জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে যে ‘মব সন্ত্রাস’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তা শুধু আইনশৃঙ্খলার অবনতিই নয়, এটি দেশের সামগ্রিক অস্থিতিশীলতারও বহিঃপ্রকাশ। গত ৫ আগস্টের পর মব সন্ত্রাস বাংলাদেশে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বিচারহীনতার দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি থেকে পুষ্টি লাভ করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি জনগণের চূড়ান্ত অনাস্থার প্রকাশ ঘটাচ্ছে এই মব।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, সরকার এসব ঘটনায় দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় জনতা মব সন্ত্রাসে উৎসাহিত হচ্ছে। এতে স্বেচ্ছাচারী ‘বিচার’ সাধারণ ও নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সংগঠনগুলোর মতে, মব সন্ত্রাসের ঘটনায় পুলিশের ব্যবস্থা নিতে দেরি করা বা হস্তক্ষেপে নীরব মানসিকতার কারণে এসব ঘটনার প্রতি পুলিশের সহানুভূতির বার্তাই দিচ্ছে। কিন্তু নীরব ভূমিকায় থাকা পুলিশও কি রেহাই পাচ্ছে এই মব সন্ত্রাস থেকে?
সম্প্রতি মবের শিকার হচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পর্যন্ত শিকার হচ্ছেন মবের। গত কয়েকদিনে দেশের কয়েকটি স্থানে হামলার শিকার হয়েছেন পুলিশ। গত মঙ্গলবার ৭ অক্টোবর চট্টগ্রামে মব সৃষ্টি করে এক পুলিশ সদস্যকে আহত করে জব্দকৃত অটোরিকশা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফেনীর সোনাগাজীতে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিকে ধরতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন ছয় পুলিশ সদস্য।
এদিকে কুমিল্লায় চাঁদাবাজ বিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে পিটুনির শিকার হয়েছেন ৩ পুলিশ সদস্য। এর আগে গত শনিবার নরসিংদীতে হামলার শিকার হয়েছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিক হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে উপজেলার আনমনু এলাকায় সোহেল নামে মোবাইল চুরির মামলার এক আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে সোহেলের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আরো দু’জনকে গ্রেফতার করতে শহরের শিবপাশা নোয়াপাড়া এলাকায় যায় পুলিশ। তখন চোরচক্র ও তাদের স্বজনদের হামলায় নবীগঞ্জ থানার দুই এসআই ও একজন এএসআইসহ পুলিশের ৬ জন আহত হন।
যারা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত তারা যদি সন্ত্রাসের শিকার হন, তাহলে জনগণের কাছে কি বার্তা যায়। এই মব সন্ত্রাসরোধে শুরু থেকেই যদি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হতো তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এহেন ঘটনার মুখোমুখি হতে হতো না। মব সন্ত্রাসের এ করাল গ্রাস থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হলে শুধু দমন-পীড়নমূলক ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত, বহুস্তরীয় এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, যার মূলে থাকবে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও সামাজিক জাগরণ। গণপিটুনির প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করে দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারায় (বিশেষ করে, ধারা ৩০২/১৪৯) বিচার করতে হবে। পুলিশ মবের শিকার হয়েছে বলে কেবল ওইসব মবসৃষ্টিকারীরাই যেন শাস্তি না পায়।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে মবের নির্যাতনের শিকার প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে হবে। একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে মামলাজট কমে এবং মানুষ দ্রুত ন্যায়বিচার পায়। দেশের সব রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসমাজকে দ্ব্যর্থহীনভাবে মব সন্ত্রাসকে নিন্দা জানাতে হবে। সংবাদমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দিরসহ সব সামাজিক প্ল্যাটফর্ম থেকে গণপিটুনির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
মানুষকে বোঝাতে হবে, ‘মব জাস্টিস’ কোনো বিচার নয়, এটি একটি সামাজিক অপরাধ এবং এর ফলে একজন নিরীহ মানুষও প্রাণ হারাতে পারে। এ পরিস্থিতি শুধু আইনশৃঙ্খলার অবনতি নয়, এটি রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলের প্রতি এক চ্যালেঞ্জ। যেখানে পুলিশ বাহিনীই নিরাপদ নয় সেখানে সাধারণ মানুষ নিজেদের কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে এটি ভাবা দরকার।
এ সংকট মোকাবিলায় শুধু আইন প্রয়োগই যথেষ্ট নয়; জুলাই অভ্যুত্থানের আত্মাকে রক্ষা করতে এবং বাংলাদেশের জন্য একটি সভ্য ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। মব সন্ত্রাস বন্ধে সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষেরও দায়িত্ব আছে। পুলিশ সদস্যদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে নয়তো তাদের নীরবতা তাদের কাঁধেই চেপে বসবে।
কেকে/ এমএস