দীর্ঘ শতাব্দীর অগণিত লড়াই সংগ্রামের ফসল বাংলার স্বাধীনতা। প্রতিটি লড়াই সংগ্রাম ও আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্য নিরোধ করা। বাংলা জনপদের হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় প্রতিটি লড়াই ছিল অধিকার আদায়ের। এক রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলা জনপদ স্বাধীন হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটিতে আজো বৈষম্য নিরোধ হয়নি।
উপরন্ত দেখা যায়- জাতপাতের বৈষম্যটা এখন প্রবল থেকে প্রবলতার হয়ে উঠছে। অথচ স্বাধীন দেশের ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানে নাগরিকদের অধিকারগুলোর মধ্যে ছিল, ১. আইনের চোখে সকল নাগরিক সমান। ২. ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো বৈষম্য করা যাবে না। ৩. নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়। ৩. সরকারি চাকরি বা নিয়োগের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ থাকবে। ৪. প্রত্যেকের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। ৫. আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। ৬. সংবিধানে গ্রেপ্তার ও আটকের ক্ষেত্রে কিছু রক্ষাকবচ প্রদান করা হয়। ৭. জবরদস্তিমূলক শ্রম থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা হয়। ৮. বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। ৯. নাগরিকদের সম্পত্তি ক্রয়, ধারণ, হস্তান্তর ও বিলি-ব্যবস্থা করার স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। ১০. ধর্ম পালন এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করার অধিকার। ১১. আইনানুযায়ী সর্বজনীন, গণমুখি, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার। ১১. নাগরিকদের সমিতি বা সংঘ গঠনের অধিকার ছিল, যা জনশৃঙ্খলা বা নৈতিকতাবিরোধী নয়।
১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাগরিকরা সমানাধিকার ভোগ করতে পারছে না। কারণ এর পর বার বার সংবিধানকে সংশোধন করে বৈষম্য ব্যবস্থাটাকে পুনবহাল করা হয়। আজও জাতপাত প্রথা অনুসারে সৃষ্টি হচ্ছে শ্রমবাজার। মেথর মুচি ধোপা, জেলে নাপিতসহ নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে বংশপরম্পরায় জাত পেশার কাজটিই করতে হচ্ছে। এই সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রের অনেক সুযোগ-সুবিধা ও নিয়ম থেকে বঞ্চিত করা হয়। এই বর্ণ বা জন্মগত পেশার মানুষ নিজ জাতের পেশায় কাজ করলেও নায্য মজুরি পায় না। যেমন বংশানুক্রমিকভাবে চা শ্রমিকরা হয়।
বাংলাদেশের চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা, যা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত। এই মজুরিতে বর্তমান মূল্যস্ফীতির বাজারে জীবনযাপন করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু তার কোনো প্রতিকার নেই। হাজার বছরের লড়াই সংগ্রামের ফলে অর্জিত স্বাধীন দেশে এখনো জাতপাত বিচারেরই কাজ ও মজুরি নির্ধারণ করা হয়। জাতপাত ব্যবস্থাটা কিভাবে এই জনপদে উৎপত্তি হলো তা জানা দরকার, কারণ আর্যরা আসার আগে এই জনপদে কোনো জাতপাত প্রথা ছিল না। সকল নাগরিকের ছিল সমান। জাত প্রথার উৎপত্তির বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত হলো বর্ণভিত্তিক তত্ত্ব এবং পেশাভিত্তিক তত্ত্ব।
বর্ণভিত্তিক তত্ত্ব অনুসারে, এটি আর্যদের আগমনের সঙ্গে শুরু হয়েছিল এবং সমাজকে চারটি প্রধান বর্ণে (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র) বিভক্ত করে, যার ভিত্তিতে পরবর্তীতে জাতে বিভক্ত হয়। পেশাভিত্তিক তত্ত্ব অনুসারে, নির্দিষ্ট পেশা ও কাজের ওপর ভিত্তি করে সমাজের বিভাজন তৈরি করা হয়। যা পরবর্তীতে বংশগত ও জন্মভিত্তিক হয়ে ওঠে। এই তত্ত্ব অনুসারে, বর্ণ (যার অর্থ ‘রঙ’) নামক একটি সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস থেকে জাত প্রথার উদ্ভব হয়েছে।
