‘সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি’- কথিত এই প্রবাদটি যেন সাম্প্রতিক নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শাপলা প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে চলমান দ্বন্দ্বের বাস্তব রূপ পেয়েছে। শাপলা প্রতীকের দাবিতে এনসিপির অনড় অবস্থানের দীর্ঘদিন বিরোধিতা করেও শেষ পর্যন্ত পিছু হটল নির্বাচন কমিশন। অনেকটা এনসিপির দাবি মেনেই প্রতীকের তালিকায় ‘শাপলা’ সাদৃশ বিকল্প প্রতীক ‘শাপলা কলি’ যুক্ত করল তারা। গতকাল বৃহস্পতিবার ইসি সচিব আখতার আহমেদের স্বাক্ষরে এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করে। এরপর থেকেই এটি নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। অনেকের মতে, এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ইসি তার অবস্থার ও সক্ষমতা হারিয়েছে। নতি শিকার করেছে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি চাপে। ফলে প্রতীকের তালিকায় শাপলা না রাখলেও যুক্ত করেছে শাপলা কলি। আবার অনেকেই বিষয়টি নিয়ে করছেন হাস্যরসও। তারা বলছেন- শাপলা হোক কিংবা শাপলা কলি-ই হোক, যেহেতু এই প্রতীক বরাদ্দই করবে; তাহলে এগুলো নিয়ে এত নাটকীয়তা কী দরকার ছিল?
যদিও শাপলা ও শাপলা কলি প্রতীকের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে মন্তব্য করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, ‘শাপলা’ এবং ‘শাপলা কলি’ প্রতীক এক নয়। কারো চাপে নয়, নির্বাচন কমিশন নিজস্ব সিদ্ধান্তে বিধিমালায় ‘শাপলা কলি’ প্রতীক অন্তর্ভুক্ত করেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রথম আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘শাপলা’ আর ‘শাপলা কলি’ প্রতীকের মধ্যে পার্থক্য আছে। নানা সমালোচনার মুখে প্রতীকের তালিকা সংশোধন করে ‘শাপলা কলি’ প্রতীকটি বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রয়োজন মনে করলে আবারো সংশোধন করা হবে।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ‘ইসি মনে করেছে ‘শাপলা কলি’ রাখা যেতে পারে। এটা কারো দাবির প্রেক্ষিতে করার বিষয় নয়। কারো দাবির সঙ্গে প্রাসঙ্গিকও নয়।
তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, একটি দল ‘শাপলা’ প্রতীক চেয়েছে। এখন ‘শাপলা’ প্রতীক আর ‘শাপলা কলি’র মধ্যে পার্থক্য আছে। কমিশন মনে করেছে এটা করা যায়, তাই করা হয়েছে। যেহেতু কিছু বিরূপ মন্তব্য এসেছে, তাই কিছু বাদ দিয়ে কিছু যোগ করা হয়েছে।’
আখতার আহমেদ আরো বলেন, ‘কে চেয়েছে বা কে চায়নি সেটা বিষয় নয়, ‘শাপলা কলি’ প্রতীকটি যোগ করার সিদ্ধান্ত কমিশনের। ভবিষ্যতে যদি কমিশন প্রয়োজন মনে করে, তাহলে আবারো পরিবর্তন করতে পারবে।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নতুন প্রতীকের তালিকায় শাপলার পরিবর্তে ‘শাপলা কলি’ যুক্ত করা হলেও এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নয় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গতকাল ‘শাপলা কলি’ প্রতীকের তালিকায় যুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানায় দলটির নেতারা। এ নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার ও যুগ্ম সদস্য সচিব জহুরুল ইসলাম মুসা।
গেজেটে শাপলা কলি থাকা প্রসঙ্গে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, শাপলা কলি কিন্তু প্রতীকের তালিকায় ছিল না। এখন কিভাবে সেটি আসলো? আর ‘শাপলার কলি’ যদি থাকতে পারে শাপলা কেন রাখা হয়নি? আমরা তার ব্যাখ্যা জানতে চাই। এটা হচ্ছে আমাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। তিনি আরো বলেন, আমরা বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া পরে জানাব।
অন্যদিকে শাপলা কলি নয়, শাপলাই চায় বলে মন্তব্য করেছেন দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মুসা। তিনি বলেন, এনসিপি শাপলাই চায়। আমরা যখন শাপলা চেয়েছি, তখন নির্বাচন কমিশন বলেছেÑ তালিকায় নাই তাই, দেওয়া যাবে না। এখন তারা ‘শাপলা কলি’ কীভাবে প্রতীক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, তা স্পষ্ট করতে হবে।
