অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন। ডিসেম্বরে হতে পারে তফসিল ঘোষণা। আনুষ্ঠানিকভাবে আসন্ন নির্বাচনের প্রচার শুরু না হলেও, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা এরই মধ্যে স্থানীয়ভাবে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। তারা নিজ নিজ দলের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানালেও, ধর্মভিত্তিক দলগুলোও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তবে তাদের প্রচারে ধর্মের ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি। কেউ কেউ বলছেন, ধর্মভিত্তিক দলগুলো যেভাবে নির্বাচনি প্রচারে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করছেন, তা আসলে ধর্মের অপব্যবহারের শামিল। অনেক ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মতে এ ধরনের প্রচারণা মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের নেতা দাবি করেছেন, তাদের ভোট দিলে সেই ভোট ইসলামের পক্ষে যাবে। আবার একটি দল দাবি করেছে, তারা আল্লাহর দল, আর অন্যরা শয়তানের দল। আবার এক নেতা দাবি করেছেন, তাদের দলকে একটি ভোট দিলে ১৫ কোটি নামাজের সোয়াব হবে। এ ধরনের নানা বক্তব্যে দেশের রাজনীতিতে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
কোনো একটি দলকে ভোট দিলে জান্নাত পাওয়া যাবে এমন বক্তব্য বিভ্রান্তিকর উল্লেখ করে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও সংগঠনটির মুখপাত্র মুফতি আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘এটা সত্য নয়। ভোট হলো একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। এটা তো শরিয়া, দ্বীন এসব প্রতিষ্ঠা করার বিষয় নয়। আল্লাহর জমিনে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার অর্থ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভেই জান্নাত লাভ হয়। গণতান্ত্রিক সিস্টেমে ভোট দিলে কি দ্বীন বিজয়ী হয়ে যাবে এরকম কোনো গ্যারান্টি আছে? সুতরাং এ ধরনের বক্তব্য উচিত নয়, এটা বিভ্রান্ত্রিকর।’
রাজনীতিতে যেভাবে ধর্মের ব্যবহার হচ্ছে, এটা আধুনিক গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধের পরিপন্থি বলে মন্তব্য করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র মর্মবস্তুর দিক থেকে অসাম্প্রদায়িক। এর অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্র ধর্মের বিভাজন দিয়ে তার নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করতে পারবে না।’ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ জন্য ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গায় রাখা দরকার। ধর্মের যখন এই রাজনৈতিক চেহারা নিয়েছে, তখন এটা মানুষের মধ্যে আরো বিভক্তি বাড়িয়ে দেবে। সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিচ্ছে। এটা সামাজে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যারা ধর্মকে ব্যবহার করছেন, তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও আসলে সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা তারা লালন করেন। এটা মূলত ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা। কোনো আধুনিক সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজ এভাবে চলতে পারে না।’ রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের দায় দেখছেন সাইফুল হক। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন আগেও ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ ছিল, এখনো তা-ই আছে। তাদের এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে।’
ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল মানুষের কাছে ভোট চাইছে বলে অভিযোগ করছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি। তিনি বলেন, ‘কোনোভাবেই একটি রাজনৈতিক দল ইসলামকে পুঁজি করে রাজনীতি করতে পারে না। এভাবে বেহেশতের গ্যারান্টি দিয়ে ভোট চাওয়ার কতটুকু যৌক্তিকতা রয়েছে?’ তিনি বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও সহি-শুদ্ধ সূরা-কিরাত পড়লেই হয়। এবং আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আদর্শ জীবনীগ্রন্থ অনুসরণ করলে যথেষ্ট।’
সম্প্রতি আলোচিত ইসলামি বক্তা মুফতি আমির হামজার একটি বক্তব্য দেশজুড়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘রাসুল মুহাম্মাদ (সা.)-কে আল্লাহতায়ালা নবী নাম দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। নবী মানে সংবাদ বাহক। সে হিসেবে নবীজি সাংবাদিক ছিলেন। আমির হামজা জামায়াতে ইসলামীর কুষ্টিয়া-৩ আসনের এমপি প্রার্থী। তার এ বক্তব্যের পর অনেক ইসলামী ব্যক্তিত্ব সমালোচনা করেছেন। পরে অবশ্য নিজের বক্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, ‘নবীকে নিয়ে বক্তব্য দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দিতে হবে। নবী করিমকে কোনোভাবে সাংবাদিক বলা যায় না। তিনি ওহির বাহক ছিলেন, ওহির বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন আমাদের কাছে। তাঁকে আল্লাহতায়ালা যে উপাধিগুলো দিয়েছেন আমরা সেগুলো বলব। এর বাইরে যদি কোনো উপাধি দেই যে উপাধিটা তাঁর শানকে ছোট করে, তাহলে সেটা তাঁর শানের খেলাফ হবে।’
যাকে খুশি তাকে ভোট দেওয়া যাবে না : ‘আমার ভোট আমি দেব যাকে খুশি তাকে দেব’ চলবে না উল্লেখ করে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও কুমিল্লা-১০ আসনের দলীয় মনোনীত এমপি প্রার্থী মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত বলেছেন, ভোট শুধু অধিকার নয়, এটি একটি আমানত। যদি আপনি অসৎ বা দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ভোট দেন, আর সে পরে জনগণের সম্পদ লুট করে, খুন বা অন্যায় করে, তবে তার দায়ও ভোটদাতার ওপর বর্তাবে। তাই সৎ, যোগ্য ও আল্লাহভীরু প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে।
এ ছাড়া মসজিদে রাজনীতি করতে না দিলে কুরআন তিলাওয়াতও হবে না বলে এক সমাবেশে হুমকি দেন টাঙ্গাইল জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মো. হুমায়ুন কবীর। এ ছাড়া অভিযোগ আছে, জামায়াতের নারী শাখার সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাধারণ নারীদের বোঝাচ্ছেন, জামায়াতকে ভোট না দিলে জান্নাতে যাওয়া যাবে না।
কেকে/ এমএস