সিলেটের বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন সিলেট-২। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম. ইলিয়াস আলী। প্রায় দুই যুগ ধরেই এ আসন ইলিয়াস দুর্গ হিসেবে পরিচিত।
২০১২ সালে ইলিয়াস আলী নিখোঁজের পর হাল ধরেন তার সহধর্মিণী তাহসিনা রুশদীর লুনা। সুখে-দুঃখে নেতাকর্মীদের আগলে রাখেন তিনি। দলের নেকর্মীরাও ইলিয়াস আলীর বিকল্প হিসেবে তাকে গ্রহণ করেন। দীর্ঘ এক যুগ ধরে তাহসিনা রুশদীর লুনাই এ আসনে ধানের শীষের কাণ্ডারী হিসেবে কাজ করছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নও পেয়েছিলেন লুনা। তবে মামলা জটিলতার কারণে নির্বাচন করতে পারেননি। সেসময় তার আশীর্বাদ নিয়েই এই আসন থেকে সংসদ সদস্য হন ঐক্যফ্রন্ট গণফোরম নেতা মোকাব্বির খান।
বলা হয়, যে কোনো নির্বাচনে এ পর্যন্ত যারা ইলিয়াস পরিবারের আশীর্বাদ নিয়েছেন তারা সহজেই জয়লাভ করেছেন। তবে এবার ইলিয়াস দুর্গে হানা দিয়েছেন হুমায়ুন কবির নামে এক প্রবাসী নেতা। তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা। সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম একটি অনুষ্ঠানে তাকে (হুমায়ুন কবির) সিলেট থেকে নির্বাচন করবেন বলে কূটনীতিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মূলত এরপর থেকেই দুই মনোনয়নপ্রত্যাশীর (লুনা-হুমায়ুন) সমর্থকদের মাঝে চাপা উত্তেজনা দেখা দেয়। এরই মধ্যে তাদের সমর্থকরা সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার রাতের এ সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ১০ জন।
এ আসনে ইলিয়াসপত্নী লুনাকেই ধানের শীষের প্রার্থী চান সাধারণ ভোটার ও স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে বিভিন্ন সময়ে যারা বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন তারা চান হুমায়ুনের অবস্থান শক্ত করতে। দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাও মনে করেন, ইলিয়াসের আসন অন্য কাউকে দিলে সেটা কর্মীদের মনে আঘাত হানবে। দুই মনোনয়নপ্রত্যাশীর অনড় অবস্থানের কারণে এ আসনে উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে। যে কোনো সময় বড় সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই তার পরিবার ঘিরে এক ধরনের আবেগ তৈরি হয়েছে। লুনার হাত ধরেই শক্ত অবস্থানে ছিল বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর বিএনপি। তার নেতৃত্বে দুই উপজেলার বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো একসঙ্গে কাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরে কোনো বড় কোন্দল দেখা যায়নি। এমনকি বিগত ১২ বছরে স্থানীয় সব নির্বাচনে ইলিয়াস আলীর নাম নিয়ে যারা নির্বাচন করেছেন তারা সবাই জয় নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। এ অসনে ধানের শীষের জয় সুনিশ্চিত করতে হলে ইলিয়াসপত্নী লুনার কোনো বিকল্প নেই। এখানে দল প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে লাভবান হবে জামায়াতে ইসলামী। তাদের দাবি, লুনা ছাড়া অন্য কেউ ধানের শীষ পেলে দলে বিভক্তি দেখা দেবে। এমনকি ইলিয়াস পরিবারের যে কেউ স্বতন্ত্র নির্বাচনও করতে পারেন। এ সুযোগে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে লুনা আলীর প্রতি গভীর সহানুভূতি রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ‘ইলিয়াস ভাইয়ের জন্যই আমরা বিএনপি করি। তার স্ত্রী প্রার্থী হলে আবার প্রাণ ফিরে পাবে এই আসন।’
