ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৬ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের কারণে গণতান্ত্রিক ও লড়াকু ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল বিএনপির। বিগত সরকারের সময় সারা দেশে দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী গুম-খুন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। অন্যায়ভাবে কারাভোগ করতে হয়েছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও। সাজা দেওয়া হয়েছে তারেক রহমানসহ বহু শীর্ষ নেতাকে।
এরপরও দলটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো প্রকার আপসে যায়নি। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর পাল্টে যায় পরিস্থিতি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগে দলটির অনেক নেতাকর্মী চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নিয়েও তারা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দলটির ভাবমূর্তি। এবার দলীয় ভারমূর্তি ফেরাতে একগুচ্ছ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে দলটি।
বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলের অভ্যন্তরে স্বচ্ছতা ফেরাকে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে এরই মধ্যে নানা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দলের শূন্য সহনশীলতার (জিরো টলারেন্স) বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে নেতাকর্মীদের।
জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জনমত গঠন, বিরোধী দলের সমালোচনার জবাব ও সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে ভোটারদের আশ্বস্ত করতে অক্টোবরের মাঝামাঝিতে দেশব্যাপী প্রচারাভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দুর্গাপূজার পর দলটি জনসংযোগ শুরু করবে। বিএনপি নেতারা জানান, জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে বৈঠক, সমাবেশ ও আলোচনার মাধ্যমে এ প্রচারণা চালানো হবে।
আরো জানা গেছে, কোনো নেতাকর্মীর অপরাধের দায় দল নেবে না। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিপক্ষের অপপ্রচার রোধে কৌশল নির্ধারণে মন দিচ্ছে দলটি।
দলটির এরই মধ্যে নির্বাচনে সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার আগে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে তারা আলোচনা করবে।
সরাসরি ভোটে জেতার সম্ভাবনা রয়েছে এমন নারী নেত্রীদেরও একটি খসড়া তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। একইসঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ঘোষিত বিএনপির ৩১ দফা এজেন্ডার ভিত্তিতে নির্বাচনি ইশতেহার প্রস্তুত করবে দলটি।
জানা গেছে, গত সোমবার রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব বিষয় আলোচনা হয়। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের অভিযোগসহ নানাভাবে তৃণমূল নিয়ন্ত্রণে যখন বিএনপি হিমশিম খাচ্ছে, সে সময় এমন প্রচারণার সিদ্ধান্ত নিল দলটি।
এদিনের বৈঠকে বিএনপি নেতারা আরো দাবি করেন, ডাকসু নির্বাচনে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ গোপন আঁতাত করেছিল। তারা বলেন, ছাত্রলীগের সব ভোট চলে গেছে ছাত্রশিবিরের কাছে। দলীয় নেতারা ডাকসুতে ভরাডুবির কারণ হিসেবে পরিকল্পনার অভাব, গুরুত্বহীনতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেন। তারা জোর দিয়ে বলেন, এখন দলের কাঠামো পুনর্গঠন, সমন্বয় জোরদার ও কৌশলগতভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপির হাইকমান্ড ৩০০টি নির্বাচনি এলাকায় জরিপ চালিয়ে বিতর্কমুক্ত, জনপ্রিয়, শিক্ষিত ও শক্তিশালী প্রার্থীদের তালিকা করেছে।
জরিপ ও দলীয় বিবেচনায় উপযুক্ত ব্যক্তিদের প্রার্থী হিসেবে সবুজ সংকেত দেওয়ার পরামর্শও নেতারা দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে তারা পরামর্শ দেন, যে কোনো অন্তঃকোন্দল শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা উচিত। বিএনপি এই নির্বাচনে ১৫-২০ জন নারীকে সরাসরি নির্বাচনে প্রার্থী করার বিষয়ে মনোনিবেশ করছে।
নেতাকর্মীদের স্থানীয় কোন্দলে জড়িত না হওয়ার নির্দেশ
বিএনপির নেতাকর্মীদের স্থানীয় সালিশ, দাঙ্গাহাঙ্গামা বা পক্ষপাতমূলক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় জড়িত না হতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে দলটির পটুয়াখালী জেলার সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান টোটনের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা জারি করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বিএনপি জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করছে। এ দলের প্রতিটি কর্মী জনগণের আস্থার প্রতীক এবং আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রভাগের সৈনিক। দলীয় ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখা এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কোনো নেতাকর্মীকে সালিশ বা পক্ষপাতমূলক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে।’
বিজ্ঞপ্তিতে আরো উল্লেখ করা হয়, সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে রাজনৈতিক কর্মসূচি, সাংগঠনিক দায়িত্ব ও জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে মনোনিবেশ করতে হবে। জনগণের সঙ্গে সদাচরণ, ভদ্র ভাষা ব্যবহার এবং মানবিক আচরণের মাধ্যমেই বিএনপির নেতাকর্মীদের কাজ করতে হবে। জনগণই দলের শক্তি এবং আন্দোলনের মূল ভিত্তি। তাই জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে দায়িত্বশীল ও সহমর্মী আচরণ প্রদর্শন করতে হবে। এতে দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বলা হয়, নির্দেশনা অমান্য করলে তা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ হিসেবে গণ্য হবে এবং সাংগঠনিক বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কেকে/ এমএস