রোববার, ১২ অক্টোবর ২০২৫,
২৭ আশ্বিন ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

রোববার, ১২ অক্টোবর ২০২৫
শিরোনাম: নির্বাচনে ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা      অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিনিধি দল      ইতালির পথে প্রধান উপদেষ্টা      যুদ্ধবিরতির পর গাজায় একদিনে ফিরেছেন ৫ লাখ ফিলিস্তিনি      ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামে যোগ দিতে আজ ইতালি যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা      ইলিয়াস দুর্গে হঠাৎ হুমায়ুন, সুযোগ সন্ধানে জামায়াত      জাতির খলনায়ক আসিফ      
খোলাকাগজ স্পেশাল
জাতির খলনায়ক আসিফ
আলতাফ হোসেন
প্রকাশ: রোববার, ১২ অক্টোবর, ২০২৫, ১২:০৯ এএম আপডেট: ১২.১০.২০২৫ ১১:০৩ এএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। ছিলেন ২০২৪ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অগ্রনায়ক। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের। সে সময়ের দৃঢ় নেতৃত্ব তাকে জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিতি এনে দেয়। এরপর রাষ্ট্র সংস্কার এবং নতুন বন্দোবস্তের ধুঁয়ো তুলে জায়গা করে নেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে। 

কিন্তু উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকে তার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যাপক অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এসব ঘটনায় তিনি পরিণত হন জাতির খলনায়কে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাকে ‘দুর্নীতির বরপুত্র’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। তাদের মতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আসিফ মাহমুদের আচরণে স্বৈরাচারী স্বভাবের ছায়া আরো স্পষ্ট হচ্ছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।

জানা যায়, আসিফ মাহমুদ ২৪-এর ৯ আগস্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত হন যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের। পরবর্তী সময়ে একই বছরের ১০ নভেম্বর তাকে স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একইসঙ্গে সরিয়ে দেওয়া হয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে। এত অল্প সময়ে একাধিক দপ্তরের দায়িত্ব পাওয়ায় সে সময় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই প্রশ্ন তোলেন তার প্রভাব ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে। একইসঙ্গে প্রশ্ন ওঠে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এ মন্ত্রণালয় দুটি চালানোর ক্ষেত্রে তার যোগ্যতা ও সক্ষমতা নিয়েও।

তবে আসিফ মাহমুদ মন্ত্রণালয়ের চেয়ারে বসেই ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেন। গণমাধ্যমে আসতে থাকে তার একের পর এক অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতার খবর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওঠে সমালোচনার ঝড়, আসতে থাকে পদত্যাগের দাবিও। হতাশ হতে থাকেন তার শুভাকাক্সক্ষীরাও। এক সময় আসিফে অতিষ্ঠ হয়ে সমালোচনায় অংশ নেন তারাও।

আসিফ মাহমুদকে নিয়ে প্রথম বিতর্ক শুরু হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র পদ নিয়ে। এরপর এক এক করে তার এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনের ব্যাপক দুর্নীতি, উপদেষ্টার বাবার ঠিকাদারি লাইসেন্স, মুরাদনগরে ট্রিপল মার্ডারে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ, নারী শিক্ষককে আটকে রেখে মারধরের অভিযোগও ওঠে তার স্কুলশিক্ষক বাবার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া বিদেশ যাত্রার সময় বিমানবন্দরে আসিফ মাহমুদের ম্যাগাজিন কাণ্ড, উন্নয়ন প্রকল্পের ফাইল বাসায় নিয়ে গায়েব, এলজিইডির প্রকল্পে বৈষম্যমূলক বরাদ্দ, দেশের ক্রীড়াঙ্গনের বিভিন্ন সেক্টরে নগ্ন হস্তক্ষেপসহ আরো নানা বিষয়ে অভিযোগ উঠেছে।

শুধু তাই নয়, নিয়োগ ও বদলিবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, পরোক্ষ চাঁদাবাজি এবং পছন্দের ঠিকাদারদের বড় অঙ্কের লেনদেনের বিনিময়ে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এরকম অনিয়মের মাধ্যমে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন তিনি। 

