দেশের পোশাক খাত বর্তমানে একাধিক সংকটে জর্জরিত। ব্যাংকিং জটিলতা, অর্ডার সংকট, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও ডলার সংকটের প্রভাবে অনেক কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ঝুঁকিতে পড়ছে লাখো শ্রমিকের কর্মসংস্থান। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে শুধু নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই কয়েকশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন অর্ডার আশানুরূপ না আসায় অনেক কারখানা অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, নীতি সহায়তা ও ব্যাংকিং সমস্যার সমাধান না হলে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের হিসাবে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের কয়েকটি জেলায় নিবন্ধিত পোশাক কারখানার সংখ্যা ৩০৩০টি এবং অনিবন্ধিত ৭২টি। তবে বন্ধ কারখানার তথ্য জানে না প্রতিষ্ঠানটি।
ঢাকার টঙ্গীতে অবস্থিত একটি পোশাক কারখানার এক কর্মকর্তা জানান, ‘শ্রমিকদের বেতন নিয়মিত পরিশোধ করা হলেও আমরা নিজেরা বেতন পাচ্ছি না।’ কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ব্যাংক থেকে ঋণ না পাওয়া, অর্ডারের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং রপ্তানি আয়ের টাকা ছাড়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
অন্য কয়েকটি কারখানার কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও একই অবস্থা থাকার কথা জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্যে, শ্রমিকদের অসন্তোষ এড়িয়ে চলার জন্য বেতন প্রদান চালু রাখা হচ্ছে, কিন্তু উপরের পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বেতন ভেঙে-ভেঙে দেওয়া হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে বকেয়া থাকছেই।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, ব্যাংকিং জটিলতার কারণে বর্তমানে প্রায় ৪০০টি পোশাক কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তাদের মতে, সরকারের নীতি সহায়তা পাওয়া গেলে এসব কারখানা পুনরায় চালু করে অতিরিক্ত ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব।
সম্প্রতি বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ৭০টিরও বেশি সদস্য প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। সভায় মূলত খেলাপি ঋণ নীতিমালা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সদস্যরা প্রস্তাব করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান সার্কুলার অনুযায়ী খেলাপি ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ৩ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করা জরুরি। তাদের দাবি, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এত স্বল্প সময়ে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্ট কমানোর বিষয়েও আলোচনা করা হয়।
সভার আলোচনায় আরো উঠে আসে, নিয়মবহির্ভূত কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান ‘ফোর্সড লোন’-এর শিকার হচ্ছে। এর ফলে তারা চেক ডিসঅনার ও অর্থঋণ মামলার মতো জটিলতায় পড়ছে, যা তাদের কার্যক্রমকে আরো বাধাগ্রস্ত করছে। এ পরিস্থিতি নিরসনে বিজিএমইএ বোর্ডকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান সদস্যরা।
এ ছাড়া, একটি সহনশীল এক্সিট নীতিমালা প্রণয়নের দাবিও জানানো হয়। সদস্যদের মতে, এটি ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের সম্মানের সঙ্গে ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেবে। তারা আরো বলেন, দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তা যেন শুধু বড় রপ্তানিকারকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোও এই সুবিধা পেতে পারে, সে বিষয়ে জোরালোভাবে দাবি জানানো হয়। এ সময় পোশাক খাতে দীর্ঘদিন ধরে রুগ্ণ হয়ে থাকা ৭৭টি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) জানিয়েছে, গত এক বছরে বিভিন্ন কারণে সংগঠনটির ১৩১টি সদস্য কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে গত জুনের পর থেকে কয়েকটি কারখানা পুনরায় চালু হয়েছে এবং আরো কয়েকটি কারখানা উৎপাদন শুরু করার জন্য আবেদন করেছে।
