আশ্বিনের খুব ভোরবেলায় মনিমালার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। এই বুঝি দুর্গাপূজার মহাষষ্ঠীর কল্পারম্ভ শুরু হয়ে গেছে। ঘুমের ঘোরে ঢাকের বাদ্যি বাজার শব্দ কানে ভেসে আসছে। শরতের আকাশে পেঁজা পেঁজা শুভ্র রঙের মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়। চারদিকে শিউলি ফুলের সুবাসে ভরে ওঠে মন। বনে বনে কাশফুল বাতাসে দোলা দেয়। শিশির সিক্ত বন বনানী শীতল হাওয়ায় জড়োসড়ো হয়ে থাকে।
ভোরের পাখিরা ঘরের চালে বসে মানুষের ঘুম ভাঙানোর গান গায়। শরতের হিমেল হাওয়ায় পরিযায়ী পাখিরা বেড়াতে আসে। তার মাঝে কল্পারম্ভর মধ্য দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। টানা পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গাপূজা চলবে। মন্দিরে মন্দিরে দর্শনার্থীদের ভিড় ঠেলে ঠাকুর দেখতে হবে।
মনিমালা সাতক্ষীরা গভর্নমেন্ট কলেজে পড়ে। তার ছোট মামার সঙ্গে প্রতিবছর বাগেরহাটের শিকদার বাড়ির পূজা দেখতে যায়। এ ছাড়া চুকনগর, কেশবপুর ও নিমতলীতে বড় দুর্গাপূজা দেখতে যায়। মনিমালার এ বছর অনেক পুজোর জামা প্যান্ট, কাপড় হয়েছে।
বড় মামা, ছোট মামা, মাসি, পিসি সকলেই নতুন পোশাক কিনে দিয়েছেন। মনিমালা একেক দিন একেক ধরনের পোশাক পরে পূজা দেখতে বের হবে। অষ্টমীর দিন তার নিজের পছন্দের হলুদ কাপড় পরে ক্লাবের পূজা মন্দিরে অঞ্জলী দেবে। তারপর হাতিয়ার ডাঙ্গা রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজা দেখতে যাবে। ছোট ভাইয়ের জন্য ও তিন চার সেট পোশাক এসেছে। ছোট ভাই অরণ্যের বয়স দশ বছর। অরণ্য বাবা, মায়ের সঙ্গে পূজা দেখতে যায়।
অরণ্যের একটা বন্ধু আছে, তার নাম আদিত্য। আদিত্যর বাবা একজন দিনমজুর। সারা দিনের পরিশ্রমে যা উপার্জন করে তাতেই কোনো রকমে সংসার চলে। আদিত্যর কোথাও থেকে কোনো নতুন জামা প্যান্ট আসেনি। অবুঝ বালক তবুও বাবা, মায়ের কাছে শুধুই বাহানা করে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আদিত্য কে এক সেট নতুন পোশাক কিনে দেওয়ার মতো বাপের সাধ্য নেই। অরণ্যের বুদ্ধি হয়েছে, সে আদিত্যর অন্ধকার মুখ দেখে বুঝতে পারে, তার এ বছরও হয়তো কোনো নতুন পোশাক কেনা হয়নি। তার মামা, মামি, মাসি, পিসি কেউই আদিত্যকে নতুন পোশাক উপহার দেয়নি। ওরা গরিব বলে কোন আত্মীয়স্বজন ওদের বাড়িতে আসে না।
অরণ্য গরিব বন্ধুর কথা ভেবে নিজের অনেক পোশাকের মধ্য থেকে এক সেট নতুন পোশাক আদিত্যকে দিল। অরণ্যের মা, বাবা, দিদি সবাই বুঝতে পেরেছে। তারা অরণ্যকে কেউ কিছু বলল না, বরং অরণ্যের মহানুভবতা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতির কাছে সবাই পরাস্ত হলো। অরণ্য গরিব বন্ধুর প্রতি যে ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তাতে বাড়ির সবাই গৌরবান্বিত বোধ করল। পরদিন আদিত্য, অরণ্যের দেওয়া নতুন জামা প্যান্ট পরে পূজা দেখতে গিয়েছে।
সেদিন আদিত্যর চোখে মুখে আনন্দের একটা ভিন্ন অনুভূতি দেখা গিয়েছিল। আদিত্যর বাবা মা, অরণ্যের প্রতি খুব সন্তুষ্ট হলো।
মনিমালা এসে অরণ্যকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, ভাই তুই আমাকে অনেকটা শিক্ষা দিয়েছিস। আমার দু’চোখে অনেকটা জ্ঞানের আলো জ্বেলে দিয়েছিস। আমারও একটা বান্ধবী আছে, তার নাম বীণা। তাদের অভাব অনটনের সংসার, পুজোর সময় নতুন পোশাক কিনতে পারে না।
বীণার বাবা অন্যের বাড়িতে দিনমজুর খাটে। তাদের ঠিকমতো তিন বেলা খাবার পর্যন্ত জোটে না। পূজার সময় নতুন জামাকাপড় কেনা কাটা তাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। এসব ভাবতে ভাবতেই মনিমালার অন্তরে কিছুটা বোধোদয় জাগ্রত হলো। মনিমালা মনে মনে ভাবল, আমার পোশাকের মধ্যে থেকে এক সেট পোশাক বীণাকে পুজোর উপহার দেব। তাতে বীণা খুব খুশি হবে, আনন্দে পূজা দেখতে পারবে।
এ কথা ভেবেই মনিমালা তার নিজের পোশাকগুলো থেকে এক সেট পোশাক বীণার হাতে ধরিয়ে দিল। বীণা বড় হয়েছে, লজ্জায় মাথা নেড়ে বলল, আমি নেব না মনিমালা। মনিমালা বলল, তুই না নিলে আমি খুব কষ্ট পাব বীণা। সংকোচ ভুলে তুই আমার পোশাক টা হাতে তুলে নে? বীণা, মণিমালার দেওয়া পোশাক টা হাতে তুলে নিতেই তার দু’চোখেই আনন্দাশ্রুতে ভরে গেল। মনিমালা, বীণার দিকে তাকিয়ে দ্যাখে : বীণার চোখে মুখে একটা আলোক রশ্মির সরলরেখা অতিক্রম করছে। বীণার সেই আনন্দের অনুভূতি হয়তোবা পুজোর আনন্দের চেয়েও শক্তিশালী।
সেদিনের নতুন পোশাকটি হাতে নিয়ে বীণা যে মিষ্টি হাসিটা হেসেছিল, মনিমালার হৃদয়ের দর্পণে আজো তা প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত হয়।
কেকে/ এমএস