আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ক্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সরকার ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোনো কোনো দল বিভিন্ন আসনে প্রার্থীও চূড়ান্ত করেছে।
আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু না হলেও স্থানীয়ভাবে অনেকেই নির্বাচনি প্রচারে নেমেছেন। নানা ধরনের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি জনগণের কাছে পৌঁছাতে নানা কৌশল নিচ্ছে দলগুলো। একই সঙ্গে নির্বাচনে প্রচারণায় চলছে ধর্মের ব্যবহারও। ধর্মীয় ব্যক্তিদের দিয়ে মসজিদকেন্দ্রিক বয়ান তৈরি করছে কোনো কোনো দল। এ ছাড়া নারীদের দিয়ে ধর্মীয় আলোচনার আড়ালেও চলছে নির্বাচনের প্রচার। অন্যদিকে জনপ্রিয় ধর্মীয় বক্তরা কৌশলে ধর্মভিত্তিক আলোচনা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় অভিযোগ করেছেন, মৌলবাদীরা বেহেশতের টিকিট বিক্রি শুরু করেছে। সম্প্রতি রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আপনারা যাদের মৌলবাদী বলেন, আমি তাদের মৌলবাদী বলি। তারা এখন বেহেশতের টিকিট বিক্রি করতেছে। অর্থাৎ তাগো লগে থাকলে আপনি বেহেশতে যাবেন; আর তাগো লগে না থাকলে আপনি দোজখে যাইবেন। আর নিজেরা বেহেশতে যাইব কি না, সেই কথা তারা জানে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘সেজন্য আমি বলব, দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান হচ্ছে। উগ্র উন্মাদনা সৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, যেটার মধ্য দিয়ে মব তৈরি হয়।’
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা যদি গণতন্ত্রের পথে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে না রাখতে পারি, তাহলে সাম্প্রদায়িকতা হবে ফ্যাসিবাদের চেয়ে দ্বিগুণ কঠিন এবং জনজীবন ধ্বংসের শেষ মাথায় নিয়ে যাবে। এই আধুনিক বিশ্বে মুক্ত চিন্তা, প্রতিভার বিকাশ এরা (সাম্প্রদায়িক শক্তি) হতে দেবেন না, ওরা করতে দেবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিএনপি ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাস করে। প্রত্যেকটা ধর্ম- যে যেই বিশ্বাসই করুক না কেন, ধর্ম কিন্তু মানুষকে সঠিক পরিচালিত করার জন্য একটা জীবন ব্যবস্থা।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির পল্লী উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক ফরহাদ হোসেন আজাদ বলেছেন, এখন তালিমের নামে কিছু মহিলা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেহেশতের টিকিট বিক্রি করছেন। তারা যদি ইসলামের কথা বলে তাহলে কোনো আপত্তি নেই। তারা যদি কোনো দলের পক্ষে বেহেশতের টিকিটের কথা বলে, তাহলে তাদের প্রতিহত করতে হবে। কারণ তারা জালিম মুনাফেক। কে বেহেশতে কে দোজখে যাবে তা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ জানে না। আর কোনো দলের পক্ষে থাকলেও বেহেশতে যাওয়া যায় না। যারা এমন কথা বলে তাদের কাছে বেহেশতের টিকিট দেখতে চাইবেন।’ তিনি আরো বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায় হওয়ার পর এখন মাঠে-ঘাটে যেখানে সেখানে সভা সমাবেশ করা যায়, অথচ এই দলটি মসজিদে মসজিদে গিয়ে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। তিনি মসজিদকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করতে হুঁশিয়ারি দেন।
কোনো কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জনগণের কাছে দাবি করছে, তাদের প্রার্থীদের ভোট দিলে, সেই ভোট ইসলামের পক্ষে থাকবে। এই ভোট আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলকে দেওয়া হবে। এর ফলে হাশরের মাঠেও আল্লাহর দরবারে পার পাবেন। ধর্মকে ব্যবহার করে এভাবেই সাধারণ মানুষের কাছে ভোটের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এমনকি বিএনপির অনেক নেতাকর্মীও তাদের ভোটের প্রচারণায় ধর্মকে ব্যবহার করছেন বলে জানা গেছে।
ধর্মীয় ব্যক্তিদের দিয়ে মসজিদকেন্দ্রিক বয়ান তৈরি : মসজিদ বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। অভিযোগ রয়েছে, এই জায়গাটিকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করছে জামায়াতে ইসলামী। দেশের বিভিন্ন এলাকার ইমাম-খতিব ও ধর্মীয় বক্তাদের মাধ্যমে রাজনৈতিক বয়ান ছড়ানো হচ্ছে। তবে এ নিয়ে অভিযোগ রয়েছে- শুক্রবারের খুতবা, ওয়াজ মাহফিল বা অন্যান্য ধর্মীয় বয়ানে সূক্ষ্মভাবে অন্যান্য দলের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করছে সংগঠনটি। একাধিক মুসল্লির সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, ‘মানুষ আল্লাহর ওয়াস্তে মসজিদে আসে। এখানে রাজনৈতিক বয়ান দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু কিছু বক্তা ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে এমনভাবে মিশিয়ে দেন যে সাধারণ মানুষ তা সহজেই বিশ্বাস করে নেয়।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই কৌশল সরাসরি ভোট চাওয়ার চেয়ে কার্যকর। কারণ, মানুষ ধর্মীয় নেতার কথাকে নিঃশর্তভাবে বিশ্বাস করে এবং ভোটের দিন সেই প্রভাব ভোটকেন্দ্রে প্রতিফলিত হয়।
নারী কর্মীদের দিয়ে দাওয়াতি কাজের মিশন : প্রান্তিক এলাকায় জামায়াত নারী কর্মীদের মাধ্যমে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাচ্ছে। তারা নিয়মিত ধর্মীয় তালিম, মহিলাদের মিলনমেলা ও বয়ান আয়োজন করে নারীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ তৈরি করছে। এসব আসরে প্রথমে শুধুই ধর্মীয় শিক্ষার কথা বলা হলেও ধীরে ধীরে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডাও পৌঁছে দেওয়া হয়। অনেক নারী অংশগ্রহণকারী এই কৌশলকে সাধারণ বিষয় হিসেবে দেখলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি সরাসরি ভোট টানার একটি সূক্ষ্ম উপায়।
ধর্ম নিয়ে মিথ্যাচার
সম্প্রতি ইসলামি বক্তা আমির হামজার একটি বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যেখানে তাকে বলতে শোনা যায়- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মহসীন হলে নাকি, গত ১৬ বছরে আজান দিতে দেওয়া হয়নি। আমির হামজা জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে তার বক্তব্যের সত্যতা মেলেনি মহসীন হলের মুয়াজ্জিন মো. আবুল বাশারের বক্তব্যে। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, গত ২০ বছর ধরে তিনি মহসীন হলের মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করছেন। এ সময় তিনি কখনোই আজান দিতে বাধার সম্মুখীন হননি। এমনকি তার অনুপস্থিতিতে হলের ছাত্ররাই আজান দিয়ে থাকেন।
তার এমন বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা জানান, মুফতি আমির হামজা এমন বক্তব্যের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ক্ষুণ্ন করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সারা দেশের মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চান। সেই লক্ষ্যেই হয়তো তিনি এ মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন।
কেকে/এআর