ইতিহাস থেকে যতদূর জানতে পারলাম জুলুম-নির্যাতন বা শক্তি প্রয়োগে কোনো মতাদর্শ দুর্বল বা শেষ করা যায়নি বরং শক্তি প্রয়োগে দিন দিন তা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর জলজ্যান্ত উদাহরণ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যাদের ওপর বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সবচেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ করেছিল। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেওয়ার পর মনে হচ্ছিল তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। বিগত ১৫ বছর প্রকাশ্যে তাদের সব প্রকার রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল।
কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেখা গেল তারা অন্যতম শক্তিশালী দল। ঠিক বিপরীতভাবে যদি আমরা চিন্তা করি যে দলগুলো সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। জাতীয় পার্টি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় পার্টি যতই সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেছে ততই তারা অস্তিত্ব সংকট বা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে। এনসিপিকে আরেকটা উদাহরণ হিসেবে ধরতে পারি।
যে ছাত্রদের এবং ছাত্রনেতাদের মানুষ পরম স্নেহ ও ভালোবাসায় আপন করে নিয়েছিল, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাদের অস্তিত্ব আজ কেন সংকটাপন্ন? যদি তারা ক্ষমতার অংশ না হয়ে, পড়ার টেবিলে ফিরে যেত। যদি তাদের কারও বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ না উঠত। তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। যে কোনো সময় যে কোনো অনিয়মের বিপক্ষে তারা ভয়েস রেইজ করতে পারত। তারাই হতে পারতো গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রেশার গ্রুপ বা ভ্যানগার্ড। যে দলের নেতৃত্বে জুলাই গণঅভ্যুত্থান হলো। এক বছরের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তাদের জনপ্রিয়তার ধস নামলো। অর্থাৎ সরকারে অংশগ্রহণ বা সরকারি সুযোগ সুবিধা গ্রহণ তাদের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস করেছে। আমার ধারণা রাজনৈতিক মতাদর্শ দুর্বল করতে হলে জুলুম নির্যাতনের চেয়ে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া জরুরি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে দেড় লাখের ওপর মামলা করে ৫০ লাখের ওপর নেতাকর্মীদের আসামি করে বাড়িঘর ছাড়া করে দৌড়ের ওপর রাখে। পরে তারা ঘোষণা দেয় অন্য দলের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগে যুক্ত হতে পারবে না। অর্থাৎ আওয়ামী লীগে হাইব্রিড নিষিদ্ধ। এতে লাখ লাখ বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী তাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে, আন্দোলনে সরকার পতন বাধ্যতামূলক মনে করেছে। যার দরুন সরকার বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে নেতাকর্মীরা নিজেদের অংশগ্রহণ অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন হিসেবে দেখেছে। এত মামলা হামলায় তারা বিচ্ছিন্ন না হয়ে বরং আরো সুসংঘটিত হয়েছে। জুলুম নির্যাতন বা মামলা হামলা করে কোনো রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শকে দমিয়ে রাখা যায় না। বরং এ ধরনের নির্যাতন রাজনৈতিক দলকে আরো সুসংহত করে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো একই পদ্ধতিতে এগোচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গণহারে মামলা করে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে চাচ্ছে তারা। অথচ ৬৩ শিশুসহ প্রায় ২ হাজার মানুষ শহীদ হয়েছে, অঙ্গহানি ও আহত হয়েছে প্রায় হাজার হজার মানুষ। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কারা এ নারকীয় কর্মকাণ্ডে জড়িত তার ভূরি ভূরি মোবাইল ফুটেজ, সিসি ফুটেজ, ওয়্যারলেস বার্তা, প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী x কল রেকর্ড রাষ্ট্রের কাছে আছে।
