বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় দল বিএনপি। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে এ দলটি তিনবার দেশের ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু প্রায় সতেরো বছর ধরে তারা টানা ক্ষমতার বাইরে। এই দীর্ঘ রাজনৈতিক নির্বাসনে বিএনপির নেতাকর্মীদের সর্বক্ষেত্রে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে—প্রশাসনিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে। বহু নেতাকর্মী মিথ্যা মামলা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ হারিয়েছেন পৈতৃক সম্পত্তি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি নিজেদের বসতভিটাও। দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে দলটির একটি বড় অংশ নিঃস্ব, নির্যাতিত ও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
এই দীর্ঘ প্রান্তিকতা বিএনপির ভেতরে সৃষ্টি করেছে হতাশা, অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। অনেকেই নিরাপত্তাহীনতা ও জীবিকার অভাবে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছেন, কেউবা স্থানীয়ভাবে টিকে থাকার জন্য ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে নানা কৌশল অবলম্বন করেছেন। কেউ কেউ বারবার কারাবরণ করেছেন, কেউ হারিয়েছেন ঘরবাড়ি ও আশ্রয়। এমন বাস্তবতায় কোথাও কোথাও ক্ষোভ বা প্রভাব বিস্তারের ছোটখাটো অভিযোগ উঠতে পারে—যেমনটি রাজনৈতিক বাস্তবতায় অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকেই পরিকল্পিতভাবে বড় করে তুলে ধরা হচ্ছে, যেন পুরো দলটিকেই ‘চাঁদাবাজ’ তকমায় আচ্ছন্ন করা যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন হচ্ছে? বিএনপি কি সত্যিই কোনো সংগঠিত চাঁদাবাজি কার্যক্রমে যুক্ত, নাকি এটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের তৈরি একটি পরিকল্পিত বয়ান?
বাস্তবতা হলো, বিএনপি আজ ক্ষমতার বাইরে থাকলেও তার গণভিত্তি এখনো দৃঢ়। জনগণই তার একমাত্র শক্তি। বিশেষ করে তরুণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থাহীনতা বেড়ে যাওয়ায় বিএনপি আবারও এক ধরনের জনপ্রিয়তা ফিরে পাচ্ছে। এই পুনর্জাগরণ অনেকের চোখে শঙ্কার কারণ। যে দল জনগণের, তাকে দুর্বল করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো তার ভাবমূর্তি নষ্ট করা। এই জায়গা থেকেই ‘চাঁদাবাজ বিএনপি’ ধারণাটির জন্ম।
আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী গোষ্ঠীগুলো মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে বিএনপিকে ‘চাঁদাবাজ’, ‘দখলদার’ বা ‘অরাজক’ দল হিসেবে প্রচার করছে। নানা সময় টেলিভিশনের টকশোতেও দেখা যায়, কয়েকজন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এই বয়ানকে আরো প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। অথচ এসব আলোচনায় সুনির্দিষ্ট প্রমাণ খুব কমই পাওয়া যায়। অভিযোগ যতটা জোরেশোরে প্রচারিত হচ্ছে, প্রমাণ ততটাই দুর্বল। ফলে এটি এখন স্পষ্ট, বিষয়টি বিএনপির রাজনৈতিক ইমেজ ধ্বংসের কৌশল হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিএনপি নেতৃত্বও তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রায় সাত হাজারের মতো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আমরা কিছু সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। কিন্তু এই সাত হাজার জনের সবাই চাঁদাবাজি বা দখলের অভিযোগে জড়িত নয়—এর মধ্যে অন্য অনেক সাংগঠনিক বিষয়ও আছে।’
তারেক রহমান কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে অভিযোগগুলোর পেছনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি জানান, অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধে এক ভাই ক্ষমতার দাপটে অন্য ভাইয়ের সম্পত্তি দখল করে রেখেছিল। ক্ষমতা পরিবর্তনের পর সেই প্রভাবশালীরা পালিয়ে গেলে নির্যাতিত ভাই, যিনি হয়তো বিএনপির সমর্থক, তিনি তার ন্যায্য হক বুঝে নিতে গেছেন। তখন প্রচার করা হয়েছে, বিএনপি দখল করতে গেছে।
আরেকটি উদাহরণে তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচারের সময় আমাদের বহু নেতাকর্মী গায়েবি মামলায় ঘরছাড়া ছিলেন। এই সুযোগে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট ও ঘরবাড়ি দখল করে নেওয়া হয়। ক্ষমতা পরিবর্তনের পর আমাদের নেতাকর্মীরা নিজেদের বৈধ সম্পত্তি ফিরে পেতে গেলে প্রচার করা হয়, তারা দখল করছে।’ তবে তিনি স্বীকারও করেন, কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও ঘটেছে—কিন্তু তা যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে, ঠিক সেরকম নয়। মূলত যারা বিএনপির পুনরুত্থানে ভয় পাচ্ছে, তারাই এখন চাঁদাবাজি ইস্যু বানিয়ে দলটিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করছে।
সবকিছুর পরেও বিএনপি অভ্যন্তরীণভাবে কঠোর শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। অভিযুক্ত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং গত কয়েক বছরে সাত হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী বহিষ্কার বা পদচ্যুত হয়েছেন।
