শিক্ষক হচ্ছেন সেই প্রদীপ, যিনি নিজের আলোয় শিক্ষার্থীর মনকে আলোকিত করেন এবং জীবনের অন্ধকারে তাঁদের সঠিক পথ দেখান। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, একটি ব্রত।
সভ্যতার দীর্ঘ অভিযাত্রায় মানবসমাজকে যে কজন ব্যক্তি সর্বদা আলোর পথে পরিচালিত করেছেন, তাঁদের মধ্যে শিক্ষক সর্বশ্রেষ্ঠ। শিক্ষক কেবল পাঠদাতা নন, তিনি হচ্ছেন জীবনের স্থপতি, জ্ঞানের সেতুবন্ধনকারী এবং মূল্যবোধের ধারক। তাঁর হাতেই গড়ে ওঠে আগামী দিনের কান্ডারী, যাঁরা জাতিকে ভবিষ্যতের শিখরে পৌঁছে দেয়। তাই শিক্ষককে যথার্থই বলা হয় আলোকবর্তিকা। যিনি নিজে দগ্ধ হন, কিন্তু অন্যের অন্তরকে জ্ঞানের আলোয় বিকশিত করে তোলেন। একজন গুনী শিক্ষক কেবল শুধু বর্ণমালা শেখান না, তিনি শেখান মানুষ হওয়ার শিল্প।
দেখান স্বপ্নের সিড়ী। তিনি শিশুর কচি মস্তিষ্কে স্বপ্ন বুনে দেন, কিশোরের কল্পনাকে ডানা মেলতে শেখান এবং তরুণের চোখে ভবিষ্যতের আলোকচ্ছটা জাগিয়ে তোলেন। প্রকৃতপক্ষে, সমাজে যদি নৈতিকতা, সত্যনিষ্ঠা ও মানবিকতার আলো জ্বলে থাকে, তবে তার শিকড় নিহিত রয়েছে শিক্ষকের মমতাময় হৃদয়ে ও অক্লান্ত সাধনায়।
আজকের প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীতে তথ্য পাওয়া সহজ, কিন্তু জ্ঞান অর্জন এখনও কঠিন। কারণ জ্ঞান মানে কেবল তথ্যের সঞ্চয় নয়, বরং তার যথার্থ ব্যবহার। আর এই ব্যবহার শেখাতে পারেন কেবল একজন মহৎ শিক্ষক। বই কিংবা যন্ত্র মানুষকে তথ্য দিতে পারে, কিন্তু অন্তরের অন্ধকার দূর করার ক্ষমতা কেবল শিক্ষকের মধ্যেই বিদ্যমান। তাই শিক্ষক সত্যিই অন্ধকারে পথহারা মানুষের কাছে এক অদ্বিতীয় দিশারী।
বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। মুক্তিসংগ্রাম থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিটি ধাপেই শিক্ষক সমাজ জাতিকে দিশা দেখিয়েছেন, শিখিয়েছেন বাঁচার মন্ত্রনা। তাঁরা ছিলেন আন্দোলনের অগ্রভাগে, ছিলেন জাতি জাগরণের এক অন্যতম পুরোধা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজও আমাদের দেশে শিক্ষকের প্রাপ্য মর্যাদা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাঁদের আর্থিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক অবমূল্যায়ন ও রাজনৈতিক প্রভাব অনেক সময় শিক্ষকের প্রকৃত ভূমিকা পালনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অথচ জাতির উন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষক সমাজের মর্যাদা রক্ষার ওপর।
একজন সৎ ও আদর্শবান শিক্ষক এক প্রজন্মকে গড়ে তুলতে পারেন; আর সেই প্রজন্মই বদলে দিতে পারে সমগ্র জাতির ভাগ্য। বিপরীতে, যদি শিক্ষক সমাজ অবহেলিত হয়, তবে তার মাশুল গুনতে হয় গোটা দেশকে। তাই আজ সময় এসেছে শিক্ষকের যথার্থ সম্মান, মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।
শিক্ষক দিবস কেবল আনুষ্ঠানিক স্মরণ নয়, বরং আত্মসমালোচনা ও অঙ্গীকারের দিন। এ দিন আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। আমরা কি সত্যিই শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা দিচ্ছি? আমরা কি তাঁদের সেই সম্মান দিচ্ছি, যা তাঁর প্রাপ্য ?
জাতির ভবিষ্যৎ গড়তে চাইলে, আমাদের প্রথম কাজ হবে শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করা। তাঁদের হাতে শক্তি জোগানো, তাঁদের জীবনকে নিরাপদ ও সম্মানজনক করে তোলা। কারণ শিক্ষকই হচ্ছেন সেই আলোকবর্তিকা, যিনি অন্ধকারে পথহারা মানুষকে দিশা দেন, সমাজকে এগিয়ে নেন এবং জাতিকে আলোকিত করেন। অন্ধকারাচ্ছন্ন এক জাতিকে পথের দিশা দিতে পারেন কেবল শিক্ষকটাই। তাই আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসের অঙ্গিকার হোক প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য সমান ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত পূর্বক শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ানো। তাঁদের জন্য ন্যায্য বেতন, সুযোগ-সুবিধা ও পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পাশাপাশি শিক্ষাকে রাজনীতি ও অপসংস্কৃতির বাইরে রেখে নিরপেক্ষ পরিবেশ সৃষ্টি করা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
কেকে/ এমএস