবুপাতা দিয়ে খুবই স্বর্গীয় একটা রান্না করে। ওইদিন সেটা দিয়েই তৃপ্তিসহকারে গামলা গামলা গরম ভাত সাবাড় করছিলাম। এর মাঝেই মায়াবতীর আবির্ভাব। ও তো চুপ থাকতে পারে না, নিজের উপস্থিতি সরবে জানান দিচ্ছিল। খাদ্যরসনায় ব্যাঘাত পড়ায় আমি কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে কচুশাক মাখা ভাত দিলাম ওকে যেন ও দ্রুত চলে যায় আর আমাকে বিরক্ত না করে। কিন্তু ও এমনভাবে গপগপ করে খেয়ে নিলো পুরোটা, আমিই খাওয়া বন্ধ করে বিস্ফারিত নয়নে কয়েক মুহূর্ত ওরদিকে তাকায়ে রইলাম। আর কচুশাক খাওয়ার মাধ্যমেই ওর সমস্ত সবজি ও শাক খাওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হলো। আরেকটা খাবার অবশ্য ওর খুবই প্রিয়। বড় মাছের টুকরা অনেক পেঁয়াজ দিয়ে আর বেশ খানিকটা তেলে ভেজে ভর্তা করে মা। সেই মাছের তেলে ভাজা পেঁয়াজ দিয়ে মাখা ভাত ও খুব আগ্রহ নিয়ে খায়। ওর এহেন উন্নতি দেখে আমি ভেবেছিলাম ওকে একটু লেখাপড়াও শেখাই। শাক-সবজি খাওয়ার উপকারিতা নিজেই বুঝতে পারবে পড়াশোনা করে। কিন্তু রবি ঠাকুরের ওই ছড়াটার মতো আমি যত বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ’, মায়াবতী কেবলই বলে- ‘মিঁয়ো মিঁয়ো মিঁয়ো’।
কেকে/ আরআই