তবে রাজনৈতিক বাস্তবতা এখানে আরো জটিল। যে অভিযোগে বিএনপিকে দোষারোপ করা হচ্ছে, তার উল্টো দিকও আছে। বিএনপির বহু নেতাকর্মী দাবি করছেন, গত সতেরো বছরে তাদের সম্পত্তি দখল করেছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর যখন বিএনপির কিছু নেতাকর্মী নিজেদের জায়গা-জমি ফিরে পেতে সেখানে গিয়েছেন, তখন তাদের ‘চাঁদাবাজ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, যারা নিজের অধিকার ফেরত চাইছেন, তাদেরকেই অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এভাবে প্রকৃত অধিকার আদায়ের চেষ্টা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পার্থক্য ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে।
আজকের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে জনমত নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হলো ‘ন্যারেটিভ’। সোশ্যাল মিডিয়ায় কয়েকটি ভিডিও, কিছু মনগড়া স্ট্যাটাস বা ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দিলেই একটি দলকে অপরাধী বানানো যায়। বিএনপি এখন এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের মুখোমুখি। তাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই তোলা হোক, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ খুব কমই পাওয়া যায়। তবু একটি শক্তিশালী প্রচারণা যেভাবে দিনের পর দিন একই বার্তা পুনরাবৃত্তি করে, তা শেষ পর্যন্ত অনেকের মনে সত্যের মতোই গেঁথে যায়। যেমনটা আওয়ামী লীগ অতীতে নানা প্রোপাগান্ডাকে প্রচার করতে করতে সত্যের মতো প্রতিষ্ঠা করেছে।
এই চিত্রে বিএনপির নিজের কিছু দায়ও অস্বীকার করা যায় না। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে দলটি যেমন চাপে রয়েছে, তেমনি সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণেও দুর্বলতা এসেছে। নানা জায়গায় স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং শৃঙ্খলার অভাব দেখা গেছে। দল যদি এই নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে না পারে, তাহলে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার দায়ও তাকে বহন করতে হবে। কারণ, একটি রাজনৈতিক সংগঠনের নৈতিক শক্তি তার সংগঠিত শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতার মধ্যেই নিহিত।
তবু বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, বিএনপিকে চাঁদাবাজ তকমা দেওয়া হচ্ছে একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে। এর মাধ্যমে একদিকে দলটির গণআন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, অন্যদিকে জনমনে ভয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করাÑ এই দুই লক্ষ্য একসঙ্গে হাসিলের চেষ্টা চলছে। রাজনীতিতে এমন কৌশল নতুন নয়। ২০১৩ সালের আন্দোলনের সময় বিএনপিকে ‘জঙ্গিবাদী’, ‘অরাজকতা সৃষ্টিকারী’ ও ‘অগ্নিসন্ত্রাসী’ বলেও প্রচার করা হয়েছিল। এখন একই ধারাবাহিকতায় নতুন শব্দ যোগ করা হচ্ছে—‘চাঁদাবাজ’।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো সেই পুরোনো ধারা থেকে বেরোতে পারেনি, যেখানে প্রতিপক্ষকে নৈতিকভাবে ধ্বংস করাই মূল লক্ষ্য। মতাদর্শ বা নীতির লড়াই সেখানে গৌণ হয়ে পড়ে। বিএনপি এ মুহূর্তে সেই রাজনীতির এক ক্লাসিক উদাহরণ—যে দলটি পুনরায় শক্তি ফিরে পেতে শুরু করেছে, তাকে আগে থেকেই অপরাধী বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
বাস্তবতা হলো, যত তকমাই দেওয়া হোক, রাজনীতি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে মানুষের আস্থায়। যদি জনগণ বিশ্বাস করে বিএনপি তাদের পক্ষে, তবে কোনো তকমাই তাদের থামাতে পারবে না। আর যদি দলটি সত্যিই আত্মশুদ্ধি ও শৃঙ্খলার পথে এগোয়, তবে সময়ই এই ‘চাঁদাবাজি’র অপপ্রচারকে ইতিহাসের এক ব্যর্থ অধ্যায়ে পরিণত করবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এমন এক সময় চলছে, যেখানে তথ্যের চেয়ে অপতথ্যই অধিক শক্তিশালী। বিএনপিকে ঘিরে ‘চাঁদাবাজ’ তকমা দেওয়ার যে প্রচেষ্টা চলছে, তা আসলে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক নতুন রূপ। অতীতে প্রতিপক্ষকে ‘দেশবিরোধী’, ‘অরাজক’, বা ‘জঙ্গিবাদী’ বলে অভিযুক্ত করা হতোÑ এখন সেই জায়গা দখল করেছে ‘চাঁদাবাজ’ শব্দটি। লক্ষ্য একটাই বিএনপিকে গণমানুষের চোখে অবিশ্বস্ত ও ভীতিকর দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক নির্বাসন সত্ত্বেও বিএনপি এখনো দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক জনসমর্থনের একটি শক্ত ভিত্তি ধরে রেখেছে। তাই একে মোকাবিলায় সরাসরি রাজনৈতিক যুক্তির চেয়ে অপপ্রচারের পথই বেছে নিচ্ছে প্রতিপক্ষ মহল।
তবে সময়ের পরিক্রমায় সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না। যদি বিএনপি তাদের সাংগঠনিক কাঠামোকে আরো দৃঢ় করে, স্থানীয় পর্যায়ে স্বচ্ছ নেতৃত্ব গড়ে তোলে এবং আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, তবে এইসব তকমা একসময় নিজের ওজনেই হারিয়ে যাবে। কারণ, জনগণ খুব ভালোভাবেই বোঝে কে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে আর কে শুধুমাত্র মিথ্যা প্রচারণায় নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে চাচ্ছে। তাই বিএনপির জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো প্রতিপক্ষের অপপ্রচার নয়, বরং নিজেদের রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও দায়িত্বশীলতা দিয়ে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক, লন্ডন যুক্তরাজ্য।
কেকে/এজে