সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ কয়েকটি বিষয়ে হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি। বিশেষ করে পিআরের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। অন্যদিকে বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো পিআরের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে জামায়াতসহ ৭ রাজনৈতিক দল। এর বাইরে চলছে কথার লড়াই। যা ক্রমেই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। সব মিলিয়ে সরকার যখন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের আয়োজন নিয়ে এগোচ্ছে, সে মুহূর্তে দলগুলোর মধ্যে বিভাজন দেশের রাজনীতিতে নতুন সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বৈরাচরবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল, বর্তমানে তা অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে। নানা ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। যা বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই উদ্বেগজনক। তারা বলছেন, স্বৈরাচার পতনের এক বছর পরও দেশ এখনো ঝুঁকিমুক্ত নয়। বাংলাদেশ নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। পতিত আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাদের পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। এমনকি আওয়ামী লীগকে ফেরাতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সুযোগ সন্ধানীদের নিয়ে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিরোধ দেশকে গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যাবে। আর এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে তৃতীয় কোনো শক্তিও। যা দেশের জন্য মোটেও ভালো হবে না।
বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, নির্বাচনের আগে সব রাজনৈতিক বিরোধ দলগুলোকে মিটিয়ে ফেলা উচিত। কারণ নিজেদের বিরোধে যদি নির্বাচন অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়, তবে তা গণতন্ত্রের উত্তোরণকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ ছাড়া পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তিও নির্বাচন বানচালে উঠেপড়ে লেগেছে। তাই কোনোভাবেই নির্বাচন ব্যাহত হতে দেওয়া যাবে না।
সম্প্রতি রাজপথে নেমেছে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্তত সাতটি দল। দলগুলোর মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে জড়িত কয়েকটি দল যেমন আছে, আবার তাদের দাবিগুলোও অনেকটা একই রকম। জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন, আনুপাতিক বা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, আওয়ামী লীগের বিচার এবং জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা- এসব দাবিতে বিভিন্ন দলের কর্মসূচিও পালন করা হচ্ছে একই দিনে। জামায়াত ছাড়া অন্য দলগুলো হলো ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জামায়াতে ইসলামী, খেলাফতে মজলিসের দুটি অংশ, নেজামে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা।
এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দাবি নিয়ে বিএনপির অবস্থান ভিন্ন। দলটি এর পেছনে ‘অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা’ দেখছে। আবার রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে রাজপথে সংঘাতের সূচনা হতে পারে কি না, সে আশঙ্কাও করছেন অনেকে। রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।
এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, আগামী ৫ মাসে রাজনীতিতে আরো অনেক কিছুই ঘটবে, যা আমরা এখন কল্পনাও করতে পারছি না। তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাস্তবসম্মত নয়। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টির মাধ্যমে নৌকা লাঙলে উঠে পতিত আওয়ামী লীগের ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের লেজ নয়, মাথা।
গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, নতুন করে আবারো অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছি। এখন যদি আমরা জাতীয় ঐকমত্য হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি, তাহলে তো নির্বাচন অবশ্যই অনিশ্চিত। যখনই নির্বাচন অনিশ্চিত থাকবে তখনই নিশ্চিত দুটো ঘটনা ঘটবে। একটা হলো অর্থনীতি আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে, কারণ বিনিয়োগ হবে না। দ্বিতীয়ত, মব সংস্কৃতি বলছেন বাড়বে। তিনি আরো বলেন, জুলাই সনদ ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, দুটোরই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে সেদিকে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে জাতীয় নির্বাচন অনিশ্চিত করলে আরো গভীর সংকটে পড়বে দেশ।
পাল্টা বক্তব্যে উত্তপ্ত রাজনীতি
বিএনপি মনে করছে ঐকমত্য কমিশনে যখন আলোচনা চলছে তখন রাজপথে আন্দোলনের ‘ভিন্ন উদ্দেশ্য’ আছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাত দলের আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘ঐকমত্যের প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কেউ যদি রাস্তা অবরোধ করতে চায়, মবোক্রেসি করতে চায়, জোর করে আদায় করতে চায় তাহলে তো এটা ঐকমত্যের বাইরে গিয়ে একটা অরাজনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছে।’
বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে জানিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বর্তমানে দেশে অনেক ষড়যন্ত্র চলছে এবং মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হচ্ছে বিএনপিকে। যাদের কাল জন্ম হয়েছে এবং যারা একাত্তর সালে ভিন্ন অবস্থানে কিংবা ভিন্ন জায়গায় ছিলÑ তারাও বিএনপিকে নিয়ে নানা কথা বলে।’
এদিকে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘নির্বাচনে যারা কোটি কোটি টাকার মনোনয়ন-বাণিজ্য করতে পারবে না, তারাই সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতি ঠেকাতে চায়। সব দলের প্রতিনিধিত্বের মধ্য দিয়ে একটি অংশীদারির সংসদ হলে তারা কর্তৃত্ববাদী শাসন চালাতে পারবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিএনপি পিআর মানতে চায় না। টানা ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবে না মানতে চায় না। সাংবিধানিক পদগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছামাফিক নিয়োগ বাদ দিতে আলাদা নিয়োগ কর্তৃপক্ষ হবে, সব জায়গায় এটা তারা মানতে চান না। এসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তারা আপত্তি করছেন। পিআর তারা এজন্য মানতে চান না, কারণ যখন দলকে নির্বাচিত করা হয় তখন ব্যক্তির কোনো স্বার্থ থাকে না। এতে কোনো ব্যক্তি কালো টাকা, মাস্তানি, পেশিশক্তি দেখিয়ে নির্বাচনে কারচুপি করতে কেন যাবে?’
সুযোগ খুঁজছে আওয়ামী লীগ
ক্ষমতা হারানোর পর থেকেই দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। দলটির সভানেত্রী ভারত থেকে সেই ষযড়ন্ত্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর এ ষড়যন্ত্রে লজিস্টিকসসহ প্রয়োজনীয় সমর্থন দিচ্ছে ‘র’। সম্প্রতি তাদের অপতৎরতা বেড়ে চলছে। সারা দেশে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের ঝটিকা মিছিল বেড়ে চলছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঘিরে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছে তারা। বর্তমানে প্রায় প্রতিদিনই প্রকাশ্যে ঝটিকা মিছিল করছে তারা। এমনকি জনবহুল সড়কে পুলিশের উপস্থিতিতে মিছিল করছে তারা। গ্রেফতার করেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
মূলত, দেশের রাজনৈতিক বিরোধের সুযোগে পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তি দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা জোরালো করেছে।
কেকে/এআর