বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত দ্রুত ডিজিটাল রূপান্তরের পথে এগোচ্ছে। অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল লেনদেন, ফিনটেক সেবা- সবকিছুই এখন তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর। এই পরিবর্তনের ফলে যেমন গ্রাহকসেবা উন্নত হয়েছে, তেমনি বেড়েছে সাইবার ঝুঁকি।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৬৮ শতাংশ ব্যাংক এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নীতি বা গাইডলাইন প্রণয়ন করেনি। অর্থাৎ, প্রযুক্তি ব্যবহারের আগ্রহ থাকলেও তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিগত কাঠামো অনুপস্থিত। সাইবার নিরাপত্তা এখন কেবল প্রযুক্তিগত বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি ব্যাংকসহ আর্থিক সব খাত এআই ব্যবস্থাপনার আওতায় রয়েছে।
এআই ব্যবহার করে ডেটা প্রক্রিয়াকরণ, গ্রাহক তথ্য সুরক্ষা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার কাজগুলো করা হচ্ছে। এ সবকিছুর সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে নৈতিক ও আইনগত দায়। ফলে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়া ব্যাংকিং খাতে এআই-এর প্রয়োগ ব্যাংকগুলো সবল করার থেকে দুর্বল করে ফেলতে পারে। তথ্যফাঁস, প্রতারণা ও বিধান লঙ্ঘনের ঝুঁকি বাড়তে পারে বহুগুণে।
বিআইবিএমের সাম্প্রতিক সমীক্ষা যে চিত্র তুলে ধরেছে তা সত্যিই উদ্বেগজনক। মাত্র ৫ শতাংশ ব্যাংক সাইবার হামলার পর এআইভিত্তিক পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা চালু করতে সক্ষম, যেখানে ৯৫ শতাংশ ব্যাংক এখনো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে। একইভাবে, মাত্র ৩ শতাংশ ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ এআইচালিত ইনসিডেন্ট রেসপন্স সিস্টেম স্থাপন করতে পেরেছে। এর ফলে, বড় কোনো সাইবার আক্রমণ হলে অধিকাংশ ব্যাংকই কার্যত অসহায় অবস্থায় পড়তে পারে।
তবে ইতিবাচক দিকও আছে। ৭৩ শতাংশ ব্যাংক মনে করছে, এআই ঝুঁকি শনাক্তকরণে কার্যকর। ফিশিং শনাক্তকরণে ৫১ শতাংশ ব্যাংক ইতোমধ্যে এআই ব্যবহার করছে, যা এক আশাব্যঞ্জক সূচনা। কিন্তু এ অগ্রগতিকে টেকসই করতে হলে প্রয়োজন প্রশিক্ষিত জনবল, উন্নত আইটি অবকাঠামো এবং নিয়ন্ত্রক সহায়তা ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ‘আইসিটি সিকিউরিটি গাইডলাইনস’, ‘ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের নির্দেশিকা’, এবং ‘ক্লাউড কম্পিউটিং গাইডলাইনস’-এর মতো নীতিপত্র দিয়েছে- যা এআই বাস্তবায়নের পথে সহায়ক হবে। তবে এখন সময় এসেছে ব্যাংকগুলোকে এই নীতিগুলোর আলোকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কাঠামো তৈরি করার। শুধুমাত্র সফটওয়্যার আপডেট নয়, প্রয়োজন নৈতিক দিকনির্দেশনা, ডেটা গোপনীয়তার সুরক্ষা এবং মানবসম্পদের সক্ষমতা বৃদ্ধি।
একই সঙ্গে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি। কারণ, সাইবার হামলার ধরন ক্রমেই জটিল হচ্ছে- যেখানে মানবিক ভুলের চেয়ে প্রযুক্তিগত দুর্বলতাই বড় হুমকি। তাই প্রতিটি ব্যাংকের বোর্ড পর্যায় থেকে শুরু করে আইটি বিভাগের শেষ সারির কর্মী পর্যন্ত সবাইকে সাইবার নিরাপত্তায় সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার অনিবার্য।
তবে এর ঝুঁকির বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। এআই নিসন্দেহে ব্যাংকিং খাতে সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিবে বটে তবে এআই ব্যাংকিং পরিষেবা ও কার্যক্রম কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, তা নির্ভর করছে ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতির ওপর। এআই ভিত্তিক ব্যাংকিংকে গতিশীল করতে তাই প্রয়োজন প্রতিটি ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন, কর্মীদের দক্ষতার উন্নয়ন এবং আন্তব্যাংকগুলোর মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ। অন্যথায় ব্যাংকিং খাতের ডিজিটাল রূপান্তর দেশের আর্থিক খাতকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলবে।
কেকে/ এমএস