সুনির্দিষ্টভাবে যারা জড়িত তাদের আইনের মুখোমুখি করে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে পারলে এটা দেশের ইতিহাসে দৃষ্টান্তমূলক হয়ে থাকত। তা না করে বর্তমান সরকার লাখ লাখ আওয়ামী কর্মী বা সমর্থকদের জড়িয়ে গণমামলা করছে। এতে আওয়ামী লীগ আরো শক্তিশালী হচ্ছে। গণমামলার অনেক ঘটনা বিগত সরকারের গায়েবি মামলার মতো চিহ্নিত হয়েছে। বিদেশে অবস্থান, জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখানোর মতো ঘটনা ইতোমধ্যে গণমাধ্যমের খবরে পরিলক্ষিত হয়েছে। যা মামলার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। অপরদিকে যাচাই-বাছাই ছাড়া লাখ লাখ কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করলে, মামলার আসামি বাদেও (আসামি পরিবারের অন্তত ৪ জন) সরকারবিরোধী চরম অবস্থানে পৌঁছে। এতে সরকার বিরোধিতার সংখ্যাটা কোটিতে পৌঁছে যাচ্ছে।
রাশিয়ায় জার আমলে বিপ্লববিরোধী প্রধান অস্ত্র ছিল গোপন পুলিশ। ওখরানা নামে পরিচিত সেই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল কঠোর হাতে বিপ্লবের যে কোনো চেষ্টা বানচাল করা। সেই ওখরানাকে পরাস্ত করে লেনিন যখন নতুন সোভিয়েত রাষ্ট্রের পত্তন ঘটালেন, তার প্রথম কাজই ছিল নতুন এক ওখরানা প্রতিষ্ঠা। চেকা নামে পরিচিত সেই গোপন পুলিশ যে কাজ করত, ওখরানা ঠিক একই কাজ করা শুরু করল। অর্থাৎ ভিন্ন বোতল, একই তেল। ইরানেও একই পরিস্থিতি দেখা যায়। আধুনিক ইরানে শাহের আমলে সব রাজনৈতিক প্রতিরোধ ঠেকাতে ব্যস্ত ছিল তার গোপন পুলিশ সাভাক। এটি ছিল তার ব্যক্তিগত লাঠিয়াল বাহিনী, বিদ্রোহের সামান্য আঁচ পেলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ত।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব ছিল সেই সাভাকের বিরুদ্ধে এক প্রবল বিজয়। কিন্তু আয়াতুল্লাহ খোমেনি ক্ষমতায় আসার পরপরই সাভাক বদলে এর আদলে সাভামা গঠন করলেন। সাভামা হয়ে উঠল সে দেশের নতুন শাসকগোষ্ঠীর নিজস্ব পেটোয়া বাহিনী। এ কারণে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হলো, বিপ্লব প্রশ্নবিদ্ধ হলো। পৃথিবীর বিভিন্ন বিপ্লবের ইতিহাস থেকে দেখা যায় পতিত মতাদর্শকে দুর্বল বা দমন করতে গিয়ে বিপ্লবটাই ব্যর্থ হয়ে যায়। বিপ্লব পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। বিপ্লব পরবর্তী মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড আশাবাদ তৈরি হয়।
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও এমনটা দেখা গেছে। গত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রিকশা আন্দোলন, বুয়া আন্দোলন, ফকির আন্দোলন, গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন, আনসার আন্দোলনসহ নানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস বলে, এসব প্রত্যাশা কখনো বাস্তবসম্মত হয় না। পরিবর্তন আসতে সময় লাগে। বিপ্লবের পর সামাজিক উত্তেজনা বা অস্থিরতা বাড়াটাই স্বাভাবিক। বিপ্লবের জন্য একটি বড় হুমকি হলোÑ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পুনরুত্থান। যা পুরোনো ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার জন্য ঘটে। অনেকক্ষেত্রে সামরিক অভ্যুত্থানে গিয়ে তা শেষ হয়। ১৮৪৮-এর ফরাসি বিপ্লবের শর্ত, বিকাশ, বিজয় এবং বিজয়পরবর্তী পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, ইউরোপের এ বিপ্লবের ব্যর্থতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল আন্দোলনকারীদের মধ্যকার দুর্বলতা। আন্দোলনকারীরা পুরোনো ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণের আকাক্সক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে একটি নতুন ব্যবস্থা গড়া যায়, সে সম্পর্কে তাদের মধ্যে ঐকমত্য ছিল না। পুরোনো ব্যবস্থার পতনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে গভীর বিভাজন স্পষ্ট হতে থাকে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি মূলত একটি উদারনৈতিক ব্যবস্থা চেয়েছিল, কিন্তু পুরোনোটিকে সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপন করার জন্য একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তারা চায়নি। তারা শুধু এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা চেয়েছিল, যেখানে তাদের অংশগ্রহণ থাকবে এবং অভিজাতদের বিশেষ সুবিধা দেবে না। অন্যদিকে তারা সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের পক্ষে শ্রমিকদের দাবির প্রতি সদয় ছিল না; বরং দুই প্রস্তাবই তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল।
