সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, ভবঘুরে বা সাধুবেশী মানুষদের জোর করে চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হচ্ছে। কখনো কয়েকজন লোক মিলে ধরে রেখেছেন, আবার কেউ সম্মতি ছাড়াই জোর করে চুল কাটার ভিডিও বানিয়ে প্রকাশ করছেন। এসব ভিডিওতে ভুক্তভোগীদের কষ্ট, কান্না, আতঙ্ক- সবই স্পষ্ট। অথচ যারা কাজটি করছেন, তাদের কাছে বিষয়টি এক ধরনের ‘সামাজিক সেবা’ বা ‘কনটেন্ট ব্যবসায়’।
কিন্তু এ ধরনের কাজ মোটেই সামাজিক সেবা নয়। বরং এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংবিধানবিরোধী এবং আইনের চোখে অপরাধ। কারো জীবনধারা, পোশাক বা দাড়ি-চুল কারো পছন্দ না হলে তার সমাধানের দায়িত্ব সাধারণ নাগরিকের নয়, এমনকি যদি সেটি বাংলাদেশের আইনের পরিপন্থিও হয় সেটিও দেখার দায়িত্ব হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। ফলে এভাবে জবরদস্তি করে অন্যের চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া কেবল ভুক্তভোগীর মর্যাদাকেই হানি করছে না, সমাজের মধ্যেও বিভ্রান্তি ও ভীতি ছড়িয়ে দিচ্ছে।
পশ্চিমা বিশ্বের অনেক জায়গায় দেখা যায়, কনটেন্ট নির্মাতারা গৃহহীন মানুষদের সাহায্য করেন, চুল-দাড়ি ছেঁটে দেন, জামাকাপড় দেন, এমনকি আর্থিক সহায়তাও করেন- তবে সবটাই হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্মতিতে। সেখানে লক্ষ্য থাকে কারও জীবনে স্বস্তি আনা। অথচ আমাদের এখানে ভিউ ও আলোচনার লোভে জোর করে এ ধরনের কনটেন্ট বানানো হচ্ছে। সম্মতির তোয়াক্কা নেই, বরং মানুষকে অপমান করে আনন্দ লাভই হয়ে উঠছে প্রধান উদ্দেশ্য। এ ছাড়া বাংলাদেশের অনেক সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক চর্চার একটি অনুষঙ্গ হলো চুল। ফলে পশ্চিমা ভবঘুরেদের বাস্তবতা বাংলা অঞ্চলের ভবগুরুদের বাস্তবতা একটু ভিন্ন। এ বিষয়টি সবারই মাথায় রাখতে হবে।
আরো উদ্বেগজনক ব্যাপার হচ্ছে, এ প্রবণতা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে আর আটকে নেই। মাজার ভাঙচুর, নারীর পোশাক নিয়ে মারধর, যৌনকর্মীদের ওপর হামলা- এসব ঘটনাও একই ধারাবাহিকতার অংশ। যেন একটি গোষ্ঠী নিজের মোরালিটির মানদণ্ড সমাজের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্র যেখানে ‘ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই’- এই মৌলিক শিক্ষা তুলে ধরে, সেখানে নাগরিকেরা যদি জোর খাটিয়ে তথাকথিত ‘ভালো কাজের’ দায়িত্ব নেন, তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বিভক্তি ছাড়া আর কিছুই জন্ম নেবে না।
রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব হলো মানুষের মর্যাদা রক্ষা করা। আমাদের বুঝতে হবে, গণতান্ত্রিক সমাজে ভিন্ন মত, ভিন্ন আচরণ, ভিন্ন পরিচয়- এসবই সহনশীলতার মধ্য দিয়ে টিকে থাকে। সরকারকে তাই এ ধরনের জবরদস্তি ও অপমানজনক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর নাগরিক সমাজকে বলতে হবে- কোনো কনটেন্টের জন্য মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন করা চলবে না। সম্মতি ছাড়া চুল কেটে দেওয়া কোনো ভদ্রতা নয়, কোনো ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, কোনো সামাজিক সেবাও নয়। এটি নিছক অপমান, জুলুম এবং অপরাধ। সমাজকে বাঁচাতে হলে, সব মত ও পথের মানুষের মর্যাদাকে রক্ষা করতে হলে এ হীন কাজকে সামজিকভাবে প্রতিহত করতে হবে এবং আইন প্রয়োগ করে জুলুমকারীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
কেকে/ এমএ