সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫,
২৮ আশ্বিন ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
শিরোনাম: হামাস-ইসরায়েল বন্দি বিনিময় শুরু, প্রথম দফায় ৭ জিম্মি হস্তান্তর      ভারী বর্ষণ-বন্যায় মেক্সিকোতে নিহত ৪৪, নিখোঁজ ২৭      ১১ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় এক বিলিয়ন ডলার      জিয়া পরিবার জনগণের পরিবার : আমান উল্লাহ      রোমে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা      ২০০ তালেবান সৈন্যকে হত্যার দাবি পাকিস্তানের      বাতিল হওয়ার শঙ্কায় বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনার ভারত সফর      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
যখন জনগণ জানে না, তখন গণভোট অর্থহীন
রাফায়েল আহমেদ শামীম
প্রকাশ: সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫, ১০:০৬ এএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো জনগণ। সেই শক্তি প্রকাশের সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হলো ভোট। ভোটের শক্তি তখনই প্রকৃত অর্থ পায়, যখন ভোটদাতা জানেন তিনি কী বিষয়ে ভোট দিচ্ছেন, কেন ভোট দিচ্ছেন এবং তার ভোটের ফলাফল তার জীবন, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কী প্রভাব ফেলবে।
 
আজকের বাংলাদেশে যে গণভোটের প্রস্তুতি চলছে, তা আমাদের সমাজকে এক মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে যারা ভোট দেবেন, তারা আসলে জানেন কি, তারা কী বিষয়ে ভোট দিচ্ছেন? 

বাংলাদেশে গণভোটের ধারণা নতুন নয়। ইতিহাসে আমরা এর প্রয়োগ দেখেছি সামরিক শাসন বা একনায়কতান্ত্রিক সময়ের প্রেক্ষাপটে। ১৯৭৭ সালের ৩১ মে অনুষ্ঠিত জিয়াউর রহমানের গণভোট সেই বাস্তবতার উদাহরণ। বিপুল ভোটের তথ্য থাকলেও পরবর্তী বিশ্লেষণে দেখা গেছে জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণ প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। ভোট তখন ক্ষমতার বৈধতা প্রদানের সরল রূপ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছিল। এ ইতিহাস আমাদের শেখায়, যখন জনগণ অজ্ঞ বা বিভ্রান্ত থাকে, ভোট শুধু ক্ষমতার প্রতীক হয়ে যায়, গণতন্ত্রের নয়।

আজকের প্রস্তাবিত গণভোটও সেই একই প্রেক্ষাপটে হচ্ছে। জুলাই সনদকে সাংবিধানিক রূপ দেওয়ার জন্য যে গণভোট আয়োজন হতে যাচ্ছে, তার বিষয়বস্তু, প্রক্রিয়া ও সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সচেতন নয়। মফস্বলের সাংবাদিক, শিক্ষক, শ্রমজীবী নাগরিক বা শিক্ষার্থী অনেকেই জানে না এটি সংবিধান সংশোধন, রাজনৈতিক সংস্কার, নাকি ঐতিহাসিক স্বীকৃতিসংক্রান্ত। প্রচার যেমন চলছে, তা মূলত রাজনৈতিক দলের ব্যাখ্যা ও টকশোভিত্তিক বিতর্কের ওপর নির্ভরশীল। 

কোনো নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ নেই, কোনো তথ্যভিত্তিক ব্যাখ্যা নেই। ফলে জনগণ তথ্যহীন অবস্থায় ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

গণভোট শুধু রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি সামাজিক চুক্তির প্রতিফলন। যখন রাষ্ট্র জনগণের মতামত চায়, তখন এটি নাগরিকের অধিকার ও দায়িত্ব উভয়ের প্রতীক। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনের আগে জনগণকে জানতে, বুঝতে এবং আলোচনায় অংশ নিতে হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মানুষের মধ্যে প্রচলিত মনোভাব ‘ওসব বড়লোকদের বিষয়, আমাদের কী আসে যায়’ গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু। সচেতনতা ছাড়া ভোট দেওয়া মানে জনগণকে সিদ্ধান্তের বাইরে রাখা।

