কক্সবাজারের সমুদ্র এলাকাকে ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) এলাকা হিসাবে ঘোষণা করা হলেও সেখানে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। কেউ নিজস্ব অর্থায়নে আবার কেউবা বাহিনীর নামে বালিয়াড়ির ও তার পাশে বিশালাকার অট্টালিকা গড়ে তুলেছে। সেসব অট্টালিকায় কোনো রকম অভিযান পরিচালনা না করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করেছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। কিছুদিন আগে বালিয়াড়িতে ছোট ছোট ভ্রাম্যমাণ দোকান উচ্ছেদ করে স্থানীয়দের কাছ থেকে বেশ বাহবা পেলেও বহুতল ভবনে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে না। যার রহস্যময় কোনো কারণ রয়েছে বলে মনে করছে এলাকাবাসী।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক করিম উল্লাহ কলিম জানান, ইসিএ এলাকায় কোনো ধরনের স্থাপনা করা যাবে না। এটি আইন হিসাবে গণ্য হলেও এ আইন সবার জন্য প্রয়োগ হচ্ছে না। বাঁশ গাছের স্থাপনা যেমন ভাঙা হচ্ছে ঠিক তেমনি বালিয়াড়িতে অনেক অট্টালিকা রয়েছে তাদের উচ্ছেদ করা সময়ের দাবি।
সম্প্রতি কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে অভিযান পরিচালনা করে দুটি রেস্তোরাঁ গুঁড়িয়ে দিয়েছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)। গত বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে কলাতলীর বিচের উত্তরে অবস্থিত স্যান্ডি বিচ ইকো রিসোর্ট এবং সি-ল্যাম্প এ অভিযান চালানো হয়।
অভিযানে নেতৃত্বে দেওয়া কউকের সচিব ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সানজিদা বেগম বলেন, দুটি রেস্তোরাঁ ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে স্থাপনা তৈরি করেছে। তাদের সঠিক কাগজপত্র নিয়ে আসার জন্য নোটিস দেওয়া হয়েছিল। পর পর তিনটি নোটিসের কোনো উত্তর তারা দেয়নি।
তিনি বলেন, নোটিস তিনটি দেওয়ার পর আর কোনো সতর্ক করার প্রয়োজন পড়ে না। এর পরেও তাদের আরো সময় দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে যদি তারা সঠিক কাগজপত্র নিয়ে আসতে না পারে, তাহলে অবশিষ্ট অংশে আবার উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো হবে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, উচ্ছেদ চলাকালীন সময়ে দুটি রেস্তোরাঁর মালিক ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দাবি করে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে উচ্ছেদ করার অনুরোধ করেন। কিন্তু, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই সময় এসব দেখার সময় নেই বলে জানান। এর পরেও তারা জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে একদিন সময় প্রার্থনা করেন। কিন্তু, সেই সময় তাদের দেওয়া হয়নি।
এক ভিডিও বার্তায় স্যান্ডি বিচ রিসোর্টের মালিক আবদুর রহমান বলেন, ‘আমি বর্তমানে ওমরাহ হজ পালনে সৌদি আরবে রয়েছি। আমি ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে ব্যবসা পরিচালনা করছি। আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিনা নোটিসে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখানে অবশ্যই কারো ইন্ধন আছে। না হয়, আমি থাকা অবস্থায় কেন উচ্ছেদ করেনি? এছাড়া আমার স্থাপনা সম্পূর্ণ বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি। এগুলো কখনো ‘বিল্ডিং কোড’-এ পড়ে না। আমার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, আমার ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই বিচার আমি আল্লাহর ঘরে দিলাম। অভিযান চলাকালে প্রশাসন ও দুই পক্ষের মাঝে তুমুল কথা-কাটাকাটি হয়। তারা বারবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন, সময় দেওয়ার। প্রথমে স্যান্ডি বিচ রিসোর্টের বেশ কিছু অংশ ভেঙে দেওয়া হয়। পরে সি-ল্যান্ড ক্যাফের বেশিরভাগ অংশ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