১৯১৭ সনের রুশ বিপ্লবে রাশিয়ার জার শাসনের অবসান ঘটে। সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা। সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার ইতিহাসে একটি বড় বাঁক নেয়। খাদ্য ঘাটতি, সামরিক ব্যর্থতা ও স্বৈরশাসনের কারণে জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ বিক্ষোভ নতুন বিপ্লবে রূপ নেয়। জার নিকোলাস সিংহাসন ত্যাগ করেন। তৈরি হয় শূন্যতা। নতুন সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। যার ফলে দেশব্যাপী বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। একইভাবে বাংলাদেশেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে হটানোর পর নানা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে। পুলিশ কাজ করা থেকে বিরত থাকে। যেমনটা রাশিয়াতে হয়েছিল।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল। বাংলাদেশে আইন প্রয়োগের অভাবে নিরাপত্তাহীনতা এবং ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে। যা জনগণের দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিংশ শতাব্দীর বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও গণতন্ত্রের বিপ্লব সব অঞ্চলে (গণতন্ত্র) শিকড় গাড়তে পারেনি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মতো অঞ্চলে পরিবর্তন ও কল্যাণ রাষ্ট্রের বাণী শুনিয়ে সামরিক বা ভিন্ন কৌশলে ক্ষমতা দখলকারী শাসকরা পরিণত হয়েছেন নতুন শোষকে। তাদের দমন-পীড়নের ফলস্বরূপ একবিংশ শতাব্দীতে আমরা বিশ্বজুড়ে দেখেছি রোজ বিপ্লব, অরেঞ্জ বিপ্লব, টিউলিপ বিপ্লব এবং বিশেষভাবে ২০১১ সালের ‘আরব বসন্তের’ মতো সরকার পরিবর্তনকারী গণআন্দোলন। এসব আন্দোলন স্বৈরাচার ও স্বৈরাচারী শাসন কাঠামোর বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল। এসব আন্দোলন স্বৈরাচারী শাসকদের পতন ঘটাতে প্রাথমিকভাবে সফল হলেও, গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা আনায় তাদের সাফল্য ছিল অত্যন্ত সীমিত, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হয়েছিল। ঠিক এমনি ঐতিহাসিক বিশ্ব প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমরা দেখি বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব। আশঙ্কা হচ্ছে, বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবও কি তবে ‘আরব বসন্তের’ মতোই ব্যর্থতার পথে হাঁটছে? আরব বসন্তের ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ছিল মূলত নেতৃত্বের অভাব, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যের অভাব, শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রভাব, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক সংকট এবং চরমপন্থি গোষ্ঠীর উত্থান। বিভিন্ন গোষ্ঠী একত্রিত হয়ে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করলেও ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠন বা শাসনভার পরিচালনার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি তারা। যেমনিভাবে আরব বসন্তের আন্দোলনগুলো বেশিরভাগই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং এর পেছনে কোনো একক বা শক্তিশালী সমন্বিত নেতৃত্ব ছিল না। ঠিক তেমনিভাবে জুলাই বিপ্লবের পেছনে একক কেউ ছিল না। বিভিন্ন গোষ্ঠী (ধর্মনিরপেক্ষ, ইসলামপন্থি, তরুণ আন্দোলনকারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইত্যাদি) একত্রিত হয়ে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করেছি। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের পর এর ক্রেডিট নেওয়াকে কেন্দ্র করে আমরাও নেতৃত্বের শূন্যতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনগণের আকাক্সক্ষাকে ভুলে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে, যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনসহ মৌলিক সেক্টরগুলোর সংস্কার না হয়, তবে জুলাই গণঅভ্যুতের ব্যর্থতা হয়তো অনিবার্য। প্রতিটি দেশের আলাদা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা, সে কারণে তাদের বিপ্লবের চরিত্রও স্বতন্ত্র।