নাগরিকদের তথ্যভিত্তিক জ্ঞান থাকা নিরাপদ ও শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক দলগুলো এই দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। স্কুল ও কলেজে এ বিষয়ে আলোচনার অভাব, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের নীরবতা এবং টকশোতে দলীয় মুখপাত্রদের একে অপরের বিরুদ্ধে চিৎকার সবই প্রমাণ করে জনগণ সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও সমানভাবে জরুরি। দেশের অর্ধেক জনগণ নারী, কিন্তু গণভোট প্রক্রিয়া, কমিশন গঠন এবং খসড়া আলোচনায় তাদের কণ্ঠ অনুপস্থিত। এটি শুধু ন্যায়ের বিষয় নয়, এটি গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত অন্তর্ভুক্তি। গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়, যখন সব কণ্ঠ শোনা হয় এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। নারীর অনুপস্থিতি বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবহেলা শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে পক্ষপাতমূলক করে না, সামাজিক ন্যায়ের চর্চাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

গণভোটের প্রচারণা প্রায়শই আবেগনির্ভর ‘দেশের উন্নতি’, ‘গণতন্ত্রের উন্নয়ন’, ‘নতুন যুগের সূচনা’। কিন্তু কেউ জানাচ্ছে না ভোটে কার কী হারানো বা পাওয়ার সম্ভাবনা, রাষ্ট্রের কাঠামো কীভাবে বদলাবে। তথ্যের অভাবে ভোট তখন একটি প্রহসনের মতো হয়ে যায়। তুলনামূলক উদাহরণ হিসেবে ব্রেক্সিট গণভোট উল্লেখ করা যায়। যুক্তরাজ্যে গণভোটের আগে মাসব্যাপী জনআলোচনা, বিশেষজ্ঞ মতামত এবং গণমাধ্যম বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জনগণ জানত ভোটের ফল কী হতে পারে এবং তার প্রভাব কী হবে। বিভাজন ও বিতর্ক থাকলেও জনগণ সচেতন ছিল। বাংলাদেশে সেই সংস্কৃতি অনুপস্থিত; ভোট মানে শুধু নির্বাচনের দিন।

একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো কত শতাংশ ভোট পড়লে গণভোট বৈধ হবে? সংবিধান বা নির্বাচন কমিশনের নীতিমালায় স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। যদি অর্ধেক ভোটারও ভোট না দেয়, তাহলে কি গণভোট বৈধ হবে? এ অনিশ্চয়তায় পুরো প্রক্রিয়া সন্দেহজনক হয়ে ওঠে। পরবর্তী সরকার এটি বাতিল করলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় কেবল জনগণের করের অপচয় হয়ে থাকবে।

গণতন্ত্র কেবল ভোটের মাধ্যমে টিকে না; এটি টিকে থাকে জবাবদিহি, সচেতনতা এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে। গণভোটের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে জনগণকে জানার সুযোগ না দেওয়া মানে গণতন্ত্রকে দুর্বল করা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি নাগরিকের মতামত সমান গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা কার্যকর হয় তথ্যনির্ভর হলে। অজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে নেওয়া সিদ্ধান্ত কখনোই স্বাধীনতার প্রতীক নয়; বরং এটি গণতান্ত্রিক দেউলিয়াত্বের চিহ্ন।

বাংলাদেশে এখন প্রয়োজন নতুন ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে জনগণ কেবল ভোটার নয়, আলোচনার অংশগ্রহণকারী। যেখানে গণভোট মানে কেবল ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ নয়, বরং সামাজিক বিতর্ক, গণজাগরণ এবং শিক্ষামূলক প্রক্রিয়া। এ সংস্কৃতি তৈরি না হলে যত গণভোটই হবে, তা একটি নিরর্থক উৎসবে পরিণত হবে।

গণভোটের আগে জনগণের সচেতনতা ও জ্ঞান নিশ্চিত করা অবশ্যক। সরকার, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দল সবাইকে যৌথভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। অজ্ঞ জনগণের ভোট কখনোই গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারবে না। গণভোটের আগে সামাজিক প্রস্তুতি, তথ্যভিত্তিক বিতর্ক এবং জবাবদিহিমূলক আলোচনার সংস্কৃতি তৈরি করা জরুরি।

