সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা তার সহযোগী ও আমলাতন্ত্র এগিয়ে নিতে পারেনি। যে আগ্রহ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন, টাস্কফোর্স গঠনসহ বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা আশানুরূপ গতি পায়নি।
বৃহস্পতিবার সিলেটে ‘নাগরিক প্ল্যাটফর্ম-এর প্রাক-নির্বাচনী উদ্যোগ আঞ্চলিক পরামর্শ সভা-সিলেট’ শীর্ষক পরামর্শক সভায় এমন মন্তব্য করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি বলেন, অতীতে এদেশে কেবল দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। স্কুল-কলেজের ভবন হয়েছে, কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দেশে এমন একটি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, যারা দৃশ্যমান প্রকল্প নিতে সাহায্য করেছিল।
বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সমঝোতার জন্য সংস্কার এগিয়ে নিতে হবে। গতকাল (বুধবার) থেকে দেখছি যে এই সরকারকে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুডে নিয়ে যেতে হবে। সেটাতে গেলে সংস্কারের কাজ আরো ঢিলা হয়ে যাবে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিসরে সংস্কার বিষয়ক আলোচনা মূলত ‘জুলাই সনদ’-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এর বাইরে যে বহু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব বিদ্যমান, সেগুলোর প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ বা আগ্রহ এখনো স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়নি।
জুলাই সনদের বাইরে থাকা এসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা ও ঐকমত্যের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না, ফলে এসব সংস্কারের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সফলভাবে সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক সদিচ্ছা, অব্যাহত মনোযোগ এবং নিরলস প্রচেষ্টা। এ তিনটি উপাদান নিশ্চিত করা না গেলে, ভবিষ্যতে আবারো ‘সংস্কারবিরোধী জোট’ সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে যা পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
তিনি বলেন, অতীতের সব সরকারের আমলে দেশে ‘চামচা পুঁজিবাদী’ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এই পুঁজিবাদে কিছু চামচা তৈরি হয়। তারা দেশে লুটপাটতন্ত্র ও চোরতন্ত্রে পরিণত করেছে এবং রাষ্ট্রের কাঠামোকে এ কাজে ব্যবহার করেছে। তারা সবসময়ই সংস্কারবিরোধী।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, সব সংস্কার এক সরকার করতে পারবে না। সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে কতটুকু সংস্কার তারা সম্পন্ন করেছে এবং অবশিষ্ট মেয়াদে কতটুকু সম্পন্ন করতে পারবে। এর আলোকে অসম্পূর্ণ কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার বিষয়েও ইশতেহারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, আগামীদিনের নির্বাচনি ইশতেহারে সেই প্রতিশ্রুতিগুলোকে স্থান দেওয়া প্রয়োজন, যার ধারাবাহিকতা নতুন সরকার রক্ষা করবে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে এবং দেশকে মধ্যম আয়ের স্তরে নিয়ে যেতে এসব সংস্কার অপরিহার্য। ‘সংস্কারবিরোধী জোট’ ভাঙতে হলে এ ধরনের পদক্ষেপ নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
সভায় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অতীতের রাজনৈতিক দলগুলো অনেক আশ্বাস দিয়েছিল, কিন্তু আমরা তার বাস্তবায়ন পাইনি। তবে আমাদের পরিবর্তনের আশা আছে। আমাদের ভবিষ্যৎ অতীতের মতো হবে না। গত বছরের জুলাইয়ে আমরা এক বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছি।’
প্রাক-নির্বাচনি আঞ্চলিক পরামর্শ সভার মুক্ত আলোচনা পর্বে পর্বে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এ ছাড়া শিক্ষাবিদ ও বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও মতামত তুলে ধরেন।
আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। বিচারব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হবে। জুডিশিয়ারি পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করবে। গণমাধ্যমের ওপর কোনো ধরনের চাপ থাকবে না। দেশের অর্থনীতিকে কীভাবে আরো চাঙ্গা করা যায় সে ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। দুর্নীতি চিরতরে বিদায় করা হবে।’
মহানগর জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ড. নুরুল ইসলাম বাবুল বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী সরকারে গেলে সুশাসন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। দুর্নীতি আমরাও করব না, কাউকে করতেও দেব না। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র গড়ব যেখানে সবাই নিরাপদে বাস করবে। মুক্তভাবে তাদের কথা বলতে পারবে। পাশাপাশি অর্থনীতিকে নিয়ে আমাদের বিশেষ পরিকল্পনা থাকবে। আমাদের ইশতেহারে সবকিছুই উল্লেখ থাকবে।’
এনসিপির সিলেট জেলা কমিটির প্রতিনিধি বলেন, যারা ক্ষমতায় যান তারা গণতান্ত্রিক থাকেন না, যারা বিরোধী থাকেন তারা গণতান্তিক থাকেন। বাংলাদেশের একমাত্র সমস্যা যারা একবার নির্বাচিত হন তারা আর অনির্বাচিত থাকতে চান না। তারা সংবিধান সংশোধন করে নিজেদের ফেভারে নিয়ে আসতে চান। এজন্য এমন সংবিধান দরকার যে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। এজন্য জুলাই সনদ মানতে হবে, নোট অফ ডিসেন্ট দেওয়া চলবে না।
ইসলামী আন্দোলনের সিলেট জেলার সভাপতি মুফতি সাঈদ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা রাজনীতির প্রতি উৎসাহ তৈরি করতে পারেনি। বিগত দিনে যারা রাজনীতি করেছেন তাদের অনেকেই নিজে এবং দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছেন। আমরা এমন একটি সংসদ চাই যেখানে ছোট-বড় সব দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।
এ ছাড়া সভায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন পেশাজীবী, শিক্ষার্থী ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিরা সরকারের কাছে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি ও প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তাদের মতে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো জবাবদিহিতা ও সুশাসন। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে সাংবাদিক প্রতিনিধি দল চাপমুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানান। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিও তোলা হয়।
সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়েও সভায় নানা দাবি উঠে আসে। তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিরা সংসদে অন্তত একজন সদস্যের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান, যাতে তাদের সমস্যা সরাসরি নীতিনির্ধারণে প্রতিফলিত হয়। ভূমিহীন ও শ্রমজীবী মানুষদের জন্য ন্যায্য মজুরি ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার দাবিও জানানো হয়। শিশু ও পথশিশুদের জন্য কর্মসংস্থানের পরিবর্তে শিক্ষা ও পুনর্বাসনমূলক উদ্যোগ জোরদারের আহ্বান তোলা হয়।
অবশেষে, ছাত্র-রাজনীতি নিয়েও আলোচনা হয়। বক্তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্র-রাজনীতির নামে নোংরা ক্ষমতার প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। তারা আশা প্রকাশ করেন, নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-রাজনীতিকে ইতিবাচক ও গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
সভায় বক্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, অতীতে দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতারা অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তা কার্যত বাস্তবায়িত হয়নি। তবে তারা আশাবাদী যে বর্তমানে দেশ একটি বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ফলে অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে না। এ প্রসঙ্গে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে বলা হয়, গণতন্ত্রের মূল্য হলো নিরন্তর সজাগ থাকা। নাগরিকদের সব সময় সরকারের কার্যক্রমের ওপর নজর রাখতে হবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দেশের উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার বাস্তবায়িত হয়।
কেকে/ এমএস