গুজব হলো কোনো ঘটনাপ্রবাহের সংযোগ, যা জনমুখে রটিত যথার্থতা যাচাইবিহীন কিছু আলোচনা বা বিবরণ। সচরাচর গুজবের যথার্থতা সম্পর্কে সুনিশ্চিয়তা মেলে না, এ ছাড়া এটি প্রায়শই অতিকথিত বা অপতথ্যের বিস্তার করে। সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, গুজব এমন একটি বিবরণ যা তৎক্ষণাৎ বা কখনো নিঃসংশয়ে বলা যায় না যে এটি যথার্থ নাকি অলীক।
গুজব বিভিন্ন রূপে আসতে পারে, যেমন : কতিপয় ঘটনাপ্রবাহ শোনা গেছে বা প্রত্যক্ষ করেছে, কিন্তু তার আসল রূপ অস্পষ্ট, ওইরকম একটি আখ্যান। ঘটনাচক্রের কিয়ৎ বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত বা অপতথ্য সংযোগ করে প্রচার করা। একটি সমগ্র কৃত্রিম গল্প যা আসলের ছিটেফোঁটাও নয়। গুজব সচরাচর জনমনে ভয়, সন্দেহ বা স্পৃহা তৈরি করে এবং এটি সামাজিক অস্থিরতা সৃজন করতে সক্ষম। গুজব হরেক রকম হতে পারে।
গত ঘটনা নিয়ে প্রচারিত গুজবকে ভূতাপেক্ষ গুজব বলা হয়। ভবিষ্যৎ ঘটনা নিয়ে প্রচারিত গুজবকে ভবিষ্যাপেক্ষ গুজব বলা হয়। গুজব অনেক ক্ষেত্রে ‘ভুল তথ্য’ এবং ‘অসঙ্গত তথ্য’ এ দুই বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘ভুল তথ্য’ বলতে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যকে বুঝায় এবং ‘অসঙ্গতি তথ্য’ বলতে বুঝায় ইচছাকৃতভাবে ভ্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা।
এবার আসছি আলোড়ন সৃষ্টিকারী সেকেলে কিছু গুজব নিয়ে :
ধর্ম নিয়ে একটি গুজবের ঘটনা মধ্যযুগের। তখন গুজব ছড়িয়েছিল রোগমুক্তির আশায় ইহুদিরা খ্রিষ্টান শিশুদের রক্তে গোসল করে, যার ফলে বহু দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। ১৩২১ সালে ফ্রান্সে গুজব রটে যে, শরীরের মাংস পচে যাওয়া বা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ইহুদি রোগীরা ইচ্ছাকৃতভাবে কুয়ার পানিতে এ রোগের জীবাণু মিশিয়ে দিচ্ছে।
আরো বলা হয়, মুসলিমদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং ইহুদিদের অর্থায়নে কুষ্ঠরোগীরা পানিতে এ রোগের জীবাণুর বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে। এ কাজে স্বয়ং শয়তান জড়িত বলেও অপপ্রচার চালানো হয়। এ গুজব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা শুরু হয়। জনতার রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বহিরাগত, বিদেশি, ভিক্ষুকও তীর্থযাত্রীদের ওপর।
১৯১৮-২০ সালে আড়াই কোটি থেকে ৫ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া ইনফ্লুয়েঞ্জার জীবাণু জার্মান সেনাবাহিনী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য আবিষ্কার করে, অনেকেই বিশ্বাস করতেন এ তত্ত্ব। সে সময় বিশ্বজুড়েই নেমেছিল অন্ধকার। এখনকার মতো যোগাযোগব্যবস্থা ও আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না সে সময়। তাই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও হয় অধিক।
এ পর্যায়ে আসছি সাম্প্রতিককালের কতক গুজব নিয়ে, যা সর্বজনীন স্মৃতিতে রয়েছে :
২০১৫ সালে ভ্যাংকুভারে ট্রেড কনফারেন্সে বিল গেটস বলেছিলেন, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে যদি কোনো কারণে ১ কোটি মানুষ মারা যায়, সেটি কোনো সংক্রামক ভাইরাসের কারণেই হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যেহেতু পাঁচ বছরের মাথায়ই সেটা ঘটেছে তাই একদল দাবি করছে যে, বিল গেটসই করোনাভাইরাস তৈরি করেছেন পরবর্তী সময় এর ভ্যাকসিন বিক্রি করে টাকা কামানোর জন্য। যেখানে বিল গেটস তার ফাইন্ডেশনের মাধ্যমে সব অর্থ দান করে দিয়েছেন মানুষের কল্যাণে।
মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে ইহুদিরা খ্রিষ্টান শিশুদের বলি দেয়। কালো প্লেগের যুগে এ ধরনের গুজব বিশাল ক্ষতি ডেকে এনেছিল। জিপসি, কুষ্ঠ ও সোরিয়াসিসের রোগীদের মেরে ফেলা হয়েছিল অকাতরে। সে সময় অসংখ্য মানুষকে নানা কায়দায়, বিশেষ করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
কয়েক বছর পূর্বে বাড্ডা থানায় দায়ের করা এক মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, রেনু নামক এক ভদ্রমহিলা তার মেয়েকে ভর্তি করার জন্য স্কুলে যান। কিন্তু মানসিক অসুস্থতার কারণে তার আচরণ অস্বাভাবিক ছিল। এজন্য স্কুলের অনেকেই তাকে ছেলেধরা হিসেবে সন্দেহ করছিল। মামলায় বলা হয়েছে, অতর্কিতভাবে ওই নারীকে স্কুলের অভিভাবক, উৎসুক জনতাসহ অনেকে গণপিটুনি দেয়। এতে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আনুমানিক ৪০০ থেকে ৫০০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তি জড়িত।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মাথা লাগবে একটি মহল এমন গুজব ছড়ানোর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান, যা ২১ জুলাই ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিধ্বস্ত হয়ে বহু শিক্ষার্থী হতাহত হওয়ায় দেশব্যাপী গভীর শোক বিরাজ করছিল। এ অপ্রত্যাশিত ঘটনায় নিষ্পাপ শিক্ষার্থীদের জীবনাবসান ঘটল, অনেকে আহত হয়েছে। এমন একটি বিপর্যয়কে কেন্দ্রীভূত করেও হতাহতের সংখ্যা নিয়ে দুচক্র গুজব রটনা করে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সুযোগ নিতে উদ্যত হন।
২০২০ খ্রিষ্টাব্দে করোনাভাইরাস বিস্তার নিমিত্ত মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিযোগ করেছিল চীন অভিমুখে। তার দাবি ছিল করোনাভাইরাস নৈসর্গিক কিছু নয়। চিন জৈব অস্ত্র অনুরূপ গবেষণাগারে এ ভাইরাসটি উদ্ভাবন করেছিল। এ ঘটনাচক্রে বিস্তর গুজবের শাখা প্রশাখা বিস্তৃত হয়েছিল।
২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে ঢাকায় মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের তৎকালীন সদ্যপ্রসূত ইসলামী অরাজনৈতিক জোট হেফাজতে ইসলামের গণসমাবেশ ও আন্দোলন-এ গভীর রাতে পুলিশ অপারেশন সিকিউর শাপলা নামে অভিযান চালনা করে। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে কয়েক হাজার লোককে হত্যা করে।
অন্যদিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছিলেন গুলি করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি আরো যোগ করেন, কয়েকজন প্রতিবাদী দেহে রঙে আবৃত করে গড়িয়েছিল, পুলিশ তাদের সম্মুখীন হলে ছুটে পালায়। সেই ঘটনাপ্রবাহে অদ্যাবধি বিভিন্ন ইসলামিক সম্মেলনে, গত সপ্তাহেও জুমার নামাজের খুতবার বয়ানে খতিব সাহেবকে শুনতে পেয়েছি এ হত্যাযজ্ঞের বিচার প্রার্থনা করতে। অপারেশন শাপলার ঘটনায় এখনো প্রকৃত চিত্র পরিষ্কার হয়নি। অদ্যাবধি কোন পক্ষ থেকে প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা ও তাদের পরিচিতি প্রকাশ করতে পারেনি। পক্ষান্তরে ঢের গুজব সৃজন অব্যাহত রয়েছে।