ইতোমধ্যে আসিফ মাহমুদকে নিয়ে মন্ত্রণালয়েও শুরু হয়েছে অসন্তোষ। তার আশপাশের কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়েও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে নানা জল্পনা আছে। তার বিরুদ্ধে নানা বিতর্ক ও অভিযোগের কারণে তার দুই মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তাও অস্বস্তিতে আছেন। তারা মনে করছেন, উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করলে তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু হতে পারে। ফেঁসে যেতে পারেন বর্তমানে তার আশপাশে থাকা কুশীলবরাও। যেহেতু তার সাবেক এপিএসের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দুদক তদন্ত শুরু করেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে আসিফ মাহমুদের পদত্যাগ ও ভোটের ময়দানে নামার সম্ভাবনা নিয়ে অনেকেই বলছেন, পদত্যাগের পর নির্বাচনে অংশ নেওয়া তো দূরের কথা, নিজ এলাকায়ই তিনি যেতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, আসিফ মাহমুদের সাবেক এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, তদবির ও টেন্ডার-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে তাকে সবাই একঘরে করে রেখেছেন। 
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সরকারে সবচেয়ে ক্ষমতাধর উপদেষ্টা হচ্ছেন আসিফ মাহমুদ। তিনি তার দুই মন্ত্রণালয়ে যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর চাউর হলেও নির্বিকার প্রধান উপদেষ্টা, আসিফের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা।
 
অনেকে মনে করছেন, আফিস মাহমুদ এনসিপির প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকায় এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রধান উপদেষ্টাকে তার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। আর কর্মকর্তাদের কথায়, ‘উপদেষ্টার প্রভাব ও দাপটের কারণে কিছু কর্মকর্তাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন, যা প্রতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও নীতি-নির্ধারণে বাধা সৃষ্টি করছে।’

প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন বলেছেন, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দপ্তর পাওয়ায় তিনি কাজেকর্মে দাপট দেখাচ্ছেন। তবে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। তার বিরোধিতার কারণে আদালতের রায় পাওয়ার পরও ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হিসেবে শপথ নিতে পারেননি ইশরাক হোসেন। বিসিবি থেকে ফারুক আহমেদকে বিতর্কিতভাবে সরানোর পেছনে তার ভূমিকা দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। ফেসবুক পোস্টে কখনো মবকে উৎসাহ দিচ্ছেন, কখনো এনসিপির কর্মসূচি জমাতে পরোক্ষ ভূমিকা রাখতে চাইছেন। পাশাপাশি বিএনপির কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় সক্রিয়। ফলে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন, তিনি সরকারে আছেন, না এনসিপিতে আছেন এটি আলাদা করে বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, সেফ এক্সিটের তালিকা করলে সবার ওপরে থাকবে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার নাম। আসিফ মাহমুদ যেখানে যান সেখানেই বিতর্ক তৈরি করেন। বিসিবির নির্বাচনেও সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন তিনি। এত ছোট বয়সে এত বড় দায়িত্ব দেওয়ার ফলে সে যে কি পরিমাণ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে তা ভাবাই যায় না। তিনি বলেন, যদি অন্তর্বর্তী সরকারের মিনিমাম সেন্স থাকত তাহলে আসিফ মাহমুদকে সবার আগেই বিদায় করত। এর পুরো দায় কিন্তু সরকারের ওপরই বর্তাচ্ছে। 

মাসুদ কামাল বলেন, ‘এলজিডি উপদেষ্টা হিসেবে আসিফ মাহমুদ নিজের প্রভাব খাটিয়ে নিজ এলাকায় বিপুল পরিমাণ উন্নয়ন বরাদ্দ নিয়েছেন যা অন্তত ১০টি জেলার মধ্যে কোনো জেলাই পায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি নিজ এলাকার আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর সেই কারণেই এত বেশি বরাদ্দ দিয়ে তিনি স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেছেন, আসিফ মাহমুদ রাষ্ট্রীয় তহবিল ব্যবহার করে তার নির্বাচনি প্রচারণা চালাচ্ছেন। নির্বাচনের আগে তিনি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করছেন। কুমিল্লার সড়ক ও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ২,৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। 

প্রকল্পটির বরাদ্দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ যাচ্ছে আসিফ মাহমুদের নিজ উপজেলা মুরাদনগরে ৪৫৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর উপজেলা দেবীদ্বারে ৩৩৮ কোটি টাকা। অথচ প্রকৃত প্রয়োজন যেখানে রয়েছে, সেই এলাকায় বরাদ্দ অত্যন্ত কম। 

এভাবে দেখা যায়, নির্বাচনি সুবিধা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, হাসনাত আবদুল্লাহকেও নির্বাচনি কাজ সাপোর্ট করা হচ্ছে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এনসিপির সব প্রার্থীর ক্ষেত্রে অনুরূপ ঘটনা ঘটছে। আফিস মাহমুদ সরকারে বসে জনগণের টাকা দিয়ে নির্বাচনি কাজ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার প্রশ্রয়ে এসব ঘটছে। আসিফ মাহমুদের একের পর এক কর্মকাণ্ড সরকারের ইমেজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তবে ড. ইউনূসের মধ্যে কোনো উদ্বেগ বা প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ দেখা যায় না। 