যেহেতু অনার্যদের গাত্র রং ছিল শ্যাম বর্ণের তাই তাদেরকে নিচু জাতের হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এটি সমাজের মানুষকে চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করে: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। প্রাচীন সমাজে বিভিন্ন পেশা ও কাজের ভিত্তিতে বিভাজন শুরু হয়। সময়ের সাথে সাথে, এই পেশাভিত্তিক বিভাজনগুলো বংশগত ও কঠোর হয়ে ওঠে এবং নির্দিষ্ট পেশার অধীনে থাকা গোষ্ঠীগুলো ‘জাতি’ নামে পরিচিতি দেয়া হয়। সৃষ্ট এই ব্যবস্থাকে ধর্মীয় প্রলেপে নিয়ে আসা হয়। কিছু কিছু ধর্মের ব্যাখ্যা অনুসারে, আল্লাহ, ঈশ্বর বা ব্রহ্মা এই প্রথা সৃষ্টি করেছেন। তা ধর্মগ্রন্থ গুলিতে ভিন্ন ভিন্নরূপে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ শতক থেকে বর্ণ বা জাত প্রথা শুরু হয়। আর্য-অনার্য গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংগ্রাম ও আত্তীকরণের মধ্যে দিয়ে এই ব্যবস্থাটি এগিয়ে চলে। ফলে এমন উদাহরণও পাওয়া যায় যেখানে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিম্ন বর্ণের সদস্য উচ্চবর্ণে উন্নীত হয়েছে আবার তার উল্টোটাও ঘটেছে। তবে এই প্রথাকে দৃঢ় করবার লক্ষ্যে (নির্দিষ্ট বর্ণে) জন্মের ভিত্তিতে পেশা নির্ধারণ করা হয়। তাছাড়া অসবর্ণ বিবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এই ব্যবস্থাটি উচ্চবর্ণের (তৎকালীন সময়ের শোষকশ্রেণির) দিক থেকে চালু করা হয়েছিল। ব্যবস্থাটিকে দৃঢ় করতে শাসক শ্রেণি বিভিন্ন শাস্ত্র ও সংস্কৃতিতেও তার প্রকাশ ঘটায়।
পরবর্তী সময়ে বিশেষতঃ চতুর্থ শতক থেকে যে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে সেটি সপ্তম শতক নাগাদ একটি কঠোর সামাজিক বিভাজনের রূপ নেয়। জাতিবর্ণ ব্যবস্থায় বর্ণগুলিকে বিশেষতঃ শূদ্রবর্ণকে পেশার ভিত্তিতে আবার বহু জাতিতে (পধংঃব) ভাগ করা হয়, যেমন কামার, কুমোর, তাঁতি, জেলে, গোয়ালা ইত্যাদি। এই ব্যবস্থার বিশেষ বৈশিষ্টগুলো হলো; ১) প্রতিটি জাতির জন্য পেশা নির্দিষ্ট। ২) জাতির বাইরে বিবাহ নিষিদ্ধ। ৩) জাতি পরিচয় ঠিক হয় জন্ম দিয়ে। এই প্রথা অনুসারে শূদ্রজাতি সমাজের নিচের স্তরে অবস্থান করে। তাছাড়া বিরাট জনসমষ্টি যাদের অতিশূদ্র হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। সমাজে এদের স্থান থাকে প্রায় দাসের স্তরে, ধর্মীয় আইনে এরা কোন ধরনের সম্পত্তির মালিক হতে পারে না, এদের দায়িত্ব হল গোটা গ্রামের সেবায় সবচেয়ে কষ্টকর কাজগুলি করা এবং একইসাথে অস্পৃশ্য বলে গ্রামের বাইরে বাস করা।
সাত থেকে আটশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলায় ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। এই সময়টা দেখা যায় বহু নিম্নবর্ণের মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তবে ইসলাম প্রচারকরাই শাসক শ্রেণি হয়ে যান। অপর দিকে নবদীক্ষিত ইসলাম ধর্মের মানুষগুলো আগের অবস্থাতেই থাকে। মুসলিম শাসকরাও আর্যদের ন্যায় বর্ণপ্রথা চালু রাখে। তাই জাতিবর্ণ ব্যবস্থার যে বিশেষ বৈশিষ্টটা বিদ্যমান তা জানা দরকার, এই সমাজে একজন কাপড় বোনে সেই কারণে তার পরিচয় তাঁতি নয়, সে তাঁতি এই কারণে যে সে তাঁতি জাতির ঘরে জন্ম নিয়েছে এবং সেই কারণে জন্মের মধ্যে দিয়ে তার পেশাও নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। এই ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ বা শাসক শ্রেণির মুসলিম সন্তান বিদ্যাচর্চায় অনুৎসাহী হলেও সে ব্রাহ্মণ এবং উচ্চ বংশীয় মুসলমান হয়ে থাকে। সে কখনই কৃষিকাজসহ শূদ্রদের বা দরিদ্র মুসলিমের জন্য নির্দিষ্ট পেশার কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। ব্যবস্থায় শূদ্র ও অতিশূদ্র জাতিগুলোর বিদ্যাচর্চার কোনো অধিকার ছিল না।