এ ধাপে আমার ব্যক্তিগত দুটি অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি :
সাম্প্রতিক এক উচ্চ সমাজভুক্ত ব্যক্তি আমার নিকট জানতে আগ্রহী হন, কোভিড-১৯ ব্যাকটেরিয়া বা অনুজীব কিনা? তেমন একজন বিদ্বান মহাশয়ের কথা শোনা মাত্রই আমি বিস্মিত হই। জনাবের বহু ঘটনা প্রসঙ্গে কথায় ইতঃপূর্বে আমি পুলকিত হয়েছিলাম। তথাপি এ প্রশ্নটিই শুনে অলিন্দ্য দিয়ে অবলোকন করলাম, একই দিকে সূর্যোদয় হয়েছে কিনা? বিষয়টি আদ্যোপান্ত জেনে যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো। প্রাজ্ঞ যিনি তার পোস্টে কোভিড-১৯ কে ব্যাকটেরিয়া বলেই থেমে যাননি, বরং তিনি আরো বিস্তৃতভাবে এ ব্যাকটেরিয়া রোগী কী চিকিৎসা নেবেন, তাও বলে দিয়েছেন। তিনি রেফারেন্স হিসেবে সিঙ্গাপুর সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে উল্লেখ করেছেন। যদ্যপি সিঙ্গাপুর সরকার তৎসময়ে সুস্পষ্টভাবে বিবৃতি দিয়েছিল, অনুরূপ কোন গবেষণা তারা করে নাই এবং উপাত্তটি সর্বৈব অসত্য।
কয়েকদিন পূর্বে মধ্য-কৈশোরের প্রারম্ভে থাকা এক বালক আমাকে প্রশ্ন করে যে মানুষ কেন গুজব করেন। আমি ওই বালককে পাল্টা সমতুল্য প্রশ্ন করি? আত্মজ প্রত্যুত্তর দিলেন গু মানে পায়খানা, আর জব মানে চাকরি অর্থাৎ ময়লার চাকরি। কথাটি শুনে আমি ভাবলাম এ খুদে পণ্ডিত উপলব্ধি করতে পারল গুজব বা রটনা কতটা হীন কার্যকলাপ। তথাপি দুনিয়ার পূর্ণবয়স্ক মানবজাতির কী কারণে বোধগম্য হচ্ছে না?
গুজবের সঙ্গে ধর্মীয় সম্পৃক্ততা থাকলে তা অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যুগে যুগে এ ধরনের গুজব দেখা যায়। এমনকি এসব গুজবের ওপর ভিত্তি করে অনেকদাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। রাবি আবু হুরায়রাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : কোনো লোকের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (সত্যতা যাচাই না করে) তা-ই বলে বেড়ায়। সহিহ : মুসলিম ৫, ইবনু আবী শায়বাহ্ ২৫৬১৭।
সেকেলে গুজব এবং একেলে গুজবের মধ্যে পার্থক্য হলো, তখন গুজব ছড়িয়ে পরতে অনেক সময়ের প্রয়োজন ছিল। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিপ্লবের ফলে গুজব দাবানলের মত তৎক্ষণাৎ ছড়িয়ে পড়ে। খারাপ সংবাদ বাতাসের আগে ধায়। সাম্প্রতিক সময়ে গুজবের বিষয়টি আমাদের খুব বেশি করে ভাবাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আরো আধুনিক ও যৌক্তিক হওয়ার কথা থাকলেও তার প্রতিফলন কথায় ও কাজে দেখা যাচ্ছে না। কোনো একটি সংবাদ বা তথ্যের যাচাই-বাছাই ছাড়াই মানুষ সেটাকে বিশ্বাস করে ফেলছে। পরবর্তী সময়ে এ সংবাদ বা তথ্যটি মানুষ থেকে মানুষে স্থানান্তরিত হয়ে ব্যাপকতা লাভ করছে।
গুজবের পূর্ণতাপ্রাপ্তি হিসেবে গণপিটুনি এবং মব ভায়োলেন্স হয়ে থাকে। সন্দেহে গণপিটুনি এবং মব ভায়োলেন্স একটি ফৌজদারি অপরাধ। আমার বিশ্বাস গুজব প্রতিরোধে প্রকৃষ্ট সুকৌশল হলো তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা, যেমন ছবি বা খবরের উৎস মূল্যায়ন করা এবং নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তথ্য আহরণ করা। গুজব কখনো জব বা কাজ হতে পারে না, বরং গুজব এক আজব-গজব-ভয়ংকর জব! আসুন সবাই গুজব এড়িয়ে চলি এবং অন্যদেরও গুজব হতে বিরত রাখতে প্রচেষ্টা গ্রহণ করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক
কেকে/ এমএস