তবে মোটাদাগে কয়েকটি অনুষঙ্গের কথা বলা যায়। ক্ষমতাসীন মহলের বিরুদ্ধে লড়াই দেশের অধিকাংশ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। কিন্তু ক্ষমতার হাতবদল হওয়ামাত্রই রাজনৈতিক ভিন্নতা ও স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিপ্লবী আন্দোলনকে বিভক্ত করে ফেলে। বিপ্লব মানেই রক্তপাত, ধ্বংস। কখনো কখনো এ রক্তপাতের ফলে আক্রান্ত নাগরিক গোষ্ঠীর নেতৃত্বে দেখা দেয় প্রতিবিপ্লব। ফরাসি বিপ্লবের কথাতো আমরা ওপরে আলোচনা করেছি। বল্গাহীন রক্তপাতের বিপ্লবে আশানুরূপ ফল না আনতে পারায় সে বিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। বিশ শতকের অধিকাংশ বিপ্লবেও আমরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিভক্তির ফলে অন্তর্গত বিবাদ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে গৃহযুদ্ধ হতে দেখেছি। ‘আরব বসন্ত’ নাগরিক সুফল আনার বদলে সিরিয়া, ইয়েমেন বা লিবিয়ায় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের জন্ম দেয়। বিদেশি হস্তক্ষেপ সে গৃহযুদ্ধকে শুধু দীর্ঘস্থায়ী হতেই সাহায্য করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতাহীনতার প্রতিবাদে আধা ডজনের মতো দেশে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। চিলি, কলম্বিয়া, পেরু, বলিভিয়া, নিকারাগুয়া, এমনকি মেক্সিকোতে যারা ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণভার নিয়েছেন, তারা বিপ্লবী শুধু এ কারণে নয় যে মতাদর্শগতভাবে তারা বামপন্থি। বরং যে রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাতেই রয়েছে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের স্পষ্ট বার্তা। সমস্যা হলো, অনেক ক্ষেত্রে এই বিজয়ী বিপ্লবীরা নিজেরাই নতুন ক্ষমতাধর শ্রেণি হয়ে ওঠেন। মানুষের ভাগ্য নয়, নিজেদের কায়েমি স্বার্থবাদ রক্ষাই তাদের মুখ্য কাজ হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখে তাদের অনেককে মত ও পথ বদলাতে হয়। রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব তাদের দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলে। ব্যর্থ হয় বিপ্লব। নতুন শতাব্দীতে লাতিন আমেরিকার যে দেশগুলো আমাদের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুখবর দিয়েছিল, তারা প্রায় সবাই পিছু হটছে। প্রধান চ্যালেঞ্জ বেহাল অর্থনীতি। মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, জীবনযাত্রার অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধির কারণে এসব দেশে নতুন বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছিল, সেসবের অধিকাংশই অপূর্ণ রয়ে যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার কথা সবার মনে থাকার কথা দীর্ঘদিন থেকে দেশটি রাজাপক্ষে পরিবারের হাতে জিম্মি, তাদের অদক্ষতা ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা শ্রীলঙ্কাকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের প্রান্তসীমায় নিয়ে এসেছিল। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ শুধু অর্থনৈতিক দুর্ভোগের বিরুদ্ধে নয়, রাজাপক্ষে পরিবারের সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধেও। তিন বছর আগে দেশব্যাপী বিক্ষোভের মুখে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। বেশ কিছু দিন পর তিনি পুনরায় ফিরে এলে পেশাদার রাজনীতিকেরা তাকে রীতিমতো ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে স্বাগত জানান। শ্রীলঙ্কায় বিপ্লবের ফুল না ফোটার আগেই শুকিয়ে গেল। রাজাপক্ষেকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হলো না, কারণ শ্রীলংকার রাজনীতিতে এ পরিবারের প্রভাব এখনো অসীম। পেশাদার রাজনীতিকদের অনেকেই তাদের প্রতি অনুগত। আরেকটি বড় কারণ ছিল, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিভক্তি ও উদ্দেশ্যহীনতা। বিপ্লবের নামে ক্ষমতার হাতবদল