আসিফ মাহমুদের মধ্যে আমি হাসিনার চেহারা দেখছি উল্লেখ করে জাহেদ উর রহমান বলেন, আসিফ মাহমুদ বলেন, তিনি এনসিপির না; তাহলে হাসনাত আবদুল্লার উপজেলায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকা বরাদ্দ কেন? এটি মনে করিয়ে দেয়, যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন, তখন এডিপি বরাদ্দে প্রথম স্থান ধরা হতো ঢাকা, দ্বিতীয় চট্টগ্রাম, এবং গোপালগঞ্জ ছিল তৃতীয়। গোপালগঞ্জের বরাদ্দ রংপুর বিভাগের আটটি জেলার চেয়ে বেশি ছিল। এভাবে দেখা যাচ্ছে, আসিফ মাহমুদ শেখ হাসিনার সময়কার নির্বাচনি নীতির অনুরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করছেন এবং তা ড. ইউনূসের উপস্থিতিতে ঘটছে। অনেকের মতে, আসিফ মাহমুদকে কেবিনেট থেকে আগে সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। 

এ বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘দুর্নীতির যেসব অভিযোগ এসেছে বিশেষ করে তার সাবেক এপিএস সম্পর্কে তারপর তার নিজের ব্যাপারে প্রথমত, নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে অনেক আগেই তার পদত্যাগ করা উচিত ছিল। এখন তার উচিত উপদেষ্টা পরিষদ থেকে অবিলম্বে পদত্যাগ করা। তিনি পদত্যাগ না করলে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে। দ্বিতীয়ত, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উচিত হবে সুনির্দিষ্টভাবে তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের বাইরে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হওয়া দরকার।’

তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে যেসব ঘটনা ঘটছে, তার প্রত্যেকটির জবাবদিহি পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে করতে হবে। উপদেষ্টাদের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, নির্বিচার বদলি ও নিয়োগ, টেন্ডারবাজি এবং প্রশাসনিক অনিয়মসহ নানা ইস্যু এখন জনমনে গভীর বিতর্ক ও অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এ সরকার অভ্যুত্থানের প্রকৃত তাৎপর্য ও দায়বদ্ধতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। মননশীলতার অভাব, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ঘাটতি এবং জনআস্থার সংকটের কারণে তারা নিজেদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। এ সরকার একটা পক্ষ অবলম্বন করে তরুণদের পথভ্রষ্ট করেছে।’

বিসিবি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ 

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচনে সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে গত ১ অক্টোবর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন ওল্ড ডিওএইচএসের কাউন্সিলর ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালসহ মোট ১৬ প্রার্থী। পরবর্তী সময়ে অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ এনে আরো চার প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। একাধিক রিট ও আইনি জটিলতার মধ্য দিয়ে অবশেষে বিতর্কিত ও একপেশে নির্বাচনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন। 

নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর কিছুদিন পরই একটি সংবাদ সম্মেলনে তামিম বলেছিলেন, সরকারের একটি অংশ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার পরও সাবেক এ অধিনায়ক তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, ‘আজকে ক্রিকেট শতভাগ হেরে গিয়েছে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আপনারা বড় গলায় যে বলেন বাংলাদেশে ফিক্সিং বন্ধ করা লাগবে। আগে নির্বাচনের ফিক্সিং বন্ধ করুন, পরে ক্রিকেটের ফিক্সিং বন্ধ করার চিন্তাটা করবেন।’

এদিকে বিসিবি নির্বাচনে সভাপতির পদে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের প্রতি নিজের সমর্থনের কথা জানিয়ে এক বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘বুলবুল ভাই আমার ব্যক্তিগত পছন্দের প্রার্থী।’ তার এ বক্তব্যে বিসিবি নির্বাচনে তার হস্তক্ষেপের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

২৪০০ কোটি টাকার বরাদ্দ বিতর্ক 

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে কুমিল্লা জেলায় ২৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, যার মধ্যে ৪৫৩ কোটি টাকা আসিফ মাহমুদের নিজ উপজেলা মুরাদনগরে। এ ছাড়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহর উপজেলা দেবীদ্বারে ৩৩৮ কোটি টাকা। যা রাজনৈতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে। 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘এই বরাদ্দ বণ্টন স্বচ্ছতার মূলনীতি ও সমতা ভঙ্গ করেছে।’ জনমনে ধারণা তৈরি হয়েছে, এটি ক্ষমতার অপব্যবহারের উদাহরণ, যা সরকারের নৈতিকতা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। 

