বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে নতুন চাপে পড়েছে বিএনপি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রদলসমর্থিত প্যানেলের ভরাডুবিতে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে বিএনপির নীতি-নির্ধারকদের কপালেও। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিধস জয় হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের। অন্যদিকে জাকসুতে অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় ছাত্রদলসমর্থিত প্যানেল। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিতে কিছুটা কোণঠাসা জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠনটি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন আলাদা বিষয়। তবু এবারের ডাকসুর ফল বিএনপিকে কিছুটা চাপে ফেলবে। শুধু ফলই নয়, ডাকসু, জাকসু নির্বাচন ঘিরে জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিরুদ্ধে অনলাইনে যেভাবে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে, তা ঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারেনি সংগঠনটি। এ ছাড়া জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের রাজনৈতিক কৌশলের বিপরীতে কার্যকর কৌশলও দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি ও ছাত্রদল।
বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, পাঁচ আগস্ট পরবর্তী সময়ে নতুন ধারার রাজনীতি প্রত্যাশা করছে তরুণ সমাজ। কিন্তু তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীরা দখলবাজি, চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। কেন্দ্র থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন কমিটিতে অনুপ্রবেশকারীদের আধিপত্য দলটিকে নতুন করে চাপে ফেলেছে। এতে অবমূল্যায়িত হচ্ছেন ত্যাগী নেতাকর্মীরা।
সম্প্রতি দুই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে, নির্বাচনি প্রশাসনের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ এনেছে ছাত্রদল। এ বিষয়টিও বিএনপির মাথাব্যথার কারণ। তারা মনে করছে, প্রশাসনের একটি অংশ বিএনপির প্রতি বৈরী আচরণ করছে।
ডাকসুতে যে কারণে ছাত্রদলের ভারাডুবি
পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকা, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব এবং প্রচারণা কৌশল কী হবে, তা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ছাত্রদলের মধ্যে সঠিক সমন্বয় দেখা যায়নি। ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন নিয়ে সঠিক প্রস্তুতি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষস্থানীয় দুজন নেতা। প্রচারের ক্ষেত্রেও ছাত্রদল কোনো চমক দেখাতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্রদল যেভাবে প্রচার চালিয়েছে, তা শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। অন্যদিকে হলগুলোয় ছাত্রদলের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্তিশালী নয়। গত এক বছরে ক্যাম্পাসে নতুন কর্মীও সেভাবে তৈরি হয়নি, নেতৃত্বের সংকটও ছিল। এর ফলে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদলের সম্পর্ক সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
অন্যদিকে হল কমিটি ঘোষণার পর উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে ‘মব’ সৃষ্টির চেষ্টা হয়। আবার সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রদল সম্পর্কে ক্রমাগত অপপ্রচার চালিয়েছে একটি পক্ষ। ছাত্রদল ডাকসুতে জিতলে বা ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ছাত্রলীগের (এখন নিষিদ্ধ) মতোই আবাসিক হলগুলোয় গণরুম-গেস্টরুম ‘সংস্কৃতি’ ফিরে আসবে, জোর করে শিক্ষার্থীদের মিছিলে নিয়ে যাওয়া হবেÑ এমন অপপ্রচার ছিল। এসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি ছাত্র দল।
এ ছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় খুন, চাঁদাবাজি, লুটপাট, মারামারি, দখলসহ বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনায় বিএনপির অনেক নেতাকর্মীদের নাম এসেছে। তবে অনিয়মের বেশ কিছু ঘটনায় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। কিন্তু বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কিছুটা হলেও প্রভাব ডাকসু নির্বাচনে পড়েছে, এমন আলোচনাও ক্যাম্পাসে আছে।
এদিকে জাতীয় নির্বাচন ঘিরেও বিএনপির ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে চলছে জামায়াত, এনসিপি ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলো। বিশেষ করে পিআর পদ্ধতি নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে নেমেছে দলগুলো। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে এসব দলের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপির নেতারা প্রায়শই বিএনপির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন। এ ছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়েও অন্য দলের সঙ্গে মতপার্থক্য রয়েছে বিএনপির।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা আশঙ্কা করছেন, জাতীয় নির্বাচনকে বানচাল করতে ষড়যন্ত্র করছে একটি মহল। সে কারণেই পিআর ইস্যুটি সামনে আনা হয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সংস্কার প্রস্তাবের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে শর্ত দিয়ে জামায়াত, এনসিপি বিএনপির পাল্টা বা বিপরীত অবস্থান নিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য, বিভক্তি বাড়ছে। জামায়াত ও এনসিপির নেতারা বলছেন, সংস্কার ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের বিষয় পাশ কাটিয়ে একটি ‘সাজানো’ নির্বাচন করা হচ্ছে।
নির্বাচনের সময় নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও এনসিপির মতপার্থক্য ছিল শুরু থেকেই। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন দাবি করে আসছিল। জামায়াত, এনসিপি নির্বাচনের আগেই সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের শর্ত বা দাবি তুলেছে। এমনকি জাতীয় সংসদের চলমান নির্বাচনের পদ্ধতি পাল্টিয়ে ভোটের আনুপাতিক হার বা পিআর পদ্ধতি চালু করার দাবিকেও সামনে আনছে জামায়াত।
জামায়াত ও এনসিপির কমন দাবি হচ্ছে, সংবিধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই সনদ তৈরি করছে, সেই সনদ বাস্তবায়নের আইনগত ভিত্তি দিতে হবে এবং সনদ বাস্তবায়ন করে তার ভিত্তিতে নির্বাচনে যেতে হবে। এখানে বিএনপির অবস্থান কিন্তু ভিন্ন। তারা চায়, নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয়গুলো ছাড়া সংবিধানসহ অন্য বিষয়ে সংস্কার নির্বাচিত সংসদ করবে।
উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ, সংসদের উভয়কক্ষে ভোটের আনুপাতিক হার বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিকে আবারও জোরালোভাবে সামনে এনেছে জামায়াত। এসব দাবিতে তাদের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনসহ ইসলামপন্থি বিভিন্ন দলও রয়েছে। এ দলগুলো রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়ার কথাও বলছে।
জামায়াত, এনসিপি নির্বাচন বর্জন করলে সেই ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে না। এতে নির্বাচন প্রশ্নবদ্ধি হবে এবং তা বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
কেকে/ আরআই