বিকেএমইএর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে নিবন্ধিত শতাধিক কারখানা এখনো বন্ধ রয়েছে। অর্ডার সংকট, শ্রমিক অসন্তোষসহ নানা কারণে এসব কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
সংগঠনটি জানায়, কিছু কারখানা আছে যেগুলো গত চার-পাঁচ বছর ধরে কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল। কিন্তু সম্প্রতি তারা জানিয়েছে নতুন অর্ডার পেয়েছে এবং আবার উৎপাদন শুরু করতে চায়। এ ধরনের ক্ষেত্রে বিকেএমইএ সবদিক বিশ্লেষণ করে দেখবে। যদি কর্তৃপক্ষ মনে করে কারখানাগুলো কার্যক্রম চালাতে সক্ষম, তবে তাদের নিবন্ধন নবায়ন করা হবে।
চট্টগ্রামের পোশাক ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা কমে যাওয়ায় পোশাক খাতে অর্ডার সংকট দেখা দিয়েছে। এর ফলে উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং কর্মসংস্থানও ঝুঁকির মুখে পড়ছে। গত আট মাস ধরে নতুন অর্ডার আশানুরূপ আসছে না বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। তাদের মতে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, ক্রেতাদের ব্যয় সংকোচন, কাঁচামালের উচ্চমূল্য এবং দেশে চলমান ডলার সংকটÑএসব কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) চট্টগ্রাম অঞ্চলের নেতাদের দাবি, বর্তমানে আগের তুলনায় অন্তত ২০-৩০ শতাংশ কম অর্ডার আসছে। ফলে অনেক কারখানা অর্ধেক সক্ষমতায় উৎপাদন চালাচ্ছে। এ কারণে শ্রমিকদের কাজের সময়ও কমানো হচ্ছে। যদিও এখনো পর্যন্ত বড় ধরনের ছাঁটাই হয়নি, তবে বিজিএমইএ নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেনÑঅর্ডার সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
অনন্ত গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সিনিয়র সহ-সভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, বর্তমানে গার্মেন্টস খাতে ক্রয়াদেশ আসছে, তবে পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। এদিকে ব্যাংক থেকে টাকা ছাড়ের ক্ষেত্রেও জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে পাঁচটি ব্যাংক, যেগুলো মার্জারের প্রক্রিয়ায় রয়েছে, সেগুলো রপ্তানির আয় আসলেও টাকা ছাড় দিচ্ছে না। ফলে কারখানাগুলো বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে।
তিনি জানান, বিজিএমইএ সভাপতির প্রচেষ্টায় এসআইবিএল এবং এক্সিম ব্যাংকের সমস্যাগুলো সাময়িকভাবে সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। তবে প্রতিনিয়ত ব্যবসায়ীদের নগদ অর্থের প্রয়োজন হয়। ব্যাংকগুলো টাকা ছাড় না করলে কারখানা কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। ব্যাংকগুলো মার্জার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলে এ সমস্যা আর থাকবে না বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ইনামুল হক খান বলেন, ‘যেসব কারখানায় শ্রমিকদের বেতন দিতে সমস্যা হচ্ছে, তার মূল কারণ ব্যাংকিং জটিলতা। ট্যারিফ সংক্রান্ত ঘটনার পর আমাদের প্রচুর ক্রয়াদেশ আসার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। মার্কিন বাজারে ক্রেতারা পোশাক ক্রয় কমিয়ে দিয়েছে, ফলে বায়াররাও অর্ডার কম দিচ্ছে। তা ছাড়া তারা যে দাম অফার করছে, তা আগের তুলনায় অনেক কম। এর ফলে জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যেসব কারখানা সক্ষম ও দক্ষতার দিক থেকে ভালো অবস্থানে আছে, ক্রয়াদেশ মূলত সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছেই যাচ্ছে। কিন্তু যেসব কারখানা রুগ্ণ অবস্থায় রয়েছে, সেগুলোর প্রতি বায়ারদের আগ্রহ নেই। ফলে তারা রুগ্ণ অবস্থাতেই থেকে যাচ্ছে। বর্তমানে চীনা গার্মেন্টস মালিকরা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগে আগ্রহী। প্রচুর আবেদন ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে।
কেকে/এআর