হয় সত্যি, কিন্তু মানুষের ভাগ্য বদলায় না। ক্ষমতার দণ্ড ছিনিয়ে নিয়েছেন হয় সামরিক কর্তা অথবা অন্য কোনো একনায়ক। আমাদের দেশেও রাজনৈতিক বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জুলাই সনদ, পিআর, সংস্কার নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের আবার জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের। বাম রাজনীতির সঙ্গে ডান রাজনীতির বিভাজন আস্তে আস্তে প্রকট হচ্ছে। বিপ্লব সফল হয়, কারণ বিপ্লবের সময় সবার শত্রু থাকে একটা। বিপ্লব ব্যর্থ হয়, কারণ বিপ্লব শেষে বিজয় বা শ্রেষ্ঠত্বের ভাগাভাগিতে নানা ফ্যাসিজমের পূর্ণজন্ম হয়। আমার দল, আমার নেতা, আমার ধর্ম বা আমার মতো বিপ্লবটা সংগঠিত করেছে এ ধারণা নতুন ফ্যাসিজম তৈরি করে।
দেশে অর্থনৈতিক সংকট বিদ্যমান, দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার, অদক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানির ওপর। মুদ্রাস্ফীতি, বিশেষত খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এর সঙ্গে রয়েছে জ্বালানি সংকট, যা শিল্প, পরিবহন ও কৃষি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে হ্রাস করছে। এ ছাড়া সাবেক সরকারের অনুগত পুলিশ, প্রশাসন, গোয়েন্দা ও সামরিক চক্রগুলো আজও সক্রিয়। এদের অনেকেই চুপচাপ থেকে নতুন সরকার ও ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করার জন্য সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিদেশি বিভিন্ন চক্র সক্রিয় রয়েছে। তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে আবারও অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেদের অনুগত শক্তিকে ক্ষমতায় বসানো।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনৈতিক দলগুলোর বড় সমস্যা হলো বাইরের শক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব। কে কখন কার পারপাস সার্ভ করতে নেমে পড়ে তা বলা শক্ত। আমাদের রাজনীতিতে কমবেশি ৪টি জুজুর ভয় কাজ করে। ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা ও চীন। এসব জুজুর ভয় দেখিয়ে এখানে রাজনীতি জোরদার হয়। এক দল আরেক দলকে অমুক দেশের দালাল বলে তিরস্কার করে। তবে এটাও সত্য, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসব দেশের গোয়েন্দা সংস্থার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। আওয়ামী লীগকে প্রো-ইন্ডিয়ান, জামায়াত ইসলামিকে প্রো-পাকিস্তান আর বিএনপিকে প্রো-সুবিধাবাদী বলে চিহ্নিত করারা চেষ্টা করে অনেকে। তবে আওয়ামী লীগ, জামায়াত বা বিএনপির দাবি তারা নিতান্তই বাংলাদেশপন্থি। দিল্লি, পিন্ডি বা অন্য কোনো দেশের রাজনৈতিক শাগরেদ তারা নয়। তবে ইদানীং শিক্ষার্থীদের অনেকে বিএনপিকে ভারতপন্থি বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। যা ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে একটা রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পূর্বাভাস।
রক্ত দিয়ে লেখা যেই বিপ্লব এসেছে সেই বিপ্লব যদি কেবল ক্ষমতার পটপরিবর্তনের দলিল হয়ে থাকে, জনগণের মুক্তির সনদ না হয়, তবে তা হবে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। জুলাইয়ের সেই মহান অর্জন যদি শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়ে, যদি তা আরব বসন্তের মতোই ব্যর্থ বিপ্লবের উদাহরণ হয়ে থাকে, তবে তা হবে জাতির জন্য এক চরম দুর্ভাগ্য। বিপ্লবের সাফল্য ধরে রাখার জন্য মানুষকে সংগঠিত হতে হয়। নিজেদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
সাধারণত, বিপ্লবের পর সামাজিক উত্তেজনা বাড়তে থাকে। যার ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ এবং সংঘাতের সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, আগুন দিয়ে কখনো আগুন নিভানো যায় না। আগুন নিভানোর জন্য পানি লাগে। ঠিক তেমনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দিয়ে অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শকে দমানো যায় না। রাজনৈতিক মতাদর্শকে পরাজিত করতে হলে তারচেয়ে উত্তম রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য
কেকে/ এমএ