সানজিদা বেগম বলেন, তাদের সতর্ক করার পরেও নোটিসের জবাব দেয়নি। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, ইমারত আইনে অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ করা সবাইকে নোটিস দেওয়া আছে। ধাপে ধাপে এসব স্থাপনায় অভিযান চালান হবে। অনেকেই সরকারি খাস জায়গা দখল করে ভবন নির্মাণ করেছে। খাস জায়গা হোক খতিয়ানভুক্ত জায়গা হোক, ইমারত আইনে কউক উচ্ছেদ চালাতে পারবেন।
এদিকে পর্যটন উন্নয়নের দোহাই দিয়ে কক্সবাজারকে ইট-পাথরের গিঞ্জি শহরে পরিণত করছে একদল অর্থলোভী। ভবনের পর ভবন করতে ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) আইনও অমান্য করা হচ্ছে। কক্সবাজার সৈকত থেকে উপরে ৩০০ মিটারে নতুন কোনো স্থাপনা নির্মাণে ২০১৮ সালে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ভবন তৈরিতে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) ও জেলা প্রশাসন এবং অন্য প্রতিষ্ঠানের সঠিক অনুমতিও তোয়াক্কা করছেন না অনেক লোভী ব্যবসায়ী।
সূত্রমতে, পরিবেশগত বিবেচনায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে টেকনাফ সমুদ্রসৈকতের ১০ হাজার ৪৬৫ হেক্টর এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য, নির্মল জলরাশি এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় সরকার ১৯৯৯ সালে এ এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। এ নির্দেশনা মতে, কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক থেকে টেকনাফের বদর মোকাম পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত, সৈকতের ঝাউ গাছসমৃদ্ধ ৩০০ মিটার উন্নয়ন নিষিদ্ধ ও ৫০০ মিটার সংরক্ষিত এলাকা। এ এলাকায় সব ধরনের স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ।
লাবণী পয়েন্টে ২০১৭ সালে সার্কিট হাউজ নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ১০তলা ভবন তৈরির সিদ্ধান্তে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ থেকে ছাড়পত্রও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ইসিএ’তে এমন কাণ্ড হচ্ছে দেখে ওই সময় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা এক রিটের বিপরীতে ‘ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান ফর কক্সবাজার টাউন অ্যান্ড সি আপ টু টেকনাফ’ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী জোয়ার ভাটার মধ্যবর্তী লাইন থেকে পৌরসভার প্রথম ৩০০ মিটার ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’ উল্লেখ করে এ এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত।
এরপর ইসিএ হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় পূর্বে বরাদ্দ পেলেও স্থাপনা নির্মাণ না হওয়া অর্ধশতাধিক প্লটের বরাদ্দ বাতিলের আবেদন করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওইসব বাতিলও করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি কউকও সৈকত হতে ৩০০ মিটারে কোনো স্থাপনা নির্মাণ থেকে বিরত থাকতে প্রচারণা চালায় সেই সময় (২০১৭-২০১৮ সালে)। বাতিল বলে ঘোষণা হয় পূর্বে নেয়া স্থাপনা নির্মাণ অনুমতিও।
এরপর কলাতলী হতে লাবণী পয়েন্টে কোনো নতুন স্থাপনা ওঠার তেমন নজির না থাকলেও চলতি বছরের শুরু হতে এসব এলাকার একাধিক হোটেল গড়ে উঠেছে। প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় কলাতলীর তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস ও ডিভাইন ইকো-রিসোর্টের মাঝখানে খালি জমিতে দিন-রাত সমান তালে নির্মাণকাজ চালাচ্ছেন একদল শ্রমিক। সৈকতের বালিয়াড়ির ১৫০-২০০ ফুট দূরত্বে চারপাশে দেয়াল তোলে ডজনাধিক শ্রমিক বিরামহীন কাজ করছেন। তার কাজ এখন শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে ইসিএ রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মুখ থুবড়ে পড়ছে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা। যে প্লটে নির্মাণকাজ চলছে সেই জমির মালিকের নাম বলতে নারাজ শ্রমিকরা।
