বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তসন্নিকটে গত কয়েক দিনের মধ্যে আরাকান আর্মি (অঅ), আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি (অজঝঅ) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (জঝঙ)-এই তিন গোষ্ঠীর মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে। সীমান্তবর্তী মিয়ানমার প্রান্তে এ সংঘর্ষে সাধারণ মানুষের প্রাণ ও সম্পত্তি হুমকিতে রয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে রাতের বেলা সীমান্তের ওপার থেকে ভারী গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বিশেষ করে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন, উখিয়ার থাইংখালী, রহমতেরবিল ও পালংখালী ইউনিয়ন এবং টেকনাফের হোয়াইক্যং- এসব স্থানে সীমান্তের ওপার থেকে যুদ্ধের তীব্রতা স্পষ্টভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রাতভর তীব্র গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। বৃহস্পতিবার রাত ১১টার পর থেকে শুরু হওয়া এই গোলাগুলি শুক্রবার ভোর পর্যন্ত থেমে থেমে চলতে থাকে। এতে সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু পশ্চিমপাড়া ও উখিয়ার থাইংখালীর বাসিন্দারা জানান, রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত টানা গুলির শব্দে ঘুমাতে পারেননি অনেকে।
একজন ঘুমধুমবাসী বলেন, রাতের বেলা এমনভাবে গুলি আর বোমার শব্দ আসে যে, মনে হয় যুদ্ধ লেগে গেছে। শিশুরা ঘুমাতে পারে না, বৃদ্ধরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এ বিষয়ে পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিয়ে যে সংঘর্ষ হচ্ছে, এতে এপারের সীমান্ত এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে দিন পার করছে। ওইপারের গুলি এসে এপারে পড়ছে। গতকাল রাত ১০টা থেকে সকাল পর্যন্ত অনবরত গুলি ও মর্টারশেলের বিকট শব্দে কাপছে এই পার। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো মিয়ানমার থেকে গোলা এসে এই পাড়ে এক রোহিঙ্গার গায়ে গুলি লেগে। সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ গুলির শব্দে সারা রাত ঘুমাতে পারছে না। এর একটি সমাধান চাই আমরা।
স্থানীয় শিক্ষক বাশার বলেন, রাতে প্রচুর গুলির শব্দ শুনেছি। ওপারে বড় কোনো সংঘর্ষ চলছে মনে হচ্ছে। এমন শব্দ আগে শোনা যায়নি, সবাই আতঙ্কে আছি।
স্থানীয় ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন সূত্রগুলো জানায়, মিয়ানমারের মংডু জেলার ঢেকুবনিয়া এলাকায় রোহিঙ্গা সশস্ত্রগোষ্ঠী ও রাখাইনদের নিয়ন্ত্রণাধীন আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া দুটি ছবিতে দাবি করা হয়Ñ সংঘর্ষের গুলিতে বাংলাদেশে আশ্রিত মো. ইয়াসের (১৭) নামে এক রোহিঙ্গা আহত হয়েছেন। তবে এ বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি।
এদিকে টেকনাফ ব্যাটালিয়নের (২ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, মিয়ানমারের ভেতরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ চলছে, যা সম্পূর্ণভাবে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়। সীমান্তে বিজিবি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে, নিয়মিত টহল জোরদার করা হয়েছে এবং যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।
বিজিবি উখিয়া ৬৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জসীম উদ্দিন বলেন, মিয়ানমারের ভেতরে বিভিন্ন সশস্ত্রগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ বহুদিন ধরেই চলছে। সীমান্তে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে। স্থানীয়দের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের পূর্ব জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা জানান, নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে কোস্ট গার্ড সদস্যরা নিয়মিত টহল জোরদার রেখেছেন। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোস্ট গার্ড প্রস্তুত রয়েছে।
অন্যদিকে, উখিয়া ৬৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ঘুমধুম সীমান্তে ও বালুখালী বিওপির কাছাকাছি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তর থেকে আসা গুলির শব্দ শোনা গেছে। টহল জোরদার করা হয়েছে। রোহিঙ্গা আহত প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের ভেতরে কোনো গুলি আসেনি। ঘটনাস্থল ১২ নম্বর ক্যাম্প সীমান্ত থেকে অনেক দূরে।
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে দেশটির বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে লড়াই চালিয়ে রাখাইনের অধিকাংশ শহর ও প্রায় ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। তবে সেখানেও এখনো সংঘাত চলমান রয়েছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, সংঘর্ষের ঘটনাটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে, সীমান্ত থেকে অনেক দূরে ঘটছে। এপারে গুলি আসার সম্ভাবনা নেই।
এ বিষয়ে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক ও ঘুমধুম জোন কমান্ডার লে. কর্নেল এস এম খায়রুল আলম (পিএসসি) বলেন, আমরা সতর্ক অবস্থানে থেকে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের অক্টোবরে মিয়ানমারে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর আরাকান আর্মি দাবি করে, তারা রাখাইন রাজ্যের একটি বড় অংশসহ বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের মংডু শহর ও প্রায় ২৭১ কিলোমিটার এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এর পর থেকে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও আরসাসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করেছে, যার প্রভাব বাংলাদেশ সীমান্তেও পড়ছে।
রাখাইনের সহিংসতা ও ত্রিমুখী সংঘর্ষ সীমান্তের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে। নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে শুরু করে টেকনাফ পর্যন্ত সীমান্তবাসী এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সবাই একটাই দাবি তুলেছেন আমরা শান্তি চাই, গোলাগুলি নয়।
এদিকে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ৬৬ কিলোমিটার দীর্ঘ নাফ নদীতে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি নাফ নদী ও সীমান্ত এলাকায় উখিয়া ৬৪ এবং টেকনাফ ২ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
কেকে/এআর