সিলেট-২ আসনের রাজনীতিতে প্রবাসীদের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাজ্য প্রবাসী নেতাকর্মীরা সব সময়ই স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। লন্ডনে ইলিয়াস আলীর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। লুনাও সেই প্রভাবের ধারক। অন্যদিকে হুমায়ুন কবিরও প্রবাসী নেতা হিসেবে যুক্তরাজ্যে প্রভাবশালী। ফলে প্রবাসী বিএনপির একটি অংশ লুনার পক্ষে, অন্য অংশ হুমায়ুনের পক্ষে। আর এমন বিভাজন তৈরি হয়েছে লন্ডন পর্যন্ত।
বিশ্বনাথ উপজেলা বিএনপির সদস্য তানিমুল ইসলাম বলেন, হুমায়ুন কবির স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে থাকেন। প্রবাসে দলের হয়ে কাজ করেছেন। এলাকার মানুষ তার সম্পর্কে তেমন জানেন না। এ আসনটি ইলিয়াস আলীর। এটি পুনরুদ্ধার করতে হলে ধানের শীষ প্রতীক তার সহধর্মিণী তাহসিনা রুশদীর লুনাকে দিতে হবে। এ আসনের মানুষ লুনা ছাড়া কাউকে মানবে না। আশা করি দলে হাইকমান্ড সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন।
এদিকে ইতোমধ্যে বিশ্বনাথ উপজেলা ও পৌর বিএনপি অঙ্গ সংগঠনের নেতারা লুনাকে ছাড়া কাউকেই ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে মানবেন না বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। তবে সাবেক ও পদ হারানো বিএনপি নেতারা ভিড়েছেন হুমায়ুন কবিরের পক্ষে। আর তাদের সঙ্গে নিয়েই নির্বাচনি মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন হুমায়ুন কবির। আগামী নির্বাচনে ইলিয়াসপত্নী ছাড়া অন্য প্রার্থী ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করলে এ আসন বিএনপি হারাতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলীয় হাইকমান্ড এখন এক কঠিন অবস্থানে। একদিকে দীর্ঘদিন মাঠে থাকা লুনা, অন্যদিকে তারেক রহমানের প্রভাবশালী উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। দল যদি ঐক্য ধরে রাখতে চায়, তাহলে প্রার্থী বাছাইয়ে কৌশলী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, যেই পক্ষ বাদ পড়বে, তাদের ক্ষোভের প্রভাব পড়বে নির্বাচনের মাঠে। সিলেট-২ আসনে প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে এর প্রভাব শুধু এই আসনে নয়, পুরো সিলেট বিভাগে পড়তে পারে। দলেও বিভক্তি দেখা দিতে পারে। কারণ ইলিয়াছ আলী সারা দেশেই জনপ্রিয় এবং পরীক্ষিত নেতা। ২০১২ সালে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হলে তাকে ফিরে পাওয়ার দাবিতে আন্দোলনে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় তার সংসদীয় এলাকা। নিহত হন তিন যুবক।
এ বিষয়ে ইলিয়াসপত্নী লুনা তাহসিনা রুশদীর লুনা খোলা কাগজকে বলেন, ‘ইলিয়াস আলী গুমের পর দলীয় চেয়ারপারসনের নির্দেশে আমি মাঠে নামি। এক যুগের বেশি সময় ধরে আমি মাঠে কাজ করছি। নেতাকর্মীরা আমার পাশে রয়েছেন। দল যদি আমাকে দায়িত্ব দেয়, আমি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করব। দল এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি সে পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।’ তিনি বলেন, ‘এই আসনের মানুষ আমার সঙ্গে আছে। আমার স্বামীর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব আমি নিতে চাই।’
তবে অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাকে মোবাইল ফোনে পাওয়া যায়নি।
সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ূম চৌধুরী খোলা কাগজকে বলেন, ‘দলের মধ্যে মারামারি, দলাদলি, বিভক্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাদের সঙ্গে আলোচনা করবো। যাতে এ ধরনের কোন ঘটনা আর না ঘটে।’ তিনি বলেন, ‘দল এখনো কাউকে মনোনয়ন দেয়নি। সময় হলে সব পরিষ্কার হবে।’
কেকে/ এমএস