# নানা অজুহাতে বাড়ে দাম
# আবারো সক্রিয় পুরোনো সিন্ডিকেট
# মনিটরিং বাড়ানোর তাগিদ ভোক্তাদের
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল এবার হয়তো বাজার পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি ঘটবে। কিন্তু দেখা গেল অন্য চিত্র, দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানার বিষয়ে দৃশ্যমান সফলতা নাই বললেই চলে। বরং বাজারে ফের অসাধুরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সরবরাহ ভালো থাকলেও নানা অজুহাতে রাজধানীসহ দেশের বাজারগুলোতে বেড়েই চলেছে সবজির দাম। দুই-চারটি ছাড়া বেশির ভাগ সবজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে এখন ৮০-১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সবজির দামের এমন লাগামহীনতায় ক্ষুব্ধ ক্রেতারা।
তারা মনে করছেন, বিগত সময়ের মতো আবার সক্রিয় হয়েছে অতি মুনাফাখোর সিন্ডিকেট। তারা নানা ছুতোয় দাম বাড়িয়ে পকেটে মুনাফা পুরছে। ভোক্তার পকেট কাটতে অসাধু চক্রটি পুরোনো মোড়কে নতুন করে কারসাজি করছে। এতে প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। এক্ষেত্রে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও পাইকারিতে ইচ্ছামতো মূল্য নির্ধারণ করছে অসাধুরা। আর তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন ক্রেতাসহ ভোক্তা সংশ্লিষ্টরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ডিমের বাজারে তো রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে। মুরগি আর মাছের দাম তো আগে থেকেই বাড়তি। চালের রেকর্ড ফলন হলেও সিন্ডিকেটের চালবাজিতে মূল্য বাড়ছেই। এছাড়া সবজির বাজারের চিত্রও সন্তোষজনক নয়। কেজিপ্রতি দুইশ টাকার নিচে তো কাঁচামরিচ মিলছেই না, কোনো সবজিই একশ টাকার নিচে নেই। এমনকি মসলাজাত পণ্যের দামেও হাঁসফাঁস অবস্থা সাধারণ মানুষের। বাজারে গিয়ে কোনটা কিনবেন আর কোনটা কিনবেন না, এই ভেবে হতাশ সাধারণ ক্রেতারা।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বাজার ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার জন্যই মূলত এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। মানুষ চায় দ্রুত কিছু পরিবর্তন আসুক। যেহেতু তারা বিপ্লবী সরকারের মতো, তাই মানুষ অ্যাকশন দেখতে চায়। গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এমনিতেই নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। সীমিত আয়ের মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। অসৎ ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে যেভাবে ইচ্ছামতো বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাতে এ পরিস্থিতি আর চলতে দেওয়া যায় না।
অন্যদিকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৭৫ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা, হাইব্রিড পেঁয়াজ ৭০ থেকে বেড়ে ৭৫ টাকায় উঠেছে।
কাজিপাড়া কাঁচাবাজারে সবজি কিনতে আসা একজন ক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই কি দাম বেড়ে যাবে! আমরা কি খাব বুঝতেছি না। সকল সবজি, মাছ ও মুরগির এত দাম; মনে হচ্ছে কোনো কিছু না নিয়েই বাড়ি যেতে হবে।’
কেবল কাঁচামরিচই নয়, বাজারে প্রায় সব ধরনের সবজির দামই চড়া। লম্বা বেগুন কেজিপ্রতি ১০০-১২০ টাকা, গোল বেগুন মানভেদে ১৪০-২০০ টাকা, ঢ্যাঁড়শ ও করলা ১০০-১২০ টাকা, বরবটি ১০০-১২০ টাকা, গাজর ১২০-১৪০ টাকা, আর শিম কেজিপ্রতি ২২০-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ সবজি, যেমন পটোল, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, শসা—সবকটির দাম ৮০-১০০ টাকার মধ্যে। ৭০ টাকার নিচে এখন আর কোনো সবজি পাওয়া যাচ্ছে না বললেই চলে।