যদি এই প্রক্রিয়া না হয়, তাহলে ইতিহাসে এ গণভোট লেখা থাকবে প্রহসনের নামে, যেখানে জনগণ উপস্থিত ছিল কিন্তু তাদের জ্ঞান, সচেতনতা ও অংশগ্রহণ অনুপস্থিত ছিল। গণতন্ত্র তখন আর জনগণের শাসন থাকে না; এটি হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় নাটকের মঞ্চ, যার দর্শক আমরা সবাই, কিন্তু পরিচালক কেউই জনগণ নয়।

আন্তর্জাতিক তুলনা

গণভোট কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়। আন্তর্জাতিকভাবে দেখলে দেখা যায় গণভোটের সাফল্য এবং ব্যর্থতা দুটোই সচেতন জনগণের ওপর নির্ভর করে। ব্রেক্সিট, স্কটিশ স্বাধীনতা রেফারেন্ডাম, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া সবই প্রমাণ করে সচেতন জনগণ ছাড়া গণভোট অর্থহীন। ব্রেক্সিট গণভোটে হাজার হাজার তথ্যভিত্তিক প্রচারণা হয়েছিল। জনসংযোগ কার্যক্রম, মিডিয়া, বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ সবই জনগণকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত করেছে। বাংলাদেশে সে ধরনের প্রচেষ্টা নেই।

শিক্ষা ও মিডিয়ার অবস্থা গণভোটের ফলাফলের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। শিক্ষাব্যবস্থা যদি নাগরিক শিক্ষায় ব্যর্থ হয়, মিডিয়া যদি পক্ষপাতমূলক হয়, এবং রাজনৈতিক দল তথ্য দেয় না, তাহলে ভোট আর গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য থাকে না।

নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের গুরুত্বও অপরিসীম। সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্ত গণতন্ত্র ছাড়া গণভোট কখনোই সফল হতে পারে না। নারীর অনুপস্থিতি এবং দরিদ্র বা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ব্যাহত হওয়া মানে সামাজিক ন্যায় ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

গণভোটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রশাসনিক স্বচ্ছতা। সংবিধান এবং নির্বাচন কমিশনের নীতিমালা স্পষ্ট না হলে, ভোটের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এটি শুধু ভোটের ফলাফলের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ সরকারের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ভোটারের জ্ঞান ও সচেতনতা নিশ্চিত করা হলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়, সরকার জবাবদিহি হয় এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

গণতন্ত্র কেবল ভোট নয়; এটি টিকে থাকে সচেতন মানুষের অংশগ্রহণ, প্রশ্ন, আলোচনা ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে। অজ্ঞ জনগণের ভোট কোনো গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। জনগণকে জানানো, শেখানো এবং যুক্ত করা না হলে, গণভোট হয় কেবল একটি মঞ্চায়িত প্রহসন।

শেষ কথা, গণভোট যদি সত্যিই জনগণের ক্ষমতার প্রতীক হতে চায়, তবে প্রথমেই দরকার জনগণকে জ্ঞানের ক্ষমতায়ন দেওয়া। অজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র টিকে না; টিকে থাকে সচেতন মানুষের চিন্তা, প্রশ্ন এবং সিদ্ধান্তের ওপর। তাই সময় এসেছে গণভোটের আগে জনগণকে জানানো, শেখানো এবং যুক্ত করার। তাহলেই গণভোট হবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক উৎসব, প্রহসন নয়।

 লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলামিস্ট

কেকে/ এমএস
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

ফ্যাসিস্ট নাসিমের প্রতারণার শিকার শতাধিক নারী
হামাস-ইসরায়েল বন্দি বিনিময় শুরু, প্রথম দফায় ৭ জিম্মি হস্তান্তর
বিশ্ব ব্যর্থতা দিবস আজ
সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠনের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
নালিতাবাড়ীতে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস পালিত

সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচন নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে : তানভীর হুদা
রাজশাহীতে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস পালিত
মুরাদনগরের ওসি জাহিদুরের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বসহ নানা অভিযোগ, অপসারণ দাবি
মৌলভীবাজারে জামায়াত ও খেলাফত মজলিসের স্মারকলিপি
নালিতাবাড়ীতে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস পালিত

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close