অর্থনীতিতে স্থবিরতা কাটিয়ে বিনিয়োগ, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের গতি ফেরানো এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অপচয় ও দুর্নীতি, বিনিয়োগে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব এবং মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস- সব মিলিয়ে অর্থনীতি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা না গেলে সাধারণ মানুষের জীবনে চাপ আরো বাড়বে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা না গেলে কর্মসংস্থান হবে না, এতে অস্থিরতা বাড়বে। এমন প্রেক্ষাপটে আসন্ন সরকারের সামনে বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়া ও নতুন প্রবৃদ্ধি মডেল প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা।
সোমবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত ইকোনমিক রিফর্ম সামিটে বক্তারা এসব কথা বলেন। তাদের মতে, রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা ও নীতিগত সংস্কার ছাড়া কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক রূপান্তর সম্ভব নয়।
আগামীতে সরকার গঠন করতে পারলে বিএনপি অর্থনীতির নতুন মডেল তৈরি করবে বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সরকারের হাত থেকে নিয়ন্ত্রণের পরিমাণ কমিয়ে এনে বেসরকারি খাতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। আমলাতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করবে না, জবাবদিহিরও কিছু নেই। বরং আমলাদের দায়িত্ব কমিয়ে আনা হবে। নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব আমলাতন্ত্র নয়, নীতিনির্ধারকদের হাতেই থাকবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি কমিয়ে কাজের গতি ফিরিয়ে আনতে এই উদ্যোগ নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করা হবে। এ বিভাগ তৈরি করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে। এর উদ্দেশ্য ছিল এমডি নিয়োগ ও পর্ষদে পছন্দের লোক বসিয়ে লুটপাট করা। বিএনপি আগেরবার ক্ষমতায় এসে এটি তুলে দিয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা এটি আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আবার এটি বিলুপ্ত করবে। আর্থিক খাতে সংস্কার করা ও শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। শুধু স্বায়ত্তশাসন যথেষ্ট নয়, পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। এ ছাড়া বিনিয়োগ বাড়াতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সংস্কার করা হবে।
তিনি বলেন, ৩১ দফা বিএনপির প্রতিশ্রুতি। কেউ ঐকমত্য হোক বা না হোক বিএনপি বাস্তবায়ন করবে। নির্বাচনি জোটের শরিকদের পছন্দমতো প্রতীকে ভোট করতে দেওয়া উচিত। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না।
তিনি বলেন, নীতি প্রণয়ন আমলাদের কাজ না। যারা সংশ্লিষ্ট তাদের দিয়ে করতে হবে। মূল অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় নতুন অর্থনৈতিক মডেল প্রস্তুত করতে হবে। সবার অংশগ্রহণ থাকতে হবে। সবার সুযোগ থাকতে হবে। গণতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বিএনপি। ক্ষমতায় গেলে অর্থনীতির নতুন মডেল করবে বিএনপি। তৃণমূলের অর্থনীতির কারিগরদের ওপর বিনিয়োগ করতে হবে।
বড় প্রকল্পে অর্থায়ন কোনো ব্যাংকের কাজ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুঁজিবাজার থেকে বড় ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে পুঁজি তুলতে হবে। তাহলে ব্যাংকের ওপর চাপ কমবে। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) নিজের পছন্দের লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ইচ্ছামতো টাকা লুটপাটের জন্য। যার কারণে অর্থনীতি কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পৌঁছতে পারেনি।
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনায় জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, ‘আমরা বর্তমানে তীব্র জ্বালানি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। গত ১৫ বছরে নিজস্ব জ্বালানি উৎস কাজে লাগাতে বিনিয়োগ হয়নি, বরং বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপনে। গত ১৫ বছরে প্রায় ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে, কেননা, এখানেই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির সুযোগ ছিল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, অতীত সরকারের প্রবৃদ্ধির মডেলে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। তাদের তথাকথিত অর্থনৈতিক অলৌকিকতার গল্পের আড়ালে লুকিয়ে ছিল কঠিন বাস্তবতা। আজ সেই বাস্তবতা প্রকাশ্যে এসেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, দারিদ্র্য বেড়েছে। ইতোমধ্যে বলা হচ্ছে, আরো ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে। ১৩ লাখ তরুণ-তরুণী বেকার। স্নাতক পর্যায়ে প্রতি তিনজনের একজন কর্মহীন।
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে। হয় আমরা এই স্থবিরতা মেনে নেব, না হয় অভূতপূর্ব সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাব। সে জন্য প্রয়োজন নতুন অর্থনৈতিক মডেল।’
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে পিছিয়ে আছে। দেশে জাতীয় বিনিয়োগনীতি নেই। ফলে বিদেশি ও স্থানীয় বিনিয়োগের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য ও পরিকল্পনা নেই। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে একটি পদ্ধতিগত বিনিয়োগ উন্নয়ন কৌশল থাকা উচিত- জাতীয় বাণিজ্য, রপ্তানি ও আমদানি নীতির সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে এটি।
বিনিয়োগনীতি ছাড়া বিডা ও বেজাকে বিনিয়োগ আনতে চাপ প্রয়োগ করা ‘অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো’ জানিয়ে তিনি বলেন, বিনিয়োগ প্রচারের কৌশল নেই। পাঁচ বছরের জন্য যদি বিনিয়োগনীতি করা হয় সেটিকে জাতীয় বাণিজ্য কৌশলনীতির সঙ্গে সমন্বিত করতে হবে। যদিও বাংলাদেশের কোনো বাণিজ্যিক কৌশল নীতিমালাও নেই।
প্রথাগত ব্যবসায় বিনিয়োগ করার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে এসে তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি কিংবা ফিনটেকে বিনিয়োগের আহ্বান জানান ড. মনজুর হোসেন।
কেকে/এআর