প্রতীক হিসেবে এনসিপিকে ‘শাপলা কলি’ বরাদ্দ দেওয়া হলে তা মেনে নেবেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব ও মিডিয়া সেলের সম্পাদক মুশফিক উস সালেহীন বলেন, নির্বাচন কমিশন কোন ক্রাইটেরিয়ায় ‘শাপলা কলি’কে প্রতীক হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে তা আমাদের কাছে পরিষ্কার করতে হবে। আমরা নতুন প্রতীকগুলো নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। এ বিষয়ে এখনো আমরা আলোচনা করিনি।
এর আগে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সমনে রেখে এনসিপিসহ দুটি দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে এনসিপিকে তফসিলে থাকা ৫০টি প্রতীকের মধ্যে থেকে মার্কা বেছে নিতে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় ইসি। নির্ধারিত সময়ে প্রতীক বেছে না নিয়ে বিধি সংশোধন করে শাপলা প্রতীকের দাবি তোলে এনসিপি। কিন্তু ইসির তরফে বরাবরই বলা হচ্ছিল, প্রতীক তালিকায় না থাকায় এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দেওয়া সম্ভব নয়। এরই প্রেক্ষিতে এনসিপি নেতারা হুঁশিয়ারি দেন, তারা শাপলা প্রতীকেই ভোট করবেন এবং এই প্রতীক না পেলে তারা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামবেন।
গত রোববার কিশোরগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছিলেন, শাপলা প্রতীকের জন্য যদি এনসিপিকে রাজপথের কর্মসূচিতে যেতে হয়, তাহলে এনসিপি একই সঙ্গে এই স্বেচ্ছাচারী নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের আন্দোলনেও যাবে। সারজিসসহ এনসিপি নেতাদের এমন অনড় অবস্থান এবং রাজপথে নামার হুঁশিয়ারির মধ্যে বৃহস্পতিবার প্রতীক তালিকায় ‘শাপলা কলি’ যুক্ত করেছে নির্বাচন কমিশন।
এরও আগে ২৪ সেপ্টেম্বর প্রতীক তালিকা সংশোধন করে ১১৫টি মার্কা করা হয়। সেবার প্রতীক সংখ্যা বাড়ালেও তাতে শাপলা ছিল না। এবার আরো চারটি যোগ হওয়ায় প্রতীক সংখ্যা দাঁড়াল ১১৯টি। নতুন চারটি প্রতীকের মধ্যে শাপলা কলির পাশাপাশি রয়েছে সিঁড়ি, হ্যান্ডশেক ও সূর্যমুখী।
এ ছাড়া ইসির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে- ১৯৭২ সালের আর্টিক্যাল ৯৪ এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন, ‘নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা, ২০০৮’ এর নিম্নরূপ অধিকতর সংশোধন করিল, উপরি-উক্ত বিধিমালার বিধি ৯ এর উপ-বিধি (১) এর পরিবর্তে নিম্নরূপ উপ-বিধি (১) প্রতিস্থাপিত হইবে।
প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়, এই বিধির অন্যান্য বিধান সাপেক্ষে, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে, অনুচ্ছেদ ২০ এর দফা (১) এর অধীন, স্থগিতকৃত প্রতীক ব্যতীত, নিম্নবর্ণিত প্রতীকসমূহ হইতে, প্রাপ্যতা সাপেক্ষে, যে কোনো একটি প্রতীক বরাদ্দ করা যাইবে।
প্রজ্ঞাপনে প্রদত্ত প্রতীকগুলো হলো- আনারস, গাভি, টেলিভিশন, বই, রেল ইঞ্জিন, আম, গামছা, ডাব, বক, রিকশা, আলমিরা, গোলাপ ফুল, ড্রেসিং টেবিল, বাঘ, লিচু, ঈগল, ঘণ্টা, ঢেঁকি, বটগাছ, লাঙল, উট, ঘুড়ি, তারা, বাইসাইকেল, শাপলা কলি, উদীয়মান সূর্য, ঘোড়া, তালা, বালতি, সোনালি আঁশ, একতারা, চাকা, থালা, বেবি টেক্সি, সেলাই মেশিন, কাঁচি, চাবি, দাঁড়িপাল্লা, বৈদ্যুতিক পাখা, সোফা, কবুতর, চিরুনি, দালান, বৈদ্যুতিক বাল্ব, সিঁড়ি, কলম, চিংড়ি, দেয়ালঘড়ি, মই, সিংহ, কলস, চেয়ার, দোতলা বাস, মগ, সূর্যমুখী, কলার ছড়ি, কাঁঠাল, চশমা, দোয়াত-কলম, মাইক, হরিণ, কাপ-পিরিচ, ছড়ি, দোলনা, মোটরগাড়ি (কার), হাত (পাঞ্জা), কাস্তে, জগ, নোঙর, ছাতা, ধানের শীষ, মশাল, হাতঘড়ি, কেটলি, জাহাজ, নৌকা (স্থগিত), ময়ূর, হাতপাখা, হাঁস, কুমির, টর্চলাইট, পাগড়ি, মাছ, হাতি, কম্পিউটার, টিউবওয়েল, পানির ট্যাপ, মাথাল, হাতুড়ি, কুড়াল, টেবিল, পালকি, মিনার, হারিকেন, কুলা, টেবিল, প্রজাপতি, মোমবাতি, হ্যান্ডশেক, কুঁড়েঘর, টেবিলঘড়ি, ফলের ঝুড়ি, মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোন, হুঁকা, কোদাল, খেজুরগাছ, ট্রাক, ফুটবল, মোড়া, হেলিকপ্টার, ট্রাক্টর, ফুলকপি ও মোরগ।
উল্লেখ্য, গত জুনে নিবন্ধন আবেদনের সময় শাপলার পাশাপাশি কলম ও মোবাইল ফোন চেয়েছিল এনসিপি। পরবর্তী সময়ে দুই প্রতীক থেকে সরে এসে কেবল শাপলাতেই জোর দেয় দলটি। তবে রাজনৈতিক দলের জন্য তৈরি করা প্রতীক তালিকায় শাপলা না থাকায় এনসিপির আবেদন বারবারই নাকচ করে দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তারও আগে এনসিপির আগে মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যও চেয়েছিল শাপলা প্রতীক, কিন্তু সে আবেদনও খারিজ করে দিয়েছিল ইসি।
কেকে/এমএ