বগুড়ার দই। নামের ভিতরেই যেন লুকিয়ে আছে শত বছরের ঐতিহ্য। বগুড়াকে অনেকেই দইয়ের রাজধানী বলে থাকেন। মূলত বগুড়ার শেরপুরই হলো ঐতিহ্যবাহী দইয়ের আদি নিবাস। বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে ভোজনবিলাসীদের খাবারের স্বাদ অপূর্ণ থেকে যায় শেরপুরের দই ব্যতীত। সামাজিক প্রীতি ভোজের শেষ পাতে দই না হলে যেন চলেই না।
এদিকে নতুন করে মাইলফলক সৃষ্টি হলো প্রায় ২৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী বগুড়ার দইয়ে। বিখ্যাত এই সরার দই অর্জন করেছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি। এর ফলে নতুন সম্ভাবনার আলো দেখছেন জেলার দই ব্যবসায়ীরা।
তবে গন্তব্যের শেষ এখানেই নয়। বিশ্ববাজারের বগুড়ার দই উপস্থাপন করতে প্রয়োজন আন্তর্জাতিকমানের বিমানবন্দর ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল। বিষয়টি নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন হলেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়তে পারে বগুড়ার দইয়ের স্বাদ।
গত ২৬ জুন এক সভায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) যাচাই-বাছাই শেষে বগুড়ার দইকে জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদন দেয়।
জানা যায়, প্রায় ২৫০ বছর আগে শেরপুর উপজেলা থেকে বগুড়ার দইয়ের ইতিহাস শুরু হয়। তৎকালীন বগুড়ার শেরপুরের ঘোষ পরিবারের ঘেটু ঘোষ প্রথম দই তৈরি শুরু করেন। তবে স্বাধীনতার পূর্বে শেরপুরে নীলকন্ঠ ঘোষ, নারায়ন ঘোষ, আনন্দ ঘোষ, সদানন্দ ঘোষ অর্থাৎ ঘোষ পরিবারের সদস্যদের হাতে প্রথমে সরার দইয়ের প্রচলন শুরু হয়। প্রায় ১৫০ বছর আগে তার হাতেই সরার দই প্রসার লাভ করে শেরপুরে নীলকন্ঠ ঘোষের মাধ্যমে। একসময় টক দইয়ের প্রচলন ছিল বেশী। তবে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আস্তে আস্তে হিন্দু এবং মুসলমান পরিবারের অনেকে এই পেশায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তী শেরপুরের সাউদিয়া, জলযোগ, বৈকালী, সম্পা, চৈতি, ঊষা, লোকনাথ প্রভৃতি নামে দইয়ের দোকানের প্রসার লাভ ঘটে।
টক দই তৈরি থেকে বংশ পরম্পরায় তা চিনিপাতা বা মিষ্টি দইয়ে রূপান্তরিত হয়। ২৫০ বছর আগে দইয়ের ঐতিহ্য দেশের গন্ডি পেরিয়ে স্থান দখল করেছে বিশ্বেজুড়ে। এভাবেই আস্তে আস্তে বগুড়ায় প্রসার লাভ ঘটে দইয়ের বিস্তৃত বাজার। স্থানীয়ভাবে যে প্যাকেট দই দেওয়া হয়, তা শীতকালে ৪-৫ দিন, আর গরম কালে ২-৩ দিন ঠিক থাকে।
দইয়ের ক্ষেত্রে আর এই বিশ্বখ্যাতি অর্জনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে বগুড়ার শেরপুরের দইয়ের কারিগরেরা। সেই সাথে দইয়ের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি একচেটিয়া ব্যবসায়ও পরিচালনা করছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।
মূলত দুই ধরনের দই তৈরি হয় বগুড়ার শেরপুরে। টক দই আর মিষ্টি দই। কোন প্রকার চিনি ছাড়া যে দই, তাকে বলা হয় টক দই। প্রথম দিকে উপজেলার বিভিন্ন দই কারখানাতে টক দই তৈরি হলেও স্বাদের বৈচিত্র্য ও ভিন্নতার কারণে টক দইয়ের পাশাপাশি মিষ্টি দই এখন পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী শেরপুরে প্রায় দুই শতাধিক দইয়ের কারখানা বিদ্যমান। এসব কারখানায় কাজ করেন প্রায় আড়াই হাজারের বেশি কর্মচারী। দই বিক্রয় কেন্দ্রের কর্মচারীসহ প্রায় ৫ হাজার জনশক্তি প্রত্যক্ষভাবে দই তৈরি ও বিক্রির কাজে সম্পৃক্ত।
শেরপুর উপজেলায় প্রতি দিন প্রায় ৩৫০-৪০০ মণ দই উৎপাদনের সাথে খিরসা ও মিষ্টিসহ মাসে ২০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক লেনদেন হয়। সরাসরি দই বিক্রয় কেন্দ্রের পাশাপাশি উপজেলার বহু তরুণ উদ্যোক্তা অনলাইনেও দই বিক্রি করে থাকেন।
শেরপুরের দই ব্যবসায়ী পার্থ সারথী সাহা বলেন, ‘শেরপুরের দই দেশ খ্যাত। আমরা চেষ্টা করছি, আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করে ব্যবসায় পরিচালনা করার জন্য। দুধের দাম উঠানামা করার জন্য এবং অন্যান্য সামগ্রীর দাম অতিরিক্ত হওয়াতে বর্তমানে দইয়ের দামও বেড়েছে। তবে আসল স্বাদের দই খেতে হলে শেরপুরের কোনো বিকল্প নেই।’
দই কিনতে আসা টাঙ্গাইল জেলার অধিবাসী ইসমাইল হোসেন জানান, বগুড়ার শেরপুরে সবচেয়ে ভালো দই পাওয়া যায়। অতুলনীয় দইয়ের স্বাদ প্রায় সময়ই আমাদের বগুড়ার শেরপুরে টেনে আনে। দইয়ের সাথে বর্তমানে আমি ও আমার পরিবারের একটা ভালোলাগা ও ভালোবাসার সৃষ্টি হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে শেরপুরের দই অতুলনীয়।
কেকে/ এমএ