দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় সাড়ে ১৪ মাস অতিবাহিত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত এ সরকার কতটা প্রত্যাশা পূরণ করেছে? এ বিষয়ে হতাশাই প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক, নারী অধিকার কর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব নেওয়ার পর ভাষণে বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমাদের সব উপদেষ্টা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করবেন। পর্যায়ক্রমে এটি সব সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও নিয়মিত ও বাধ্যতামূলক করা হবে।’
কিন্তু ১৪ মাস পার হলেও উপদেষ্টারা সম্পদের হিসাব দেননি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিষয়টি নিয়ে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘ঘটনাটা অনেকটা শেখ হাসিনার মতো হলো। কারণ, উনিও উনার নির্বাচনি ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, উনার পুরো যে মন্ত্রিপরিষদ হবে, তাদের তথ্য দেবেন বিত্ত-বৈভব ও আয়ের ব্যাপারে এবং উনি সেটা রক্ষা করেননি। অনেক প্রত্যাশা ছিল যে, বর্তমান সরকার একটা নতুন নজির স্থাপন করবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেটাও হয়নি।’
তবে প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহমেদ বলেছেন, ‘আমি যতদূর জানি অনেক উপদেষ্টাই সম্পদের হিসাব প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছেন। এ সংখ্যাটা অধিকাংশই। তবে এ মুহূর্তে নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। এখনো তো সময় আছে, প্রধান উপদেষ্টা যেহেতু কথা দিয়েছেন, ফলে উনি এটা করবেন।’
অভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। নির্বাচনের সময় এগিয়ে এলেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হয়েছে? থামানো গেছে ‘মবসন্ত্রাস’?
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্বেগ থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হয় পরিস্থিতি অতটা উদ্বেগজনক নয়। গত ১৪ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে অপরাধসংক্রান্ত কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে এমন দাবি করা হয়। সেখানে বলা হয়, গত ১০ মাসে (২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত) দেশে ডাকাতি হয়েছে ৬১০টি, দস্যুতা ১ হাজার ৫২৬টি, খুন ৩ হাজার ৫৫৪টি, দাঙ্গা ৯৭টি, ধর্ষণ ৪ হাজার ১০৫টি, এসিড নিক্ষেপ ৫টি, নারী ও শিশু নির্যাতন ১২ হাজার ৭২৬টি, অপহরণ ৮১৯টি, সিঁধেল চুরি ২ হাজার ৩০৪টি, চুরি ৭ হাজার ৩১০টি এবং এ সময় রুজুকৃত মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯৫৫টি। পরিসংখ্যান পুলিশ সদর দপ্তরকে ‘উদ্ধৃত’ করে আরো বলা হয়, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৭টি, খুন হয়েছে ১ হাজার ৯৩৩টি এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৭৪৪টি, এ ছাড়া নারী নির্যাতন ৬ হাজার ১৪৪টি এবং শিশু নির্যাতন হয়েছে ২ হাজার ১৫৯টি।
সেই ফেসবুক পোস্টে আরো দাবি করা হয়, ২০২৪ সালে সারা দেশে ডাকাতি হয়েছিল ৪৯০টি, খুন ৪ হাজার ১১৪টি, ধর্ষণ ৪ হাজার ৩৯৪টি, নারী নির্যাতন ১০ হাজার ১৯৮টি এবং শিশু নির্যাতন ২ হাজার ৯৬৪টি। এসব পরিসংখ্যান দিয়ে ‘গত ১০ মাসে গুরুতর অপরাধের প্রবণতা স্থিতিশীল রয়েছে’ বলেও সেখানে দাবি করা হয়। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পর পুলিশের সার্বিক পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য সংরক্ষণে অনুকূল ছিল কিনা সে বিষয়ে বিশ্লেষকদের সন্দেহ রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার কতটা সফল- এমন এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলার যতটা উন্নতি হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি। পুলিশের মনোবল ফেরাতে ঊর্ধ্বতনদের যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল, সেটা নেওয়া হয়নি। আমি মনে করি, একটা নির্বাচিত সরকার এলে ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’
আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে আসিফ মাহমুদ : স্থানীয় সরকার ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ঘুরে-ফিরে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনায় থাকছেন। তার এপিএসের দুর্নীতি, কিছু অডিও রেকর্ড বাইরে চলে আসায় বিতর্কে জড়ান তিনি। বিমানবন্দরে অস্ত্রের গুলি নিয়ে প্রবেশ বা গভীর রাতে ৩০০ ফিটে হাঁসের মাংস খেতে যাওয়া নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ট্রল হয়েছে। এমনকি নিজের মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বেশি টাকা এলাকার জন্য বরাদ্দ দেওয়া নিয়েও সমালোচিত হতে হয়েছে তাকে।
ক্রীড়াঙ্গনেও তিনি সব সময় আলোচনায় ছিলেন। ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি ফারুক আহমেদকে সরিয়ে দেওয়া, আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে দায়িত্ব দেওয়া এবং পরে নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে তাকে সভাপতি নির্বাচিত করার অভিযোগেও জড়িয়েছে এ তরুণ উপদেষ্টার নাম। সাবেক ক্রিকেটার তামিম ইকবাল ও বিভিন্ন ক্লাবের কর্মকর্তাদের বিসিবির এ নির্বাচন থেকে ‘বাইরে’ রাখা হয়।
পররাষ্ট্রনীতি ও ভিসা সংকট : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে তৌহিদ হোসেন দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে? বাংলাদেশ কি বন্ধু বাড়াতে পেরেছে? প্রধান উপদেষ্টার সফরগুলো থেকে কি বাংলাদেশের নতুন কোনো বন্ধুত্ব হয়েছে? নাকি বন্ধু দেশগুলোও তাদের দেশের ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে?
বাস্তবতা হলো, অনেক দেশই বাংলাদেশের পাসপোর্টে ভিসা বন্ধ রেখেছে। ভারত সীমিত পরিসরে মেডিকেল ভিসা দিলেও অন্য কোনো ভিসা দিচ্ছে না। ইউএই, উজবেকিস্তান, কাতার, ভিয়েতনাম, ওমান, কুয়েত, বাহারাইন বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের ভিসা দিচ্ছে না। থাইল্যান্ড কিছু ভিসা দিলেও অন্তত ৪৫ দিন সময় নিচ্ছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াও ভিসা দিচ্ছে খুব কম। অস্ট্রেলিয়া, জাপানও খুব কম ভিসা দিচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বহির্বিশ্ব কার্যত কতটা আস্থা রাখছে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দেশে তো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা আছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত যখন ভিসা বন্ধ করে দেয়, তখন সারা বিশ্বেই একটা খারাপ বার্তা যায়। অনেকেই মনে করেন, প্রতিবেশীরা যখন ভিসা বন্ধ করেছে, ফলে এর ভেতরে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু আছে। এ কারণে অনেকেই আমাদের ভিসার ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থান নিচ্ছে। পাশাপাশি বদনাম ছড়িয়ে পড়েছে- এখানে জঙ্গিবাদীদের বিস্তার শুরু হয়েছে। এটা ঠিক না হলেও বাইরে এমন একটি ধারণা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা নিয়ে বিভিন্ন দেশ চিন্তা করছে। এ সংকট উত্তরণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যথেষ্ট ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না।’
দ্রব্যমূল্য, ব্যবসা ও বিনিয়োগ : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। নতুন বিনিয়োগ আসেনি, চাকরি হারিয়েছেন বহু মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা কী ভাবছেন? কীভাবে টিকে আছে ব্যবসা? গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক ও ডেনিম এক্সপোর্ট লিমিটেডের পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘বিদেশে ক্রেতারা মূলত আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা এখনো অর্ডার করছেন, কিন্তু সেটা একেবারেই নগণ্য। তারা অপেক্ষা করছেন যে নির্বাচন হলে একটি নির্বাচিত সরকার আসবে, নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে তারা কাজ করতে চান। এই ১৪ মাসে নতুন কোনো বিনিয়োগ আসেনি, বরং অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে এবং চাকরি হারিয়েছেন বহু শ্রমিক।’
কেকে/এআর