এদিকে লাবণী পয়েন্ট ও সুগন্ধা পয়েন্টের মাঝামাঝি দুই সরকারি বাহিনী বালিয়াড়ি ও ঝাউবাগান এলাকা দখল করে গড়ে তুলেছে বিরাট আকারের হোটেল অট্টালিকা। বিশেষ করে জলতরঙ্গ, মারমেইড, উর্মি, কয়লাসহ কয়েকশ অট্টালিকা ইসিএ এলাকায় থাকলেও প্রশাসনের নজর সেদিকে না রেখে ক্ষুদে ইক্যুট্যুরিজমভিত্তিক রেস্টুরেন্টগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে খোদ সরকারি প্রশাসনের ট্যুরিস্ট পুলিশের বিলালাকার ভবনও বালিয়াড়িতে করা হয়েছে এমনটা দেখা গেছে।
এ বিষয়ে যাত্রা থেকে তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) সাবেক চেয়ারম্যান লে. কর্নেল ফোরকান আহমেদ বলেন, কউক স্বতন্ত্র যাত্রা না করা পর্যন্ত জেলা প্রশাসক চেয়ারম্যান ও গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তখন পৌর এলাকায় কক্সবাজার পৌরসভা থেকে পাওয়া অনুমতিতে ভবন নির্মাণ হয়েছে। পৌরসভা থেকে অনুমতি নিলেও ২০১৬ সালে কউক স্বতন্ত্র কার্যক্রম শুরুর আগ পর্যন্ত যেসব প্লটে নির্মাণকাজ নির্ধারিত পরিমাণ হয়নি, সরেজমিন তদন্তসাপেক্ষে সেসব প্লটের প্ল্যান বাতিল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০১৭ সালের পর থেকে নতুন কোনো স্থাপনা করতে গেলে কউক এবং সংশ্লিষ্ট আরো একাধিক প্রতিষ্ঠান হতে অনুমতিপত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে, সরকার ও উচ্চ আদালত কর্তৃক ঘোষিত ইসিএতে কোনো মতেই অনুমতি দেয়ার সুযোগ কউক বা অন্য প্রতিষ্ঠানের নেই। যে প্লটের কথা আসছে তা তখন খালি থাকায় আগের অনুমোদন বাতিল ও নতুন কোনো অনুমতি পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
প্লটের দেয়ালে লেখা রয়েছে, জমির মালিক এলিগেন্স ডেভেলপমেন্ট প্রপার্টিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আলহাজ এমদাদ উল্লাহ। সেখানে দেয়া মুঠোফোন নম্বরে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথমে অনুমতি সাপেক্ষে কাজ করছেন বলে দাবি করলেও ২০১৫ ও ২০১৬ সালের অনুমতি হিসেবে অটোবাতিল এবং সৈকতের বালিয়াড়ি থেকে ৩০০ মিটারে কোনো স্থাপনা নির্মাণে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেনÑ আমি শুরুতে কিছু কাজ করেছিলাম। পরে আর্থিক অসংগতির কারণে কাজ বন্ধ ছিল, এখন আবার করা হচ্ছে। আমার জায়গা আদালতের নিষেধাজ্ঞায় পড়েনি।
কিন্তু নির্মাণ শ্রমিকরা গত এক মাস ধরে বেইজ খুঁড়ে নতুন নির্মাণকাজ শুরু করেছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, এমনটি বলার পর এমদাদ উল্লাহ বলেন, আমরা এরই মধ্যে জেলা প্রশাসক ও কউকের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের সঙ্গে প্রাথমিক কথা হয়েছে, দুয়েক দিনের ভেতর কাজের পারমিশন ফাইনাল হয়ে যাবে উল্লেখ করে, কাজ এগিয়ে নিতে গণমাধ্যমকর্মীদের সহযোগিতা চান তিনি।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে ইসিএ এলাকায় বিনা বাধায় রাত-দিনে বহুতল ভবন নির্মাণকাজ চলতে থাকায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠছে—অদৃশ্য কারণে কউকের কিছু দায়িত্বশীল বা জেলা প্রশাসনের কেউ নির্মাণ চালিয়ে নিতে সহায়তা দিচ্ছেন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আব্দুল মান্নান জানান, কক্সবাজারে পর্যায়ক্রমে ইসিএ এলাকায় যেসব ভবন রয়েছে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। জেলা প্রশাসন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করে যারা ভবন নির্মাণ করেছে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিব। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
অন্যদিকে কক্সবাজারে এখন ভবন নির্মাণ করতে হলে কউকের পারমিশন ছাড়া অসম্ভব। আমরা কাউকে বেআইনি সহযোগিতা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। ইসিএ এলাকায় ভবন নির্মাণ বিষয়ে কারো সঙ্গে আমার বৈঠক বা কথাও হয়নি।
কেকে/এজে