মৌলভীবাজার জেলার হাওর, বিল, ডোবা ও চা বাগানের লেকে এখন লাল ও সাদা শাপলার অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার জুমাপুর গ্রাম, শ্রমিঙ্গল উপজেলার ভৈরবগঞ্জের মাজদিহি চা বাগান, কমলগঞ্জের দেওরাছড়া চা-বাগানের বাবন বিল, রাজনগরের কাওয়াদীঘি হাওর ও জুড়ী উপজেলার ভূঁয়াই এলাকার প্রায় ১০০ বিঘা জমি লাল-সাদা শাপলায় রঙিন হয়ে উঠেছে।
দূর থেকে ফুটন্ত শাপলার রঙ এবং কাছ থেকে জাতীয় ফুলের সৌন্দর্য দর্শকদের মুগ্ধ করছে। ভোরের রোদে জলরাশিতে দুলে ওঠা শাপলার ফুল-কর্ম, ভেসে বেড়ানো হাঁসের সঙ্গে মিলিয়ে প্রকৃতির এক অপরূপ নকশিকাঁথার দৃশ্য তৈরি করছে। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা বিলের ধারে ভিড় করছেন। ভোরের সূর্যের আলোয় ঝলমলে পানির বুক ভরে ওঠে লাল-সাদা শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে উপজেলার গন্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে বিলের ধারে ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরা।
বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) ভোরে চায়ের রাজ্যখ্যাত শ্রীমঙ্গলের মাজদিহি চা বাগানের লেকে গিয়ে দেখা গেছে, এখানকার একটি লেকে লাল শাপলা সংসার সাজিয়েছে। ঝাড় বেঁধে ফুটেছে ফুল-কন্যারা। দেখে মনে হয় লাল শাপলার গালিচা। সূর্যের আভাকেও যেন হার মানিয়েছে- এ বিলে ফোটা লতাপাতা গুল্মসহ শাপলা। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছেন দর্শনার্থীরা।
একই চিত্র মৌলভীবাজারের দেওরাছড়া চা-বাগানের বাবন বিলে। যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল শাপলা ঘোমটা খুলে ফুটে আছে। তারা হাসছে, তারা দুলছে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার হাওরপারের জুমাপুর গ্রামের একাধিক বিল ও ডোবায় লাল শাপলায় ভরে আছে। এখানে নির্লিপ্ত শান্তি ছড়িয়ে আছে লাল শাপলারা ডোবায়-বিলে।
মাজদিহী চা বাগানের লেকে গিয়ে দেখা হয় স্থানীয় মুস্তাকিম আল মুনতাজের সঙ্গে। তিনি জানান, রাতের বেলায় শাপলা ফুটে, ফুল পাপড়ি মেলে। সকালবেলা ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল দেখেন তারা। এই ফুল দেখতে খুব সুন্দর লাগে। রোদ বাড়তে থাকলে ধীরে ধীরে ফুলগুলো পাপড়ি বুঁজতে শুরু করে। দুপুরবেলা যেন তারা ঘোমটা টেনে ঘুমিয়ে পড়ে। জুমাপুর গ্রামের বিলে ফখরুল ইসলাম নামে এক দর্শনার্থীর সাথে দেখা হয়।
মুস্তাকিম জানান, পরিবার নিয়ে এখানে ঘুরতে এসেছেন। লাল শাপলার খবর পেয়ে তিনি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে দুই নয়নভরে দেখতে এসছেন এবং মুগ্ধতা নিয়েই বাড়ি ফিরছেন।
স্থানীয়রা জানান, ওই জুমাপুর গ্রামে কাছাকাছি আরেকটি ডোবা আছে। সেখানেও প্রচুর লাল শাপলা ফুটেছে। এলাকাজুড়ে লাল শাপলার বিল, যা মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে।
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, ‘কিছু দিন আগেও এখানে হাওরের পানি ছিল। সেই পানি এখন অনেকটা নিচে নেমে গেছে। এখানে জমির নরম মাটিতে শিকড় ছড়িয়ে শাপলারা ফুটেছে। মাস দুইয়েক ধরে জুমাপুরের মাঠের কয়েকটি বিলক্ষেতে লাল শাপলা ফুটে লাল হয়ে আছে।’
এলাকার বাসিন্দারা বলেন, ‘ওই এলাকার মাঠ-বি ডোবাজুড়েই লাল শাপলার ছড়াছড়ি। ভোরবেলা হেমন্তের রোদে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠে লাল শাপলার মায়াবী মুগ্ধতা।’
জুড়ী উপজেলার ভূঁয়াই এলাকার প্রায় ১০০ বিঘা জমিজুড়ে বিস্তৃত লাল-সাদা শাপলায় শোভা ছড়াচ্ছে এলাকাজুড়ে। মৌলভীবাজার-বড়লেখা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে উপজেলা সদর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে চোখে পড়ে এই শাপলার সমারোহ। স্থানীয়রা একে ডাকছেন শাপলার রাজ্য। ওই সড়কের পশ্চিম পাশে এগোতেই চোখে পড়ে লাল শাপলার সমারোহ, মাঝেমধ্যে ফুটে থাকা সাদা শাপলার ঝলক যেন দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এই জমিগুলো এক ফসলি। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বোরো ধান কেটে নেওয়ার পর বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাকালুকি হাওরের পানি ঢুকে পড়ে। তখন পানির সঙ্গে ভেসে আসা কন্দ থেকে জন্ম নেয় শাপলা, যা ধীরে ধীরে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক বছর ধরে এখানে শাপলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তবে অগ্রহায়ণ মাসের শেষে পানি শুকিয়ে গেলে কৃষকরা আবার ধান রোপণ করেন। তখন শাপলার এই সৌন্দর্য আর থাকে না।
কৃষক রণজিত দাস বলেন, ‘প্রতিদিনই এখানে মানুষ ঘুরতে আসেন। অনেকে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন বা ফেসবুকে লাইভ করেন। তবে নৌকার ব্যবস্থা না থাকায় ভেতরে ঢুকে কাছ থেকে শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন না।’
জায়ফরনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রতীশ চন্দ্র দাস বলেন, ‘প্রতিদিন যাতায়াতের পথে অনেকেই মোটরসাইকেল বা প্রাইভেট গাড়ি থামিয়ে কিছু সময় দাঁড়িয়ে শাপলার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেন। যদি চারদিকে বাঁধ দিয়ে কিছু জায়গায় পানি আটকে রাখা যায়, তবে সারা বছর শাপলা ফোটা সম্ভব হতো। এতে জায়গাটি মৌসুমে একটি পর্যটনকেন্দ্রে রূপ নিতে পারত। প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম শাপলার রাজ্য স্থানীয়দের কাছে পর্যটনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। যথাযথ উদ্যোগ নিলে একদিন এই বিলটি হয়ে পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
জেলার স্থানীয়রা বলছেন, ‘প্রতি বছরই জেলার বিভিন্ন চা বাগানের লেকসহ হাওর-বিলও ডোবায় প্রাকৃতিকভাবেই ফোটা শাপলার অবারিত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছেন দর্শনার্থীরা। শাপলার এই মৌসুমিক সৌন্দর্য স্থানীয় পর্যটনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে।
স্থানীয়রা আশা করছেন, সঠিক উদ্যোগের মাধ্যমে এই মৌসুমে হাওর-বিল ওলেকটি পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।
কেকে/এমএ