এখানে প্রশ্নটি মেধার নয়, আসলে মেধা বলতে যা বলা হয়, সেটি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে নিম্নবর্ণের মানুষকে দীর্ঘকাল ধরে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। আর এই বঞ্চনাকে যুক্তি সম্মত করতে ধর্ম, কর্মফলসহ আরো নানা ধর্মীয় সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করা হয়, এর ফলে নিম্নবর্ণের মানুষেরা জাতি বর্ণভেদের বিষয়টি একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম বলে মনে করে। জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্বের কারণে নিম্নবর্ণের মানুষ সামগ্রিক গণতান্ত্রিক লড়াইয়েরও অংশ নিতে পারে না। তাদেরকে নানা নিয়ম-কানুনের ফ্রেমে আটকে রেখে দমন করা হয়। বর্তমানে নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। তাই তারা সামাজিক মর্যাদার জন্য তাদের সংগ্রামকে বিকশিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পুর্বের ন্যায় বর্তমানেও শাসক শ্রেণিভুক্তরা শোষিত নিম্নবর্ণের মানুষ যাতে লড়াই-সংগ্রামর করতে না পারে তার জন্য গণতান্ত্রিক অনুশীলনের পথটা বন্ধ করছে বারবার।
স্বাধীনতার পর বহু বার দেখা যায় যে, অনেক এক নায়ক স্বৈরাচারী সরকারের জন্ম হয়েছে। প্রতিটি ফ্যাসিবাদ সরকারের পতনে মুখ্য ভূমিকাটা রেখেছে শোষিত শ্রেণির মানুষগুলো। কিন্তু আন্দোলনের বিজয় অর্জনের পর তারা তাদের কাঙ্খিত ফল পায়নি। ২৪-এর বৈষমবিরোধী আন্দোলনে স্বৈরশাসক হাসিনা সরকারের পতন হয়। এই পতনের পর সকল প্রকার বৈষম্য নিরোধের লক্ষ্যে জাত বিলোপ জোট গঠিত হয়েছে। এই জোট কিছু দাবি জাতির সামনে তুলে ধরে। তা হলো- বৈষম্য বিলোপ কমিশন গঠন করাসহ বৈষম্য বিলোপ আইন পাস করা, আদিবাসী, দলিত হরিজন ও চা শ্রমিকের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা।
সকল পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও চা শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৮শ টাকা নির্ধারণ করা। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী তালিকা সংবিধানের তফসিলে যুক্ত করা। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ১০ কোটি টাকার বৃত্তির ব্যবস্থাসহ উচ্চশিক্ষা ও চাকরিতে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ৬ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়নের লক্ষে জাতীয় সংসদে জন সংখ্যানুপাতিক আসন রাখাসহ সকল প্রকার স্থানীয় সরকারের একজন করে দলিত ও নিম্নর্বণের জনগোষ্ঠী প্রতিনিধর আসন সংরক্ষণ করা।
জাতপাত বিলোপ করে শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়া এখন সময়ের দাবি। তাই এই দাবিগুলো যুক্তিযুক্ত, কারণ হাজার হাজার বছর ধরে এই নিম্নবর্ণের মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। ফলে এরা মূলধারায় কখনো আসতে পারে নাই। তাই এই জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় আনতে হলে এই দাবিগুলো অবশ্যই পূরণ করাটা জরুরি।
সবারই মনে রাখা দরকার যে কোনো জনগোষ্ঠীকে পশ্চাৎপদ রেখে বৈষম্যহীন সমাজ গড়া সম্ভব না। তাছাড়া ২৪-এর আন্দোলনের মূল স্পিরিট হলো, সকল প্রকার বৈষম্য দূর করা। তাই জাতপাত বিলোপ করাটা জরুরি।
লেখক :- কলামিস্ট
কেকে/ এমএস