গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর পর আবারো মাঠে ফেরার পথ খুঁজছে আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কর্মী-সমর্থকরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে নিজেদের পুনর্বাসনের চেষ্টাও চলছে। দেশ ও বিদেশের মাটিতে সভা-সমাবেশ ও ঝটিকা মিছিলসহ নানা কর্মসূচিতে সরব হচ্ছে দলটি।
এসব সভা-সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হচ্ছেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। মাঠে ফিরতে বেশ কৌশলে এগোনোর নির্দেশনাও দিচ্ছেন তিনি। রাজনৈতিক মাঠে দলের শক্তি বাড়াতে এবং নিজেদের অবস্থান জানান দিতে নেতাকর্মীদের সক্রিয় করার জন্য শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বহিষ্কৃত নেতাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ বহিষ্কৃত নেতাদের দলে ফিরিয়ে রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে মাঠের আন্দোলন এবং নানা কর্মসূচিতে যাতে সব নেতাকর্মী অংশ নিতে পারে সেই কারণেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট এবং গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমসহ প্রভাবশালী নেতাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শক্তির জানান দেওয়াও অন্যতম লক্ষ্য বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত ও লগি-বৈঠার আন্দোলন সফল করতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের মতো প্রভাবশালী ও সমালোচিত নেতাসহ বহিষ্কৃতদের ক্ষমা করা হয়েছে। তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে গতকাল মঙ্গলবার প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি কর্তৃক পরিচালিত অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশ করা হয়।
এর আগে গাজীপুরের সাবেক মেয়র ও মহানগর শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমসহ সব বহিষ্কৃত নেতাদের ক্ষমা করা হয়।
জানা গেছে, এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে দলকে সংগঠিত করে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করছে দলটি। শক্তি সঞ্চয় করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করছে। মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ, খুব দ্রুতই ফিরবেন শেখ হাসিনাÑ এমন তথ্য প্রচার করছে। সূত্র বলছে, ৭ ডিসেম্বরই হবে ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন। এর আগে নভেম্বরেও নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে। সম্পতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি লিখেছে ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। সেখানে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানানো হয়েছে। বিষয়টি আওয়ামী লীগের কৌশলের অংশ হিসেবে মনে করছে অনেকে।
মোটাদাগে বর্তমানে সুসংগঠিত হয়েই সামনে এগোতে চাচ্ছে আওয়ামী লীগ। অন্তর্বর্তী সরকার ও ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করার পাশাপাশি নির্বাচন ঠেকাতে নানা পরিকল্পনাও রয়েছে। বাইরের শক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করে দেশের ভেতরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করা। এ ছাড়াও দলের কেন্দ্র থেকে ভারসাম্য বজায় রেখে ফের সাংগঠনিক কাঠামো গোছাতে মনোযোগ দেওয়া।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের শীর্ষ এক নেতা বলেন, ‘বহিষ্কৃত নেতাদের ক্ষমা করে ফিরিয়ে দলের শক্তি বাড়ানো হয়েছে। যা বর্তমানে দলের জন্য খুবই দরকার। কেউ এসে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে, এটা আমরা বিশ্বাস করি না। আমাদের কাজ আমাদেরকেই করতে হবে। আমাদের ভুল বোঝাবুঝি, মান-অভিমান দূর করতে হবে।’
সূত্র বলছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কত নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে তার সঠিক তথ্য নেই দলটির কাছে। আবার বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় নেতা দেশ ছাড়া। দেশে যারা আছেন, তারাও আত্মগোপনে। তৃণমূল থেকেও ব্যক্তি-উদ্যোগে কিছু করা সম্ভব না। এ অবস্থায় সাংগঠনিক কাঠামো কিভাবে আবারও গোছানো যায় সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছে দলটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের এখন যা করার, তা না করে গতানুগতিক রাজনীতির ধারায় চলছে। সত্যিটা মেনে নিয়ে দলকে নতুন উদ্যমে পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়। বহিষ্কৃতদের ফিরিয়ে কতটুকু সফল হবে তারা, এটা বুঝা মুশকিল। কারণ মাঠে তো বাধাও থাকবে। তবে শেখ হাসিনা যদি দূরদর্শী হতেন, তাহলে তার সরকারের ব্যর্থতার নেপথ্যে যারা ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করে নতুন নির্দেশনা দিতেন। ভারতে বসে যুদ্ধ হবে না। নিজের হাঁটুর জোর না থাকলে অন্যের জোরে কাজ হবে না।
তবে আওয়ামী লীগের অপশক্তি মোকাবিলা করার সক্ষমতা রয়েছে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে ট্রাফিক সচেতনতা নিয়ে এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন ঘিরে যে কোনো অপশক্তি মোকাবিলা করতে সক্ষম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার এস এম সাজ্জাত আলী। তিনি বলেন, নির্বাচন ঘিরে যে কোনো অপশক্তি মোকাবিলা করার সক্ষমতা রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগের যেসব মিছিল হচ্ছে সেই প্রসঙ্গে ডিএমপি কমিশনার বলেন, গুপ্তভাবে অনলাইনের মাধ্যমে একত্রিত হয়ে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠন যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার চেষ্টা করবে তার বিরুদ্ধে তৎপর রয়েছে পুলিশ।
এদিকে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কার্যকারিতা প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের পর দেউলিয়া হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক আকার থাকা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ কার্যকারিতা বিঘ্নিত হয়েছে।’ গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘জুলাইয়ে আলোচনার সময় কেবল হাসিনার পতনই নয়, বরং রাজনীতির নির্দিষ্ট পরিভাষা দাবি করা হয়েছিল। হাসিনার পতন ও ব্যবস্থার বিলুপ্তি এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবির ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল।’
কেকে/এজে