চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ইউনিয়নের জঙ্গল সলিমপুর বাংলাদেশের ভেতর যেন আরেক বাংলাদেশ। সেখানে চার দশক ধরে পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে হাজারো অবৈধ বসতি। এখনো চলছে পাহাড় কেটে প্লট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রসন্ত্রাস। সরকারি খাসজমির ওপর গড়ে ওঠা এই অবৈধ নগরী কার্যত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখানে প্রশাসন বা পুলিশ ঢুকলেই হামলার মুখে পড়ে। এমনকি সাংবাদিকরাও নিরাপদ নন। এ যেন রাষ্ট্রের ভেতরে আরেক রাষ্ট্র, যেখানে সন্ত্রাসীদের আইনই একমাত্র আইন।
জঙ্গল সলিমপুরের এই দখল-রাজত্বের ইতিহাস শুরু নব্বইয়ের দশকে। সন্ত্রাসী আলী আক্কাস পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলেন এবং তা দখলে রাখতে গঠন করেন নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী। তার মৃত্যুর পর কাজী মশিউর, ইয়াসিন মিয়া, গাজী সাদেকসহ একাধিক গোষ্ঠী এলাকাটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। তারা ‘ছিন্নমূল সমবায় সমিতি’ ও ‘আলীনগর বহুমুখী সমিতি’ নামে সংগঠন গড়ে তুলে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে পাহাড়ি জমি বিক্রি শুরু করে।
শুরুতে কয়েক হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া এসব প্লট এখন লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৩১০০ একর খাসজমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল রাষ্ট্রীয় সম্পদ এখন দখলদারদের হাতে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, এলাকাটিতে এখন অস্ত্রধারী পাহারাদারদের সার্বক্ষণিক টহল থাকে। পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারে না। প্রশাসন অভিযান চালাতে গেলেই শুরু হয় গুলি, ককটেল ও ইটপাটকেল হামলা।
২০২২ ও ২০২৩ সালে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মীরা একাধিকবার আহত হয়েছেন। এমনকি র্যাবও সেখানে গুলি বিনিময়ে জড়িয়ে কোনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এমন অসহায় অবস্থা প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করে । সরকারি খাসজমিতে কারাগার, আইটি পার্ক ও নভোথিয়েটার নির্মাণের জন্য সরকার ১১টি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। কিন্তু দখলমুক্ত না হওয়ায় কোনো প্রকল্পই বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ অপরাধীরা শুধু রাষ্ট্রের ভূমি দখল করেনি, উন্নয়ন ও প্রশাসনিক পরিকল্পনাকেও অবরুদ্ধ করেছে।
এখন প্রশ্ন সমাধান কীভাবে? চট্টগ্রাম সামগ্রিকভাবে অস্থিতিশীল পরিবেশের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের সাতটি পথ দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের চালান ঢুকতেছে দেশে। অস্ত্রের চালানের প্রধান গন্তব্য কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও তিন পার্বত্য জেলার সন্ত্রাসীদের আস্তানা এর বাইরেও একটি কথোপকথন থেকে জানা যায়, সলিমপুর জঙ্গলে প্রায় ৬০ লাখ টাকার অস্ত্র ঢুকেছে। এটি যদি সত্য হয় তা ভয়াবহ উদ্বেগের বিষয়।
এককভাবে জেলা প্রশাসন বা পুলিশ দিয়ে এ সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। প্রয়োজন উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সমন্বিত অভিযান। সেনা, র্যাব, পুলিশ ও প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে জঙ্গল সলিমপুরকে দখলমুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে পুনর্বাসনের কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে, যাতে প্রকৃত ছিন্নমূল মানুষদের মানবিকভাবে স্থানান্তর করা যায়।
যারা এ দীর্ঘ দখলচক্রের পেছনে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছেন বা লাভবান হয়েছেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। জঙ্গল সলিমপুর শুধু চট্টগ্রামের একটি পাহাড়ি অঞ্চল হিসেবে বিবেচনায় নিলে চলবে না পাহাড়ে যে সন্ত্রাস হয় একসময় তা কিন্তু সমতলে চলে আসে ফলে এখনি নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর করতে নিতে হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
যদি আজ এই পাহাড়গুলো উদ্ধার না করা যায়, তবে তা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ও শাসন ব্যবস্থার জন্য ভয়াবহ সংকট নিয়ে হাজির হবে। এখনই সময় কঠোর, পরিকল্পিত ও মানবিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এই এলাকা পুনরুদ্ধার করে আইনের শাসন ফিরিয়ে আনা।