রাশিয়ার কাছে ইউক্রেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সব দিক থেকে ইউক্রেন রাশিয়ার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে ইউক্রেনকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা বেষ্টনী হিসেবে মনে করা হয়। ন্যাটো যদি ইউক্রেনকে সদস্য করে নিত তাহলে পশ্চিমা সামরিক ঘাঁটি সরাসরি রাশিয়ার সীমান্তে চলে আসত। তা ছাড়া ইউক্রেনের অবস্থান রাশিয়ার জন্য পশ্চিম ইউরোপে প্রভাব বিস্তরের কৌশলগত দরজা।
অর্থনৈতিক ও সম্পদগত দিক দিয়ে ইউক্রেন এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘শস্যভান্ডার’ ছিল। এখনো বিশ্বের অন্যতম শস্য রপ্তানিকারক দেশ। ডনবাস অঞ্চল (পূর্ব ইউক্রেন) ‘শিল্প, কয়লা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। ইউক্রেনের মধ্য দিয়েই রাশিয়ার অনেক গ্যাস পাইপলাইন ইউরোপে গিয়েছে যা রাশিয়ার জন্য বড় আয়ের উৎস।
ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বে কিয়েভকে রাশিয়া তার ঐতিহাসিক জন্মভূমির অংশ মনে করে। কারণ কিয়েভান রাস সভ্যতা থেকে রাশিয়ান জাতির সূচনা। রাশিয়ান ভাষাভাষী ও প্রো-রাশিয়ান জনসংখ্যা বিশেষত পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনে প্রচুর। অর্থোডক্স খ্রিষ্টান চার্চের সাংস্কৃতিক শিকড় ও কিয়েভের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। সামারিক কৌশলগত দিক থেকে ক্রিমিয়া যা রাশিয়া ২০১৪ সালে দখল করে রাশিয়ার জন্য ব্লাকসি ফ্লিটের ঘাঁটি ও সমুদ্রপথে শক্তি প্রদর্শনের জন্য অপরিহার্য।
ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণ করা মানে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্য বজায় রাখা। রাশিয়া মনে করে ইউক্রেনের পশ্চিমা ঘনিষ্ঠতা তার প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে যাওয়া। ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবাধীন রাখা রাশিয়ার জন্য তার মহাশক্তি পরিচয় বজায় রাখার অংশ। সংক্ষেপে ইউক্রেন রাশিয়ার কাছে শুধু একটি প্রতিবেশী দেশ নয় বরং ইতিহাস, নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও মহাশক্তির মর্যাদা, রক্ষার কেন্দ্রবিন্দু।
খনিজ সম্পদের দিক থেকে ইউক্রেনের বিশালত্ব রাশিয়ার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনে প্রায় ২০,০০০ খনিজ স্থল আছে। এর মধ্যে ৮৭০০টি পরীক্ষিত (প্রুভেন) যা ১১৭ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ধাতু ও খনিজ নিয়ে গঠিত। এই সম্পদগুলো ইউরোপ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদের মধ্যে টাইটানিয়াম, লিথিয়াম, গ্রাফাইট, এলিমেন্টস, নিয়ন ও ক্রিপটন গ্যাস অন্যতম। টাইটানিয়ামের বৃহত্তম রিজার্ভ ইউক্রেনে রয়েছে।
বায়ু সেনা, চিকিৎসা ও সামরিক প্রযুক্তিতে ইহা বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম রিজার্ভ ৫০,০০০ টন লিথিয়াম ইউক্রেনে আছে। যা ব্যাটারি, বিশেষ কাঁচ ও সবুজ শক্তি যন্ত্রে প্রয়োজন হয়। বিশ্বব্যাপী রিজার্ভের প্রায় ২০ ভাগ গ্রাফাইট ইউক্রেনে রয়েছে। যা ব্যাটারি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়। বেরিলিয়াম, ইউরেনিয়াম, গ্যালিয়াম রিয়ার আর্থ এলিমেন্টস এসব খনিজ স্যাটেলাইট, নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর ও আধুনিক সামারিক প্রযুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনের আয়রন ম্যাঙ্গানিজ, তামা, সলিড, সিলভার, নিকেল, কোবাল্ট এসব ইস্পাত, নির্মাণ ও ইলেক্ট্রনিক্স শিল্পের জন্য অপরিহার্য। তা ছাড়া নিয়ন ও ক্রিপটন গ্যাস সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে ব্যবহৃত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস। ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ মোট জগতের প্রায় ৫ শতাংশজুড়ে রয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন কৌশল নিয়েছে চীন বাদে বৈশ্বিক সরবরাহ নির্ভরযোগ্য করতে ইউক্রেনের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর জন্য। ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের ভরসা সংক্রান্ত অনেক খনিজ অঞ্চল যেমন ডনবাস, দোনেটস্ক, জাপোরিজিয়া, বর্তমানে রশিয়ার নিয়ন্ত্রণের রয়েছে। সর্বাধিক প্রায় ৬৩ শতাংশ কয়লা, ৫০ শতাংশ ম্যাঙ্গানিজ, অর্ধেক বিরল খনিজ এবং ২৭ শতাংশ আয়রন এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। অনুমান অনুসারে এদের মূল্য হিসেব টঝউ ১২ ট্রিলিনিয়নের কাছাকাছি। অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ এর মধ্যে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের সম্ভাব্য মূল্য টঝউ ১১-১৫ ট্রিলিনিয়নের আশপাশে।
ইউক্রেনে একটি রিকনস্ট্রাকশন ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড চালু হচ্ছে। যেখানে প্রাপ্ত রাজস্বের ৫০ শতাংশ পুনবিনিয়োগ করা হবে। তবে অবকাঠামো ভাঙ্গা, নিরাপত্তার উদ্বেগ, অব্যবহৃত খনির সংখ্যা, রাজধানী বিনিয়োগের অভাব, সব মিলিয়ে সম্পদের পূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ এবং সময় সাপেক্ষ। অর্থনৈতিক মানের দিক দিয়ে ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার সম্ভাবনা রয়েছে ইউক্রেনে। তবে অবকাঠামোগত ত্রুটি, যুদ্ধ, খনি অপ্রতুলতা এবং ঝুঁকি খনন কাজ উন্নয়নের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউক্রেনের আয়তন ৬,০৩,৫০০ বর্গকিলোমিটার। এটি ইউরোপ মহাদেশের সবচেয়ে বড় দেশ। আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের ৪৬তম বৃহত্তর দেশ। ইউক্রেনের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় ৪ গুণের বেশি। ইউক্রেনের কালো মাটি (পযবৎহড়ুবস ংড়রষ) আর বিস্তীর্ণ কৃষি জমির জন্য দেশটি বিশ্বের অন্যতম কৃষিপণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশ। গম, ভুট্টা, সূর্যমুখী বীজ ও তেল, বার্লি, সয়াবিন, রেপসিড, আখরোট অন্যতম রপ্তানিযোগ্য পণ্য। ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে যায়।
ইউক্রেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পায়। ইউক্রেন ছাড়া আরো চৌদ্দটি দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়। বর্তমান যুদ্ধাবস্থার মধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের দোনবাস এলাকার লুহানস্কের প্রায় ১০০ শতাংশ অঞ্চল, ডোনেটক্সের প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তা ছাড়া জাপোরিজিয়া ও খেরসন উভয় প্রদেশের প্রায় ৭৩-৭৪ শতাংশ রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।
খারকিভ, সুমি, দানিপ্রোপেত্রোভস্ক এই অঞ্চলে খুব ছোট অংশ রাশিয়ার দখলে রয়েছে তা প্রায় ৪০০ কিলোমিটার এলাকা। সব মিলিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনের প্রায় ১৯ শতাংশ বা ১ লাখ বর্গকিলোমিটারের মতো এলাকা দখল করে রেখেছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার স্বার্থ হলো ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক আধিপত্য, নিরাপত্তা, ভূখণ্ড গত প্রভাব, কৃষ্ণসাগর নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ ব্যাংক
কেকে/ এমএস