শুধু সবজি নয়, মাংস ও মাছের দামও বেড়েছে। গরুর মাংস কেজিপ্রতি ৭৫০ টাকায় ও খাসির মাংস ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগি আগের মতো ১৮০ টাকা থাকলেও পাকিস্তানি সোনালি কক বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকায়। সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের মাছও ক্রমেই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মাঝারি আকারের রুই ও কাতল ৪০০-৪৫০ টাকা, তেলাপিয়া ২৫০-২৮০ টাকা, ট্যাংরা ৪০০-৫৬০ টাকা ও পাবদা ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে মসলার বাজারেও ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত। কিশমিশ, আলুবোখারা, এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনির দাম অপরিবর্তিত থাকলেও জিরা ৬৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৭০০, গোলমরিচ এক লাফে ১ হাজার ৫০০-১ হাজার ৭০০ টাকা কেজিতে, দেশি আদা ১৪০ বেড়ে ১৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, চায়না আদা ১৬০-১৭০ টাকায় পৌঁছেছে।
বাজারে ব্যাগ হাতে সবজি কিনতে বিক্রেতার সঙ্গে দামাদামি করছিলেন রাকিব হোসেন। তিনি বলেন, সদর প্রচুর সবজি উৎপাদন হয়েছে এবার। কৃষকরা বিক্রেতাদের কাছে কম দামে সবজি বিক্রি করলেও ক্রেতা পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।
মাছ কিনতে আসা আব্দুল হাই বলেন, ‘বাজারে মাছের প্রচুর সরবরাহ রয়েছে। অথচ ইচ্ছামতো দামে বিক্রি করে নিজেদের পকেট ভারি করছেন বিক্রেতারা। বাজারে অভিযান না চালানোর কারণেই নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে।’
দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সবজি বিক্রেতা রাজ্জাক মিয়া বলেন, ‘বৃষ্টিপাতে অনেক কৃষকের সবজি খেতে পানি জমেছে। সবজি পচে নষ্টও হয়েছে। চাহিদার তুলনায় বাজারে সবজি কম আসছে। ফলে দামও বেড়ে গেছে।’
ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, মৌসুম বদল, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি আর পাইকারি বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়াই সবজির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণ। তারপর কিছু এলাকায় বন্যা চলছে, বৃষ্টিতে কৃষক ঠিকমতো ফসল তুলতে পারেন না। পানি শুকিয়ে গেলে বৃষ্টি কমে গেলে আবার দাম কমে যাবে।
কারওয়ান বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা আরিফ হোসেন বলেন, ‘বাজারের সব ধরনের সবজি সরবরাহ অনেক কম। এর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত বৃষ্টি হচ্ছে, সেজন্য সবজি নষ্টও হচ্ছে। নতুনভাবে সবজি বাজারে উঠতে শুরু করলে দাম কমে আসবে। তিনি বলেন, দাম বাড়ার পর থেকে সবজি বিক্রি অনেক কমে গেছে। মানুষ এখন কম পরিমাণে সবজি কিনছে। আগে এক কেজি সবজি কিনলে এখন আধা কেজি কিনছে। সবমিলিয়ে সবজির দাম বাড়ার কারণে আমাদের ব্যবসাও কমে গেছে।’
বিভিন্ন হাতবদল হয়ে ক্রেতার হাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দাম বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে এই বাজারের অন্য এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘সবজি নিয়ে আসার পর ট্রাকে থাকা অবস্থাতেই বিক্রি হয়। আরেকজন কিনে নেন। এভাবে হাতবদলে দাম বাড়ে। কারওয়ান বাজারে রাতে পাইকারিভাবে যে দামে সবজি বিক্রি হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি দরে বিক্রি হয় খুচরা পর্যায়ে। হাত বদলায় আর দাম বাড়ে। এছাড়া এই সময় আবহাওয়ার কারণে জমিতে সবজি চাষ কম হয়, ফলে সরবরাহও কমে যায়। এ কারণে বর্তমানে বাজারে সবজির দাম বেশি।’
বাজারে মনিটরিং বাড়ানোর তাগিদ ভোক্তাদের:
হঠাৎ সবজির বাজার অস্থির হয়ে যাওয়ায় চাপে পড়েছেন নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষেরা। তারা নিত্যপণ্যের দাম আগুন হয়ে যাওয়ার পেছনে মনিটরিং ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দায়ী করছেন। তাদের মতে, বাজারে সরকারের মনিটরিং নেই। এই অবস্থা চলতে থাকলে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন-যাপন দুর্বিসহ হয়ে উঠবে। এতে করে দেশে চুরি, ছিনতাই ও অরাজকতা বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।
কেকে/ এমএ