গাজা উপত্যকার বিধ্বস্ত ভূমিতে অবশেষে ফিরে আসছে শান্তি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও হামাস যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে সম্মত হয়েছে- এ খবর শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নয়, সমগ্র বিশ্বের মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে। গত এক বছরে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে ৬৭ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি, লাখ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুতি এবং গাজাকে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা- এ পটভূমিতে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা নিঃসন্দেহে এক তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত।
তবে ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি কেবল ঘোষণায় টেকে না; তা টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন আস্থা, ন্যায়বিচার ও পারস্পরিক সম্মান। ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে জিম্মিদের মুক্তি, ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং মানবিক সহায়তা পুনরায় চালুর কথা বলা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়- এ পরিকল্পনা কতটা টেকসই? আল জাজিরার বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা যথার্থই বলেছেন, ‘এটি কেবল প্রথম ধাপের সূচনা।’
এখনো অনিশ্চিত রয়ে গেছে গাজার ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক কাঠামো, হামাসের রাজনৈতিক অবস্থান এবং ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য। ইসরায়েল বলছে, হামাস নিরস্ত্র হলেই যুদ্ধ শেষ হবে; হামাস বলছে, দখলদারত্বের অবসানই তাদের লক্ষ্য। এ দুই বিপরীত অবস্থান যদি অটুট থাকে, তাহলে যুদ্ধবিরতি কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তবু এ উদ্যোগের কূটনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কাতার, মিসর ও তুরস্কের মধ্যস্থতা, রাশিয়ার সমর্থন এবং বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের স্বাগত বক্তব্য- সবই ইঙ্গিত দিচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবার হয়তো একসঙ্গে চাপ সৃষ্টি করতে প্রস্তুত। জাতিসংঘ মহাসচিবের ভাষায়, এটি ‘অতি-প্রয়োজনীয় এক অগ্রগতি’।
তবে গাজার মানুষের বাস্তবতা এখনো ভয়াবহ। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে পরিবারগুলো এখনো জানে না, তারা আগামীকাল কোথায় ঘুমাবে। যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় যে উল্লাস দেখা গেছে, তার মধ্যেও মিশে আছে সতর্কতা ও অবিশ্বাস। কারণ গত দুবছরে এমন বহুবার ‘অস্থায়ী শান্তি’র প্রতিশ্রুতি ভেঙে গেছে রক্তক্ষয়ের মধ্যেই। যুদ্ধের পরবর্তী ধাপে ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা- ‘বোর্ড অব পিস’ গঠন করা হবে, যার চেয়ারম্যান হবেন ট্রাম্প নিজে। যদি এই সংস্থা সত্যিই নিরপেক্ষভাবে কাজ করে এবং গাজার পুনর্গঠন ও মানবিক সহায়তার কার্যকর তদারকি নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে সেটি এক নতুন দৃষ্টান্ত হতে পারে। কিন্তু যদি এটি কেবল রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে ফল হবে আরও বিভাজন ও ক্ষোভ।
আজকের বিশ্বে শান্তি কেবল অস্ত্রবিরতির মধ্যেই সীমিত নয়; তা নির্ভর করে ন্যায়বিচার, মানবিক সহায়তা এবং স্বাধীনতার স্বীকৃতির ওপর। ফিলিস্তিনের জনগণ আজও সেই মৌলিক অধিকারগুলোর অপেক্ষায়। ট্রাম্পের এ উদ্যোগ হয়তো সেই পথে একটি দরজা খুলে দিয়েছে- কিন্তু দরজার ওপারে সত্যিকারের শান্তি আছে কিনা, সেটি এখনো অনিশ্চিত। গাজায় যুদ্ধবিরতির এই ঘোষণাকে ইতিহাসের এক সম্ভাবনাময় মুহূর্ত বলা যায়। তবে এটি যেন আরেকটি ব্যর্থ প্রতিশ্রুতির অধ্যায় না হয়ে ওঠে, তার জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছতা, পারস্পরিক আস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত চাপ। শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া গেছে- এখন সেই পথে এগিয়ে যাওয়াই হবে প্রধানতম কাজ।
কেকে/ এমএ