চট্টগ্রামের পাহাড়ি ও উপকূলীয় অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্র তৈরির গোপন কারখানার খবর গোটা দেশের আইনশৃঙ্খলার জন্য এক ভয়াবহ সংকেত। বাঁশখালী, রাঙ্গুনিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া- এসব জায়গায় দেশীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে এলজি, পাইপগান, ওয়ান শ্যুটারগান, একনলা বন্দুকসহ নানা অস্ত্র। মাত্র ত্রিশ হাজার থেকে এক লাখ টাকায় বিক্রি হয় এসব আগ্নেয়াস্ত্র। পুলিশের তথ্য বলছে, গত নয় মাসে চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর থেকে উদ্ধার হয়েছে ১৪৫টি অবৈধ অস্ত্র। তারপরও অপরাধ কমছে না, বরং বেড়েই চলেছে।
এটি শুধু চট্টগ্রামের সমস্যা নয়। দেশের নানা জায়গায় একইভাবে অবৈধ অস্ত্রের প্রবাহ বাড়ছে। সীমান্তের দুর্বল নজরদারি ও স্থানীয় চোরাচালান চক্রের কারণে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়েও অস্ত্র আসছে। রাজধানী, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহীসহ প্রায় সব অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অস্ত্রসহ অপরাধী গ্রেফতারের খবর দিচ্ছে, তবু এই প্রবাহ থামছে না।
অনেক ক্ষেত্রেই উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি, যা অস্ত্র উৎপাদনের এক ‘গ্রামীণ শিল্পে’ রূপ নিচ্ছে। তবে চট্টগ্রামই একমাত্র অঞ্চল নয় যেখানে অবৈধ অস্ত্র প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। সশস্ত্র অস্ত্রের রুট এবং ব্যবহার দেশের অন্যান্য জেলায়ও ধরা পড়ছে। সীমানা পাড়ি দিয়ে বা অভ্যন্তরীণ কালোবাজারের মাধ্যমে দেশের ভেতর অবৈধ অস্ত্র পৌঁছে যাচ্ছে। সীমান্তে আটক হওয়া নজির ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অপারেশনের তথ্য এটিই বলছে যে, বিদেশি উৎস থেকেও অস্ত্র প্রবেশের চেষ্টা হচ্ছে এবং বর্ডার গার্ডও এই প্রবাহ রোধে তৎপরতা বাড়াচ্ছে।
অবৈধ অস্ত্রের সহজলভ্যতা এখন রাজনৈতিক সহিংসতার নতুন জ্বালানি। চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ড, গোলাগুলি, চাঁদাবাজি- সব ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই অস্ত্রগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা, প্রভাব বিস্তার ও প্রতিপক্ষকে দমন, সবক্ষেত্রেই এ অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা প্রবল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, নিয়মিত অভিযান চলছে, অস্ত্র উদ্ধারও হচ্ছে। কিন্তু অভিযান দিয়ে এই সমস্যা রোধ সম্ভব নয়। প্রয়োজন গোয়েন্দা তথ্যভিত্তিক অভিযান, অস্ত্র তৈরির কারখানা ধ্বংস এবং সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা। একই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কেউ প্রভাব খাটিয়ে অস্ত্র ব্যবসা বা ব্যবহারকে প্রশ্রয় না দেয়।
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক হৃদয়। সেখানে অস্ত্রের অবাধ প্রবাহ মানে গোটা দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়া। এখনই রাষ্ট্রকে কঠোর, সমন্বিত ও অরাজনৈতিকভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে পাহাড়ের গোপন কারখানায় তৈরি বন্দুকগুলো শিগগিরই আমাদের রাজনীতি ও জনজীবনের ওপর গুলি চালাবে।
কেকে/ এমএস