ফাইল গায়েবের অভিযোগ চসিক মেয়রের 

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে একটি ‘গুরুতর অনিয়মের’ অভিযোগ তুলেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। প্রকাশ্য এক সভায় তিনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা উন্নয়ন প্রকল্পের ফাইল দেখলে তা মন্ত্রণালয় থেকে বাসায় নিয়ে যান এরপর আর সেই ফাইল ফেরত আসে না। ফলে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো মাসের পর মাস স্থবির হয়ে থাকে। আমাদের তিনটি প্রকল্প এখনো এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। 

তিনি আরো বলেন, ‘আমি গত ১১ মাসে এ অভিজ্ঞতা বারবার পেয়েছি। ফাইল আর মন্ত্রণালয়ে পাওয়া যায় না। আমি খুঁজতে খুঁজতে বলিÑ কিরে, আমার ফাইল কই? তখন বলে, ফাইল তো বাসায় নিয়ে গেছে। বাসায় নেওয়ার পর সেটা আর সিগনেচার হয় না, আর ফেরতও আসে না।’ চসিক মেয়রের এই বক্তব্যে নতুন করে আলোচনার ঝড় ওঠে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ঘিরে। 

বিমানবন্দরে পিস্তলের ম্যাগাজিন কাণ্ড

২০২৫ সালের জুনে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মরক্কো যাত্রাকালে আসিফ মাহমুদের লাগেজে তল্লাশি করার সময় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা একটি গুলির ম্যাগাজিন উদ্ধার করেন। সাধারণত বিমানবন্দরে অস্ত্র বা তার অংশ বহন নিষিদ্ধ হওয়ায় বিষয়টি তৎক্ষণাৎ বিতর্কের সৃষ্টি করে। প্রাথমিকভাবে আসিফ মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, এটি বৈধ অস্ত্রের অংশ, ভুলবশত ব্যাগে থেকে গেছে। তবে বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে তীব্র আলোড়ন তোলে। সমালোচকরা প্রশ্ন তোলেন একজন উপদেষ্টার লাগেজে এমন সামগ্রী থাকা কতটুকু গ্রহণযোগ্য? জনমনে বিতর্ক ছড়ায় যে, ক্ষমতার অবস্থান ব্যবহার করে আইনগত বিধিনিষেধ এড়িয়ে চলা হয়েছে। 

ডিএসসিসির মেয়র পদ নিয়ে বিতর্ক
 
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারির ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) কারচুপির নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত বেশি ভোট পেলেও আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। সে সময় নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে ফলাফলের গেজেট বাতিল চেয়ে আবেদন করেন ইশরাক। বিষয়টি আমলে নিয়ে চলতি বছরের ২৭ মার্চ নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল আগের ফল বাতিল করে ইশরাককে বৈধ মেয়র ঘোষণা করে। 

পরে ২৭ এপ্রিল নির্বাচন কমিশনও গেজেট প্রকাশ করে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়র ঘোষণা করে। কিন্তু ২২ মে হাইকোর্ট সেই গেজেট ও ট্রাইব্যুনালের রায় স্থগিত চেয়ে করা রিট খারিজ করে দেয়। এরপর ২৬ মে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় নির্বাচন কমিশনের দেওয়া গেজেট স্থগিত চেয়ে করা রিট খারিজের বিরুদ্ধে আপিল করেন রিটকারী আইনজীবী। পরবর্তী সময়ে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত ন্যস্ত করেন নির্বাচন কমিশনের ওপর। 

কিন্তু নির্বাচন কমিশন তো আগেই গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিল। সেই অর্থে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাকের মেয়র হতে আর বাধা থাকে না। তবুও উপদেষ্টা আসিফের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে মন্ত্রণালয় শপথ অনুষ্ঠান আয়োজন না করায় আন্দোলনে নেমে নগরভবন অচল করে দেয় ইশরাক সমর্থকরা। শেষ পর্যন্ত মেয়র হিসেবে আর শপথ নিতে পারেননি ইশরাক। 

ইশরাক অভিযোগ করেন, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে প্রশাসক বানিয়ে রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছেন এবং জনগণের ম্যান্ডেটকে অগ্রাহ্য করেছেন। 

