বর্তমান সময়ে প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের পন্য সস্তা দামের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার ঐতিহ্য মৃৎশিল্প। কারণ প্লাস্টিক ও মেলামাইনের ব্যবহার বেশি—যা সস্তা ও টেকসই। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি জিনিসের চাহিদা কমে গেছে এবং এর সঙ্গে জড়িত শিল্পীদের আয়ও কমে গেছে।
ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন মৃৎশিল্প বা পালপাড়া খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত সময়ে কয়েক হাজার পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল।
কিন্তু যাদের কর্মের মাধ্যমে এই শিল্পের বিভিন্ন সামগ্রী পার্শ্ববর্তী জেলা উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হতো। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আগের মতো এ শিল্পের কদর না থাকায় অনেকে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িত পড়ছে। কিন্তু এ পেশায় জড়িত রয়েছে হাতেগোনা মাত্র । এ পরিবারগুলোর মানুষ সারা বছর মাটির হাঁড়ি-পাতিল, ঢাকনা, কলসি, ফুলের টবসহ নানা উপকরণ তৈরি করে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করছেন—ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলেই দেখা যাবে। কিন্তু কালের আবর্তে আজ তা বিলীন হতে চলেছে। হয়তো এমন দিন আসবে, যেদিন বাস্তবে এ পেশার অস্তিত্ব থাকবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মৃৎশিল্পি জানান, “যতই দিন যাচ্ছে ততই এই শিল্পের কদর কমে যাচ্ছে। একসময় দিন-রাত মাটির জিনিস তৈরি করেও ক্রেতার চাহিদা মিটানো যেত না। আর এখন সারা দিনের বিক্রি দিয়ে পরিবার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বয়স হয়ে যাওয়ায় অন্য কোনো পেশায় কাজ করার ক্ষমতা নেই তাদের। তাই পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এই পেশা এখনো ধরে রেখেছেন তারা।”
মৃৎশিল্পি প্রদীপ পাল খোলা কাগজকে জানান, “মাটির তৈরি জীনসপত্র বেচাকিনা বন্ধ হয়ে গেছে। দস্তা, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের তৈজসপত্র বের হওয়ায় মাটির তৈজসপত্র আর চলে না। মাটির তৈজসপত্র আগে ভালোই চলতো। সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজ করতাম। সারাদিন কাজ করতাম, হাট-বাজারে যেতাম দুই-চার হাজার টাকা বিকিকিনি করতাম। এখন আর আগের মতো বেচাকিনা নেই। দস্তা, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের তৈজসপত্র হয়ে মাটির তৈজসপত্র প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। দধির পাতিল আর টয়লেটের পাট এখন একটু চলে। দধির পাতিল ও টয়লেটের পাট যদি বন্ধ হয় আমরা কেমনে চলব? আমাদের সংসার চালানো কষ্ট হয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে মৃৎশিল্পিরা অন্য পেশায় চলে গেছে।”
এছাড়া অন্য মৃৎশিল্পিরা জানান, প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসপত্র বের হওয়ার কারণে মাটির তৈরি জিনিসপত্র এখন আর আগের মতো চলে না। দীর্ঘ এক বছর ধরে কোনো ধরনের মেলা বা সামাজিক অনুষ্ঠান না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন এই মৃৎশিল্পীরা। আগে তেমন একটা প্লাস্টিক এবং অ্যালুমিনিয়াম জাতীয় পণ্য বাজারে না থাকায় মাটির তৈরি কলসি, হাঁড়ি, পাতিল, সরা, মটকা, ফুলের টপসহ নানা সামগ্রী বেশি বেশি বিক্রি হতো। কিন্তু এখন প্লাস্টিক-অ্যালুমিনিয়াম জাতীয় পণ্যে বাজারে সয়লাব এবং তার দাম কম থাকায় প্রতি ঘরে ঘরে এসব সামগ্রীর ব্যবহার বেড়ে গেছে। যার কারণে মাটির তৈরি তৈজসপত্র এখন তেমন একটা বিক্রি হয় না। ফলে মৃৎশিল্পিরা পরিবার নিয়ে আর্থিক সঙ্কটে দিন কাটচ্ছেন।
ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার ময়না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কালিপদ চক্র বর্ত্তী বলেন, “মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করে মাটির জিনিসপত্রের প্রয়োজনীয়তা জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা দরকার। তা না হলে মৃৎশিল্পিদের স্থান হবে শুধুই বইয়ের পাতায়।”
কেকে/এজে