বিতর্কে আসিফ মাহমুদের বাবা বিল্লাল হোসেনও 

২০২৫ সালের মার্চে আসিফ মাহমুদের বাবার বিল্লাল হোসেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এলজিইডি থেকে ঠিকাদারি লাইসেন্স পান। বিষয়টি কেন্দ্র করে অভিযোগ ওঠে যে একজন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আসিফ মাহমুদ নিজের পরিবারকে সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রথমে আসিফ বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করতে বাধ্য হন। জনমনে এটি স্বার্থের সংঘাত ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হয়। তীব্র সমালোচনার মুখে এলজিইডি কর্তৃপক্ষও তৎক্ষণাৎ এই লাইসেন্স পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দেয় এবং পরে তা বাতিল করা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারি নৈতিকতার প্রশ্নও নতুনভাবে আলোচিত হয়।

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মা-ছেলে-মেয়েকে হত্যার ঘটনায় নিহতদের পরিবার আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার বাবা বিল্লাল মাস্টারকে দায়ী করে গ্রেফতারের দাবি তোলেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে নিহতদের পরিবারের সদস্য রুমা আক্তার বলেন, ‘বিচার চাওয়ার তো অধিকারই নেই, উল্টো নিজেদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কারণ এ হত্যাকাণ্ডে শুরু থেকে মদদ দিয়েছেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার বাবা বিল্লাল মাস্টার। তার প্রভাব এবং সাহসে এমন হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন শিমুল চেয়ারম্যান ও তার দোসরেরা।’
 
এ ছাড়া আকুবপুর ইয়াকুব আলী ভূঁইয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক শিখা রানীর অভিযোগ, তাকে স্কুলের একটি কক্ষে আটকে রেখে প্রথমে পদত্যাগের জন্য চাপ দেওয়া হয়। রাজি না হলে একপর্যায়ে তার ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। দীর্ঘ ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ওই কক্ষে অবরুদ্ধ করে রেখে বিবস্ত্র করেও চালানো হয় নির্যাতন। পরে তাকে স্কুল থেকে বের করে ঘুরানো হয় গ্রামের প্রধান সড়কগুলোতে। যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেই ভিডিওতে শিখা রানীকে হেনস্তাকারীদের দলে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবা ওই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক বিল্লাল হোসেনকেও দেখা যায়। 

এ বিষয়ে শিখা রানী বলেন, ‘স্কুলের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আসিফের বাবা বিল্লাল হোসেনকে ২০১৪ সালে বহিষ্কার করা হলে তখন আমি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হয়েছিলাম। এটাই আমার অপরাধ। এখন আমার ছাত্র আসিফ উপদেষ্টা হওয়ার পর খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু ছেলে উপদেষ্টা হওয়ার পর তার বাবা আমার প্রতি সেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।’

নির্বাচন ও পদত্যাগ নিয়ে জল্পনা 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে আসিফ মাহমুদ হয়তো পদত্যাগ করে ভোটের ময়দানে নামতে পারেন। ইতোমধ্যে তার নির্বাচনি এলাকায় জনসংযোগ, উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন এবং প্রচারমূলক কার্যক্রম বেড়েছে। অনেকেই বলছেন, তিনি প্রশাসনিক পদ ব্যবহার করে রাজনৈতিক ভিত্তি শক্ত করছেন। তবে নিজে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছেন, ‘আমি এখন শুধু সরকারের দায়িত্ব পালনে মনোযোগী।’ তবুও তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা-জরিপ চলছেই।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এছাড়া তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

কেকে/ এমএস
আরও সংবাদ   বিষয়:  ছাত্র-জনতা   গণঅভ্যুত্থান   উপদেষ্টা   আসিফ মাহমুদ  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

টঙ্গীতে জামায়াতের জনসংযোগ শুরু
নির্বাচনে ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ শিকার করায় ২ জেলের কারাদণ্ড
জিরানী বাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৭ দোকান ভস্মীভূত
ফরিদপুরে ‌শুরু হয়েছে মাসব্যাপী টাইফয়েড ও টিকা দান ক্যাম্পেইন

সর্বাধিক পঠিত

ইলিয়াস দুর্গে হঠাৎ হুমায়ুন, সুযোগ সন্ধানে জামায়াত
জাতির খলনায়ক আসিফ
কুমিল্লায় নোয়াখালীর বাস আটকে দিল জনতা
‘শিশু নোবেল’-এর জন্য মনোনয়ন পেল জামালপুরের দুই বোন
টেকনাফে আফসি হত্যার বিচার দাবিতে মানববন্ধন
সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close